বুধবার, ২৭ জুলাই ২০১৬

ফুলন দেবী : ভারতবর্ষের এক কিংবদন্তী দস্যুরানি

Home Page » ফিচার » ফুলন দেবী : ভারতবর্ষের এক কিংবদন্তী দস্যুরানি
বুধবার, ২৭ জুলাই ২০১৬



বঙ্গ-নিউজঃ  দস্যু বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে রক্তবর্ণ চক্ষু, কঠিন নিষ্ঠুর চেহারার এক খুনি কিংবা অস্ত্র হাতে এমন একজন মানুষের ছবি যার কথা শুনলে রক্ত হীম হয়ে আসে ভয়ে। তবে কল্পনা আর ছবির বাইরে গিয়ে এমন কিছু ব্যাতিক্রম দস্যু আছে যারা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন অন্যভাবে। তাদেরই একজন ফুলন দেবী। ভারতের তৎকালীন পুলিশ প্রশাসনের রাতের ঘুম হারাম করা এক দুর্ধর্ষ নারী, দস্যুরানিখ্যাত ফুলনদেবী সাধারণ নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের কাছে ‘মায়ারানি’ নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন।

ভারতের উত্তর প্রদেশের জালৌন জেলার ঘোড়াকা পুরয়া নামক স্থানে এক নিচুজাতের মাল্লার ঘরে ১৯৬৩ সালে জন্ম ফুলনের। ছোটবেলা থেকেই জীবনযুদ্ধে বড় হওয়া ফুলন বার বার মুখোমুখি হয়েছেন কঠিন বাস্তবতা ও নির্মমতার। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আর অবহেলা-অবজ্ঞায় এক সময় ফুলন হয়ে উঠেন প্রতিবাদী এক ভয়াবহ দস্যু। প্রতিশোধের নেশায় একের পর এক মানুষ হত্যা দস্যুরানি ফুলনদেবীকে ইতিহাসের অন্যতম ডাকাত হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে।মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবার বয়সী পুট্রিলাল নামক এক লোকের সঙ্গে বিয়ে হয় ফুলনের। বিয়ের পর স্বামী বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন ও শারীরিক অত্যাচার চালতো ফুলনের ওপর। এসব সহ্য করতে না পেরে এক সময় স্থায়ীভাবে পিতৃগৃহে ফিরে আসেন তিনি।

ফুলনের গ্রাম ও আশপাশের একাধিক গ্রামে ঠাকুর বংশের জমিদারী ছিল। ফুলনের বয়স তখন সতের- জমিদারের লোকেরা প্রায়ই গ্রামের দরিদ্র গ্রামবাসীর কাছ থেকে ফসল নিয়ে যেত এবং নির্যাতন চালাত। ফুলন এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে দখলকারীদের নেতা মায়াদীনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে ঠাকুরের লোকেরা তাকে ধরে নিয়ে যায় বেমাই নামে প্রত্যন্ত এক গ্রামে। সেখানে তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। প্রতি রাতেই ঠাকুর ও তার লোকেরা জ্ঞান না হারানো পযর্ন্ত ধর্ষণ করতো ফুলনকে। ১৬ দিনের মাথায় এক রাতে নির্যাতন শেষে ফুলনকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে যায় তারা।

মৃত্যুপথযাত্রী ফুলন সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু পালিয়েও রক্ষা পেলেন না তিনি। ধরা পড়লেন এক দস্যুদলের হাতে। দস্যুনেতা বাবুর কুনজর পড়ে ফুলনের উপর। সে ফুলনকে ধর্ষণ করতে চাইলে বাধা হয়ে দাঁড়াল আরেক দস্যু বিক্রম। বাবুকে খুন করেই ফুলনকে রক্ষা করে সে। এর পর ফুলনের সঙ্গে বিয়ে হয় বিক্রমের। শুরু হয় তাদের নতুন জীবন।
আত্মসমর্পণের সময় দেবী দুর্গাকে স্মরণ করছিলেন ফুলন দেবী

দস্যুদলের নতুন নেতা বিক্রম ফুলনকে রাইফেল চালানো শিখিয়ে দেয়। রাইফেল চালানো শিখে পুরোদস্তুর দস্যু বনে যান ফুলন। তার আলাদা বাহিনী নিয়ে তিনি প্রথম হামলা চালান সাবেক স্বামীর গ্রামে। স্বামী পুট্রিলালকে টেনে নিয়ে এসে ফুলন জনসমক্ষে খচ্চরের পিঠে উল্টো করে বসিয়ে নির্জন স্থানে এনে বন্দুক দিয়ে প্রহার করে। প্রায় মৃত অবস্থায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ছেড়ে দেয়ার সময় কম বয়সের মেয়ে বিয়ে করা পুরুষদের জন্য সাবধানবাণী লিখে একটি পত্র রেখে যায় ফুলন।

ফুলনের দস্যুদলের আবাস ছিল চম্বলের বনভূমিতে। ধনী জমিদারদের মুক্তিপণের জন্য অপহরণও করত তারা। প্রতিটি ডাকাতির আগেই ফুলন দেবী দুর্গার পূজো দিতো। এরই মধ্যে একদিন ধনী ঠাকুর বংশের ছেলের বিয়েতে সদলবলে ডাকাতি করতে যান তার দস্যুবাহিনী। সেখানে খুঁজে পান এমন ‍দুজনকে যারা তাকে ধর্ষণ করেছিল। ক্রোধে উন্মত্ত ফুলন দেবী তাদের আদেশ করলেন বাকি ধর্ষণকারীদের ধরে আনার। বাকিদের পাওয়া না যাওয়ায় লাইন ধরে ঠাকুর বংশের ২২ জনকে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলে ফুলনের ডাকাত দল।

বেমাইয়ের এ গণহত্যা ভারতবর্ষে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। ফুলন দেবীকে গ্রেপ্তারের জন্য স্পেশাল টাস্কফোর্স গঠন করেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ততদিনে দস্যুরানীর নাম দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ভারতবর্ষে। তার পক্ষে আন্দোলনও শুরু হয়ে গেছে। পূজোর সময় দূর্গার মূর্তির চেহারাও তৈরি হতে থাকে ফুলনের মুখের আদলে। এভাবে চলে প্রায় দু’বছর। ফুলনের দস্যুদলের কেউ কেউ ধরা পড়ে। অনেকে মারা যায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুযুদ্ধে। অসাধারণ কৌশল আর লোকপ্রিয়তার কারণে পুলিশের কাছে অধরাই থেকে যায় ফুলন।

১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার ফুলনের সঙ্গে সন্ধি করার আগ্রহ জানায়। ফুলনও তা মেনে নেন। তবে তিনি সন্ধির জন্য অনেকগুলো শর্ত বেঁধে দেন। যার মধ্যে অন্যতম হল- তাকে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া। পুলিশের কাছে নয়, তিনি কেবলই মহাত্না গান্ধী এবং দুর্গা দেবীর কাছে অস্ত্র সমর্পন করবেন। সরকার শর্ত মেনে নিলে ১০ হাজার মানুষ আর ৩০০ পুলিশের সামনে ফুলন দেবী অস্ত্র জমা দেন গান্ধী ও দুর্গার ছবির সামনে। সেসময় ফুলনের পরণে ছিল একটি খাকি পোশাক, একটি ছিল লাল চাদর, মাথায় লাল পট্টি, কাঁধে বন্দুক।

১. ফুলন দেবী সেই সময়কার ছবি ২. আত্মসমর্পণের সময় যে বেশে এসেছিলেন ফুলন ৩. ফুলন দেবীকে নিয়ে নির্মিত ছবির অভিনেত্রী

১১ বছর কারাভোগের পর ফুলন সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ এবং ৯৯ সালে পরপর দু’বার বিহার থেকে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ২৫ জুলাই লোকসভার অধিবেশনে যোগ দিয়ে দিল্লির অশোকা রোডের বাড়িতে ঢোকার মুখেই বাড়ির সামনে তিনজন মুখোশধারী এলোপাতাড়ি গুলি করে ফুলন দেবীকে হত্যা করে। শের সিং রানা , ধীরাজ রানা এবং রাজবীর নামে এই তিনজন খুনী পরে স্বীকার করে তারা ঠাকুর বংশের সন্তান এবং তাদের বিধবা মায়েদের অশ্রু মোছানোর জন্যই তারা ফুলনকে হত্যা করে।

যেভাবে নৃশংসতার মধ্যে দিয়ে ১১ বছর বয়সী ফুলনের যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেক নাটকীয়তার পর তা থেমে গেল মাত্র ৪২ বছর বয়সে। দস্যুতার পাশাপাশি মমতা দিয়েও অনেকের মন জয় করেছিলেন কিংবদন্তীর দস্যুরানি। এগিয়ে গেছেন অনেকের বিপদে আপদে। এজন্য দস্যুরানি হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ জনগনের কাছে আজও ‘মায়াদেবী’ হিসেবেই পরিচিত ফুলন দেবী।

কিংবদন্তী নারী ফুলন দেবীকে নিয়ে ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় চলচ্চিত্র ‘বেণ্ডিত কুইন’। ছায়াছবিটির পরিচালক শেখর কাপুর ও প্রযোজক চেনেল-৪। মালা সেনের ইণ্ডিয়াস বেণ্ডিত কুইন নামক গ্রন্থ অবলম্বনে চিত্রনাট্যটি রচনা করা হয়। কিন্তু তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার অভিযোগে ফুলন দেবী চলচ্চিত্রটি ভারতে নিষদ্ধ করার দাবী করেন সে সময়। অবশেষে প্রযোজক তাকে ৪০,০০০ পাউণ্ড জরিমানা দিলে তিনি তার অভিযোগ তুলে নেন। ছবিটি ফুলনকে আন্তঃরাষ্ট্রীয়ভাবে আরো বেশি পরিচিত করে তুলেছিল।

অসমের ভ্রাম্যমান থিয়েটার অপ্সরা থিয়েটার ফুলন দেবীর আত্মসমর্পনের পর দস্যুরাণী ফুলন দেবী নামক একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন। কোনো তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়াই নাটকটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সাম্প্রতিক বিষয়-বস্তুর উপর রচিত এইটিই ছিল ভ্রাম্যমান থিয়েটারের জনপ্রিয় নাটক। ফুলন দেবী অতি সামান্য লেখা-পড়া জানতেন। কিন্তু আন্তজার্তিক পর্যায়ে তিনি লেখক মেরী থেরেশ কানী ও পল রামবালীর সহযোগিতায় ‘আই ফুলন দেবী : দা অটোবায়োগ্রাফী অফ ইণ্ডিয়াস বেণ্ডিত কুই’ নামক শীর্ষক আত্মজীবনী লেখেন। এই গ্রন্থটি ইংল্যাণ্ডের লিটল ব্রাউন অ্যাণ্ড কোম্পানি ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রকাশ করে। এই দুইজন লেখকের সহযোগিতায় ফুলন দেবীর লেখা অন্য আরেকটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের নাম ‘দা বেণ্ডিত কুইন অফ ইণ্ডিয়া: এন ওমেনস্‌ এমাজিং জার্নি ফ্রম প্রিজেন্ট টু ইন্টারনেশনেল লিজেন্ট।’

বাংলাদেশ সময়: ৬:৫৮:২২   ৩৬৬ বার পঠিত