বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০১৬
মানিব্যাগ
Home Page » শিশু-কিশোর » মানিব্যাগবঙ্গ-নিউজঃ প্রায় ১৫ মিনিট ধরে মানিব্যাগটা উল্টেপাল্টে দ্যাখে রজব আলী।মানিব্যাগটা খুব পছন্দ হয়েছে তার। বিশেষ করে মানিব্যাগটার বাদামি রংটা। ব্যাগটা চামড়ার তৈরি। রজব আলী নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকে। বোঝা যায় না কোন পশুর চামড়ায় মানিব্যাগটা তৈরি হয়েছে। মানিব্যাগটার ভেতরে অনেক ছোট ছোট কুঠরি। রজব আলী কল্পনায় দেখতে পায়- মানিব্যাগটার ভিতরে তার রাখা টাকায় ভেতরের কুঠরিগুলো ভরে উঠেছে। ব্যাগটা প্যান্টের পকেটে নিয়ে যখন হাঁটবে পিছটা ফুলে যাবে- শরীরে একটা অন্যরকম অহমিকা অনুভব করে সে।
ভাই, মানিব্যাগটার দাম কত? রজব আলী মানি ব্যাগওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে।
ব্যাগওয়ালা রজব আলীর উপর মনে মনে চটে উঠেছে। সেই কতক্ষণ থেকে ব্যাগটা উল্টেপাল্টে দেখছে। কেনার কথা বলছে না। অথচ রজব আলীর দেখার মধ্যে দুটো ব্যাগ সে বিক্রি করেছে। ফুটপাতের জিনিস এতক্ষণ নাড়াচাড়া কেউ করে না। ব্যাগওয়ালা রাগ করে কিছু বলতেও পারে না। যদি কেনে?
আপনি নেবেন? রজব আলীর দাম জিজ্ঞাসায় ব্যাগওয়ালা পাল্টা প্রশ্ন ছোড়ে। কারণ রজব আলীকে দেখে তার মনে হয় না মানিব্যাগ সে কিনবে।
রজব আলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির অফিসের পিওন। তার পরনের পোশাকে ওই বহুজাতিক কোম্পানির পরিচয় আছে। ব্যাগওয়ালার ধারণা এসব লোকজন সাধারণত মানিব্যাগ-ট্যাগ কেনে না। তাদের সামান্য পয়সা আয়। সেই পয়সায় মানিব্যাগ কেনার মানসিকতা বা প্রয়োজনীয়তাও থাকে না।
নেব।
ইতিমধ্যে ব্যাগওয়ালার সামনে দামি প্যান্টশার্ট পরা একজন ভদ্রলোক এসেছে। সঙ্গে তন্বী তরুণী। তাদের আসায় চারপাশের আবহাওয়ায় বিদেশি সেন্টের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভদ্রলোকের কাছে রজব আলী অযাচিতভাবে হেরে যায়। বাস্তবতার কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হয় তাকে।
তন্বী তরুণী ও ভদ্রলোক মিলে কয়েকটা মানিব্যাগ দেখে। বাছাই করে। অবশেষে তন্বীয় কথানুযায়ী ভদ্রলোক ৩২৫ টাকায় একটা মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেল। মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যে তারা মানিব্যাগ দেখল, দাম করল, কিনল এবং চলেও গেল। অথচ রজব আলী বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে মধ্যে দামটাও জানতে পারল না ! তারা চলে যাওয়ার পর রজব আলী ব্যাগওয়ালার কাছে যায়।
বললেন না কত দাম?
রজব আলীর দিকে আড়চোখে তাকায়, মানিব্যাগ আপনার পছন্দ হয়েছে?
পছন্দ না হলে দাম জিজ্ঞেস করব কেন?
১৮০ টাকা।
১৮০ টাকা। রজব আলী মুখ থেকে বিপন্ন শব্দগুলো বের হয়।
বিরক্তি প্রকাশ করে ব্যাগওয়ালা, অবাক হওয়ার কী আছে? আপনার সামনেই তো দেখলেন ৩২৫ টাকায় একটা মানিব্যাগ বিক্রি করেছি। ঠিক আছে আপনি ওই সোয়াশ টাকাই দেন।
সোয়াশ টাকা একটা মানিব্যাগের দাম ! রজব আলীর বিস্ময় কোনো বাধা মানে না।
ব্যাগওয়ালা বুঝতে পারে রজব আলী এতো টাকায় ব্যাগ কিনবে না। সবাই তো ওই টাকাওয়ালা ভদ্রলোক নয়, বেশি দামদর না করেই তাদের হাকানো দামেই কিনবে। রজব আলীরা তো মানিব্যাগই কেনে না। সেখানে রজব আলী যে কিনতে এসেছে সেটাই অনেক। ব্যাগওয়ালা মানিব্যাগ বিক্রি করলেও তার পকেটে মানিব্যাগ থাকে না। নিজের সঙ্গে রজব আলীর সাদৃশ্য দেখতে পায় ব্যাগওয়ালা। একই কাতারের ঠেলাগুতা খাওয়া মানুষ তারা। লোকটাকে ঠকিয়ে লাভ নেই। হয়তো অনেক আশা করে সারা জীবনে একবার একটা মানিব্যাগ কিনতে এসেছে।
আপনি সত্যিই কি মানিব্যাগটা কিনবেন? নরম কণ্ঠে ব্যাগওয়ালা জানতে চায়।
কিনব বলেই তো পছন্দ করেছি। দাম জানতে চাইছি।
তাহলে শোনেন ভাই, অনেকক্ষণ ধরে আপনি মানিব্যাগটা দেখছেন, ফাইনাল কথা বলে দিচ্ছি, মানিব্যাগটা আপনি ৮০ টাকায় নিতে পারবেন। আশি টাকার এক টাকা কমেও বিক্রি করব না।
রজব আলীর এই মুহূর্তে ব্যাগওয়ালাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়। কোথায় ১৮০ টাকা, সেখান থেকে ১২৫ এবং সবশেষে পুরো শতকই নেই ; কেবল ৮০ টাকা। সে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে রাখে। মানিব্যাগটা পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে রজব আলী নিজেকে একজন দামি মানুষ ভাবে। তার পকেটেও অনেকের মতো মানিব্যাগ আছে। দীর্ঘদিনের একটা আকাঙ্ক্ষা, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো রজব আলীর।
মানিব্যাগ কেনার পর একটা সিগারেট কেনে। সাধারণত সে সিগারেট টানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সিগারেট টানার ইচ্ছে হলো তার। না, কেবল সিগারেটই নয়, একটা ঝাল দেওয়া পানও কিনল এবং মুখে দিয়ে পরম আয়াসে চিবুতে লাগল। সিগারেটটা ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে রজব আলী একটা রিকশায় উঠল। পর পর তিনটি কাজ সে করল- যা সে খুবই কম করে। সিগারেট টানা, পান খাওয়া এবং রিকশায় করে বাসায় ফেরা। তার জীবনে একটু শ্রেষ্ঠ বিলাসিতা।
রিকশা ছুটে চলেছে।
রজব আলীর মাথার কোষে, যেখানে স্বপ্ন বিলাসী বা ইচ্ছের রক্তকণিকা থাকে- সেখানে মানিব্যাগ কেনার শখ জাগল প্রায় মাস তিনেক আগে। সে, অফিসের বড় সাহেবের ব্যক্তিগত পিওন। চা, চিনি, সিগারেট থেকে শুরু করে যা কিছু দরকার সবই আনে রজব আলী। দীর্ঘদিনের চাকরির কারণে সে বড় সাহেবের খুব বিশ্বস্ত ও অনুরাগী। অফিসে প্রতিদিন অনেক মেহমান আসে। নানান কিসিমের মানুষের আনাগোনা বড় সাহেবের কাছে। এসব মেহমান আসলেই বড় সাহেব বেল টিপে রুমের বাইরে হাতলবিহীন চেয়ারে অপেক্ষায় থাকা রজব আলীকে ডাকে। রজব আলী ত্রস্ত খরগোশের মতো ভেতরে ঢোকে। কিন্তু ঢুকেই খরগোশের মতো মাথা উঁচু রাখতে পারে না। কোথাকার কোন এক অদৃশ্য অপরিমেয় শক্তি এসে তার মাথাটাকে নিচু করে দেয়।
তার দাঁড়ানো পর বড় সাহেব বড় অবহেলায়, নিপুণ নৈপুণ্যে, গাম্ভীর্যের কৌশলী পারম্পর্যে অবলীলায় প্যান্টের ডান দিক থেকে মোগল সম্রাটদের ক্ষমতায় মানিব্যাগটা বের করে টেবিলে রাখে। মেহমানরা গভীর অভিনিবেশে বড় সাহেবের কর্মকাণ্ড দেখতে থাকে। মানিব্যাগটা টেবিলে রেখেই বড় সাহেব টেবিলের অন্যপ্রান্তে রাখা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে পরম আদরে রাখে এবং তৎক্ষণাৎ লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট টানে আয়াসের সঙ্গে।
সিগারেটে দু’-তিনটি টান দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝখানে আটকে রেখে মানিব্যাগটা তোলে ডান হাতে। মানিব্যাগটা টাকার কারণে সবসময় পোয়াতি নারীর মতো ফুলে থাকে। বড় সাহেবের মানিব্যাগে টাকাগুলো অধঃস্তন, পরাধীনভাবে নিবিড় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। একহাজার, পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ টাকার অসংখ্য নোট সাজানো পাশাপাশি। দেখতে কত ভালো লাগে! রজব আলী দেখে। দেখেই তার আনন্দ।
বাম হাতে মানিব্যাগটা ধরে ডান হাতের দুই আঙ্গুলে বড় সাহেব বেশ কয়েকটা নোট বের করে। একটা নোট রজব আলীর দিকে বাড়িয়ে দেয়, শিগগিরই নাস্তা নিয়ে আয়।
রজব আলী বিনয়ের সঙ্গে টাকাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে এবং নাস্তার আয়োজনে নিদারুণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবেই রুটিন চলছিল। হঠাৎ মাস তিনেক আগে রজব আলীর মাথায় এই প্রশ্নটা উঁকি দেয়- বড় সাহেবের গাড়ি বাড়ি টাকা মান-সম্মান ক্ষমতা আছে। রজব আলীর কিছুই নেই। কিন্তু একটা মানিব্যাগ তো থাকতে পারে। আর যাই হোক বড় সাহেবের মতো মানিব্যাগ থেকে সেও টাকা বের করে বাস কন্ডাকটর, চালের দোকানদার, মাছওয়ালা, ডালওয়ালাদের দিতে পারবে।
এই ভাবনা, স্বপ্ন এবং কল্পনার পথ ধরে কয়েক মাস ধরে রজব আলী চেষ্টা করে আসছে একটা মানিব্যাগ কেনার। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। বৌয়ের শরীর খারাপ- ডাক্তারের টাকা দেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন, বই খাতা কেনা- যাবতীয় সাংসারিক কাজের চাপে মানিব্যাগ কেনা সম্ভব হয়নি। আজকে সে বেতন পেয়েছে এবং সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে রজব আলী মানিব্যাগটা কিনেই ফেলল। আসলে কখনো কখনো একটু-আধটু রিস্ক নিতেই হয়। নইলে ছোটখাটো স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ হওয়ার নয়।
রিকশায় বসেই সে জামার বুক পকেট থেকে বেতনের বাকি টাকাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে মানিব্যাগে। মানিব্যাগটার পেট ফুলে যায়। হাতে নিয়ে তার দারুণ ভালো লাগে। কিছুক্ষণ হাতে রাখার পর রজব আলী মানিব্যাগটাকে পিছনে প্যান্টের পকেটে রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্যান্টের পিছন দিকটা ফিরে ফিরে দ্যাখে- কতটা ফুলে উঠল? তেমন না। যেভাবে বড় সাহেবের পিছন দিকটা ফুলে থাকে, সে রকম নয়। রজব আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেল।
রিকশা বাসার কাছে এলে সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে যায়। তার মনের মধ্যে ছোট সুখের একটা ছোট পাখি ডানা মেলেছে। গানের সুর ভাজতে ভাজতে রজব আলী দেড় কামরার স্যাঁতস্যাঁতে বাসায় ঢোকে।
সে ঢুকল সংসারে, তাতে সংসারের কিছু যায় আসে না। সংসারটা তার কাছে সীমাহীন অন্ধগলির মোড়। যেখানে অভাব দারিদ্র্য ক্ষুধার চাহিদা কুমিরের হা মেলে থাকে, সেখানে তার মতো একজন রজব আলীর আসা না আসায় কিছুই যায় আসে না। রজব আলীর স্ত্রী মকবুলা বেগম তিন মাস বয়সী চতুর্থ সন্তানকে মাই খাওয়াচ্ছে। অন্যরা মেঝেতে জটলা পাকাচ্ছে একটা পুরোনো ক্যারামের গুটি নিয়ে। মকবুলা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে রজব আলীকে একবার দেখে আবার মাই দিতে থাকে। রজব আলী কি করবে ভেবে পায় না। সাধারণত বেতন নিয়ে বাসায় ফিরলে তরিতরকারি, চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান, দুই এক প্যাকেট সস্তা বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে আসে রজব আলী। আজকে একবারে অন্যরকম একটা জিনিস এসেছে- যার প্রতি তার নিজের মমতা অনেক। সংসারে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কী হবে বুঝতে পারছে না।
শুনছ? রজব আলী স্ত্রীকে ডাকছে।
কনিষ্ঠতম সন্তানের মুখ থেকে মাই সরাতে সরাতে সাড়া দেয় মকবুলা বেগম- কী?
একটা জিনিস এনেছি।
মকবুলা বেগম সরাসরি তাকায় রজব আলীর দিকে- কী এনেছ?
অদ্ভুত একটা হাসি রজব আলীর ঠোঁটে- একটা মানিব্যাগ।
দ্রুত ব্যাগটা বের করে মকবুলা বেগমের হাতে দেয় রজব আলী। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো বসে থাকে মকবুলা বেগম। একবার কোটরের চোখ দিয়ে তাকায় রজব আলীর দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়েই ব্যাগটা অবহেলায় রেখে দেয় সে।
মানিব্যাগ ফুটাতে কে বলেছে তোমাকে ! বেতন পেয়েছ আজ না? বেতন পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। মকবুলা বেগমের লং প্লে বাজা আরম্ভ হলো- বাসায় কিছু নাই। অফিসে যাবার সময় বললাম, ফিরে আসার সময় ছোট বাচ্চাটার জন্য এক কৌটা দুধ এনো। বড় ছেলেটার খাতা পেন্সিল নেই- নিয়ে এসো। তার কোনো খবর নেই। উনি নিয়ে এলেন মানিব্যাগ। ছেলেমেয়ে বৌয়ের মুখে তিন বেলা ভাত জোটাতে পারে না, উনি মানিব্যাগ কিনে ভদ্দরলোক হয়েছেন। কানার আবার স্বপ্ন দেখার শখ!
রজব আলীর মন শরীর স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষাগুলোও শাঁখের করাতে কাটছে এখন। হায়, সংসারের জন্য ব্যক্তিগত দুই-একটা স্বপ্নও কি পূরণ করা যাবে না! সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তো সংসারের সুখের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সামান্য একটা মানিব্যাগের জন্য স্ত্রী এমনভাবে শ্লেষের কথা বলে- একেক সময় মনে হয় রজব আলী আত্মহত্যা করে। পারে না। স্ত্রীর শান দেওয়া কথার বান থেকে আপাতত রক্ষা পাওয়ার জন্য না খেয়ে বাইরে চলে আসে রজব আলী। এভাবেই সে অক্ষমতার জ্বালা, বেদনা ও ক্ষরণ থেকে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করে। রাস্তায় দোকানে এখানে সেখানে ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার মকবুলা বেগমের সংসারেই ফিরে আসে।
পরের দিন রজব আলী যথারীতি অফিসে।
অফিসের লোকজনের কাছে মানিব্যাগটা দেখায়। কেউ দেখে, কেউ আগ্রহবোধ করে না।
বল তো বারেক- অফিসের আরেকজন পিওনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে রজব আলী- মানিব্যাগটা কেমন হয়েছে?
বারেক মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে- ভালো। খুব ভালো হয়েছে। কত টাকায় কিনেছ?
প্রচ্ছন্ন গর্ব রজব আলীর, তুই বল।
আমি কেমনে বলব?
অনুমানে।
বারেক কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলে, ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।
তোর বাপের মাথা! ধমকে ওঠে রজব আলী। এ রকম একটা মানিব্যাগ জীবনে চোখে দেখেছিস? কেমন রং এটার! ভেতরে কতগুলো ঘর আছে জানিস! একহাজার, পাঁচশ, একশো, পঞ্চাশ টাকার নোট রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে। তা ছাড়া এই ব্যাগটা বিদেশি। দেশি না।
তোমার মানিব্যাগের যত দামই থাক, তুমি বাপ তুলে কথা বলবে? বারেকের আত্মসম্মানে সামান্য ঘা লাগে।
বলব না, হাজার বার বলব। এত শখ করে ১০০ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কিনলাম। আর তুই কি না বলিস মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় কিনেছি ! জানিস, এই রকম মানিব্যাগ আছে আমাদের বড় সাহেবের।
হতেই পারে। আমার তো মানিব্যাগ নেই। কখনো ছিলও না। তাই দাম জানি না।
বারেক যখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত তর্কে হেরে যাচ্ছিল- তখনই বড় সাহেব অফিসে ঢোকে সঙ্গে কয়েকজন মেহমান নিয়ে। বারেক চট করে সরে যায়। রজব আলী দ্রুত দরজা খুলে দাঁড়ায়। বড় সাহেব সঙ্গীদের নিয়ে রুমে ঢোকে। রজব আলীকে চা আনতে বলে বড় সাহেব। শুরু হয় রজব আলীর দৌড়।
কয়েকদিন পর বড় সাহেব অফিসে কয়েকজন ক্লায়েন্টের সামনে বসে রজব আলীকে ডাকে- রজব আলী।
জ্বী স্যার?
তোমার হয়েছে কী?
রজব আলী ভেবে পায় না তার কোথায় কখন কী হয়েছে? ডানে বামে উপরে নিচে তাকায় সে, কই স্যার- কিছু হয় নাই তো।
তোমার হাতে মানিব্যাগ কেন?
এই কথার কী জবাব দেবে রজব আলী? হঠাৎ মগজের কোষ কোনো কাজ করে না। সে বুঝে উঠতে পারে না- তার হাতে মানিব্যাগ থাকলে বড় সাহেবের অসুবিধা কী? কক্ষের সবাই রজব আলীর দিকে চেয়ে আছে। এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। হঠাৎ রজব আলী উপলব্ধি করতে পারে- মানিব্যাগটা থাকার কথা প্যান্টের পকেটে। হাতে নয় এবং তার আরো মনে পড়ল মানিব্যাগটা কেনার পর থেকে, বিশেষ করে অফিস করার সময় মানিব্যাগটা কারণে-অকারণে তার হাতেই থাকে। কেন থাকে? সে কি সবাইকে তার সদ্য কেনা মানিব্যাগটি দেখিয়ে তৃপ্তি পেতে চায়? যা প্রকারান্তরে অক্ষম অথর্ব মানুষের করুণ মনোবিকৃতি? নিশ্চয়ই তার অবস্থা দেখে বড় সাহেব, তার পরিষদবর্গ, অফিসের লোকজন হাসছে।
রজব আলী নিমিষে নিজেকে বায়ুশূন্য ফাটা একটা পরিত্যক্ত বেলুন হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করে। লজ্জায় বালুর সঙ্গে সে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে মুশকিল হচ্ছে- সে ইচ্ছে করলেই বালু বা বায়ুর সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। মানুষ হিসেবে তাকে অনড় ও অবিচল থাকতে হয়।
বড় সাহেবের মুখে অদ্ভুত হাসি- রজব?
জ্বী স্যার?
মানিব্যাগটা কবে কিনেছ?
রজব আলী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। ভেতরের কে একজন যেন রজব আলীকে থামিয়ে দিয়েছে। যে রজব আলীর ওষ্ঠ, জিহ্বা, কণ্ঠ ভেতরের ক্ষুধিত শক্তিকে পাথর বানিয়ে জমাট করে রেখেছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে কথা বলতে। পারছে না। সে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
কথা বলছ না কেন ? বড় সাহেবের কণ্ঠে এখন কর্তৃত্ব ও অপমানের সুর।
ঢোক গিলে জবাব দেয় রজব আলী- কয়েক দিন আগে।
কত টাকায়?
১০০ টাকা।
তাই নাকি ! দেখি- বড় সাহেব হাত বাড়ান।
রজব আলী সারা জীবনের সমস্ত অভিশাপ নিজের মাথায় ঢালে- কেন সে মানিব্যাগ কিনতে গেল? কিনলই যদি তাহলে পকেটে না রেখে হাতে রাখার প্রয়োজন হলো কেন? দেখাতে চেয়েছিল বড় সাহেবকে? বড় সাহেবের মানিব্যাগ থাকতে পারলে তার থাকবে না কেন? প্রতিযোগিতা? কি অসম প্রতিযোগিতা? কি ভয়ংকর গ্লানিকর পরাজয়!
কই দাও- বড় সাহেবের হাতটা তখনো বাড়ানো।
নিন।
রজব আলী ব্যাগটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। বড় সাহেব থামায়। যেতে পারে না সে কক্ষের বাইরে। এই কক্ষের ভিতরে রজব আলীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
বড় সাহেব মানিব্যাগটাকে উল্টেপাল্টে দেখে। কক্ষের অন্যান্য সবাই বড় সাহেবের হাতের ব্যাগটাকে তীর্যক চোখে দেখছে। কেউ কেউ হাসছে। সে হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ কাঁটা। কাঁটায় বিষ। যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছে রজব আলী। এ ছাড়া তার উপায়ও নেই।
রজব আলী!
বড় সাহেবের ডাকে চোখ তুলে তাকায় সে।
নাও তোমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা ভালোই কিনেছ।
হাত বাড়িয়ে ব্যাগটি নিয়ে রজব আলী দরজা খুলে নিমিষে বাইরে চলে আসে। দরজা দ্বিতীয়বার বন্ধ করতে পারে না, তার আগেই বড় সাহেব এবং অন্যদের হাসির ছুরি তীব্র অপমানে রজব আলীর কান এবং মর্মের মূলে আঘাত হানে। মনে হচ্ছে তাদের হাসির হল্লা তাকে শান দেওয়া ছুরির মতো কাটছে। রজব আলী নিজের রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
রজব আলী মানিব্যাগ আর হাতে রাখে না। প্যান্টের পকেটেই রাখে। মাস শেষে মানিব্যাগের ছোট্ট খোপে খুচরো কয়েকটা মাত্র টাকা দেখতে পায় রজব আলী। মানিব্যাগে টাকা নেই, একটা পরিত্যক্ত রুমালের মতো মনে হয় মানিব্যাগটাকে এবং রজব আলী বুঝতে পারে- বড় সাহেবের মতো মানুষদের সঙ্গে রজব আলীরা কোনো দিন, কোনো কালে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারবে না। মাস শেষ, রজব আলীর মানিব্যাগের টাকাও শেষ। অথচ বড় সাহেবের মানিব্যাগে মাসের প্রথম দিকে যত টাকা ছিল বা থাকে, এখনো সে রকমই আছে। কমে না। বরং বাড়ে। তাহাদের টাকা বাড়তেই থাকে। বাড়বে আমৃত্যু।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রজব আলী।
দীর্ঘনিঃশ্বাস এবং পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নিয়ে নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে রজব আলী। প্রতিদিনের জীবনাচারের সঙ্গে রজব আলী বেশ মানিয়ে নিয়েছে। মানিব্যাগটা তার সঙ্গে থাকছে প্রতিদিনকার মতো- যেমন তার পকেটে থাকছে একটি রুমাল, একটি চিরুনি। মাসের প্রথম দিকে মানিব্যাগটা ভরা থাকে, মাঝখানের দিকে কমতে কমতে টাকা অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়, এই কমার গতিটা বলবৎ থাকে গাণিতিক হারে। মাসের শেষের দিকে রজব আলী মানিব্যাগ বহন করার আর কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না। কারণ ব্যাগের তলায় পাঁচ-দশটা টাকা পড়ে থাকে বড় অযত্নে, বড় অবহেলায়। কখনো কখনো রজব আলীর মনে হয়- মানিব্যাগটা বোধহয় তাকেই উপহাস করছে।
মাস খানেক পরে একদিন।
রজব আলী অফিস থেকে ফিরছে। মাস শেষের দিকে। বাসে প্রচুর ভিড়। বাসে ওঠা মানে খাঁচায় ওঠা। জীবন যে কত অবাঞ্ছিত, বাসে উঠেই সেটা বুঝতে পারে রজব আলী।
বাস থেকে নেমেই হাত দেয় সে প্যান্টের পকেটে।
মানিব্যাগটা নেই!
রজব আলী কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মানিব্যাগটা পকেটমার নিয়ে গেছে। রজব আলী মানিব্যাগটার জন্য ভাবছে না। ভাবছে মানিব্যাগে রাখা ২০টি টাকার কথা। ওই ২০ টাকা থাকলে সে আরো দুই দিন বাস ভাড়া দিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে পারত।
বাংলাদেশ সময়: ৮:৩৯:৪৫ ৬০৩ বার পঠিত