রবিবার, ১৯ জুন ২০১৬
কোন চে আমাদের প্রয়োজন
Home Page » শিল্প ও ছবি » কোন চে আমাদের প্রয়োজনবঙ্গ-নিউজঃ
পৃথিবী সম্ভবত সেই দিনটিতে আন্তরিকভাবে শপথ করেছিল, অতীতের সব পাপ-বর্বরতাকে পেছনে ফেলে শুভ-মঙ্গল আর আনন্দের দিকে উত্তরোত্তর গমন করবে। যার কারণে সেই শুভ দিনটিতে তার বুকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল অ্যার্নেস্তো।
সেই শুভদিনটি আজ। আজ ১৪ জুন। ১৯২৮ সালের এই দিনে জন্মেছিলেন সেই স্বপ্নপ্রাণ-স্বপ্নবান মানুষ। যে মানুষটার লোকপ্রিয় নাম ‘চে গেভারা’- ইতিহাসের ভুবনকাঁপানো কীর্তিমানদের একজন। পৃথিবীর সবচেয়ে লোকপ্রিয় শব্দ-অধিকারীদের একজন- CHE- বিশ্বকে শুনিয়েছিলেন অমর সেই বাণী - ”বিজয়ের পথে অগ্রসর হও (HASTA LA VICTORIA SIEMPRE)”। আহ্, কী আত্মবিশ্বাস!
স্বপ্নবান চে, স্বপ্ন দেখানো চে, ‘বিপ্লবের বরপুত্র’ কমরেড অ্যার্নেস্তো চে গেভারা- ৮৮তম জয়ন্তীতে অতল শ্রদ্ধা! স্বপ্ন দেখি, আপনার স্বপ্ন পৃথিবীর সমান বয়স নিয়ে বেঁচে থাকবে!
চেয়ের কথা বলতে গিয়ে নোবেলজয়ী দুই কিংবদন্তি সাহিত্যিক জ্যঁ পল সার্ত্রে ও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কথা মনে পড়ে। বিশ শতকের জগদ্বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক, সাহিত্যে নোবেল জয়ের পরও যিনি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেই সার্ত্রে বলেছিলেন, ‘আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ মানুষটির নাম অ্যার্নেস্তো চে গেভারা।’ আর দুই বছর আগে প্রয়াত কলম্বিয়ান সাহিত্যিক, স্প্যানিশ ভাষার সর্বকালের সেরা ঔপন্যাসিকদের একজন মার্কেজের উপলব্ধি ছিল, ’আমি হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখতে পারি, শুধু চেকে নিয়ে।’ কে ছিলেন চে, দুই ক্ষণজন্মা সাহিত্যিকের কলমেই যেন সব ধরা যায়, ছোঁয়া যায়।
জন্মোৎসবের এই দিনটির বিপরীতে দাঁড়িয়ে অবশ্য সেই বর্বরতম দিনটির কথাই আমাদের উচ্চারণ করতে হয় বেশির ভাগ সময়ে। কারণ পৃথিবী তার শপথ রক্ষা করেনি! শপথ ভাঙতে ভাঙতে, বর্বরতা করতে করতে, পৃথিবী আবার চিরকালের জন্য বর্বর অতীতে ফেরার মনস্থির করেছিল একদিন। সেদিনটাতে সে তৈরি করেছিল বর্বরতম ইতিহাসের নতুন নজির। খুন করেছিল অ্যার্নেস্তোকে! পৃথিবী ক্ষমা-অযোগ্য অপরাধ করেছিল সেদিন। হয়েছিল পাপবিদ্ধ!
পৃথিবীতে খুব কম মৃত্যুই এত বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। যতটা করেছে চে’র মৃত্যু। মৃত্যু নয় আসলে, ওটা ছিল হত্যাকাণ্ড। সেই হত্যাকাণ্ড এতটাই মর্মান্তিক যে, কী জন্মদিনে, কী শাহাদাৎবরণের দিনে চেকে স্মরণ করতে গেলে তার বিপ্লবী জীবনের অন্তিম মুহূর্তটাই সামনে চলে আসে। তার বিপ্লবীপনা তো অবিসংবাদিতই; তবে চে-কে অমর বানিয়েছে সম্ভবত তাঁর ওই মৃত্যুই! অদেখা মৃত্যুকল্প ও দৃশ্য!
বলিভিয়ার লা হিগুয়েরার গহিন অরণ্য থেকে ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর বন্দি করার পর ৯ অক্টোবর যখন চেকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হয়েছিল মদ্যপ বলিভিয়ান সেনা মারিও তেরান, তখন তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘মারো কাপুরুষ, তোমার গুলিতে মারা যাবে শুধু এই মানুষটা। কিন্তু তার আদর্শ বেঁচে থাকবে।’
হত্যার কিছু আগে চে-কে আরেক বলিভিয়ান সেনা বলেছিল- ‘তুমি কি বাঁচার চিন্তা করছ?’ উত্তরে চে বলিষ্ঠতার সঙ্গে বলেছিলেন- ‘না, আমি শুধু বিপ্লবের অমরত্ব নিয়ে চিন্তা করছি।’ বিপ্লবীদের এমন সাহসী গুণ থাকতে হয়। এ কারণে মার্কিন ক্ষমতাকাঠামো তাকে ভয় পেত। মৃত চেকেও তাদের ভয়ের অন্ত ছিল না। তাই যে হাতে চে বিদ্রোহের দামামা বাজিয়েছিলেন, সেই হাত কেটে কিউবান বিপ্লবের অগ্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রোকে ‘উপহার’ পাঠিয়েছিল মার্কিন আধিপত্যবাদের মদদপুষ্ট বলিভিয়ান স্বৈরশাসক রানে বারিয়েনতোস।
সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র যদি হয় ‘যুদ্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা’, তবে সেই অস্ত্রের হাতেখড়ি হয় বাণিজ্য বিস্তারের মননে। বাণিজ্যের মনন বড় ভয়ঙ্কর মনন। এতে লাজলজ্জা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত বলে কিছু নেই। সেজন্যই চে আজ পণ্য। সেজন্যই চে প্রসঙ্গে বলতে হচ্ছে- তিনি নৈর্ব্যক্তিকের বিপরীতে শুধুই এক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন।
এত জানাই যে, সামষ্টিক আদর্শের বিপরীতে ব্যক্তিগত খায়েস চে গেভারার স্বপ্নের বিপ্লবী রাজনীতিতে মূল্যহীন। কিন্তু সেই ব্যক্তিসর্বস্ব চলন-বলন তার আদর্শবাদী অবয়বকে প্রায় চুলোয় নিয়ে গিয়েছে। যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পণ্যের মতো সাঁটানো তাঁর ছবি বড়ই মর্মান্তিক দেখায় বণিকের দাপুটে খেলায়!
ব্যক্তির আদর্শ থাকে। ব্যক্তির চেতনা থাকে। এতে কোনো বিরোধ নেই। সংঘাতও নেই। কিন্তু ব্যক্তির আদর্শ বা চেতনা কিসের জন্য? সামষ্টিক পরিবর্তনের জন্য তো? চে জীবনের শুরুতে মার্কসবাদী ছিলেন না। বিপ্লবের পথে এসে মার্কসবাদ বুঝেছেন। মার্কসবাদী হয়েছেন। কিন্তু চেতনাটা ছিল। ব্যক্তির ওই চেতনা বৃহত্তর চেতনার প্রতি অনুরক্ত হলেই প্রকৃত বিপ্লবী হওয়া সম্ভব। চে তাতে সফল হয়েছিলেন।
কিন্তু আজকের চে তো ব্যর্থ! কারণ তার চেতনা ব্যক্তিসর্বস্ব হয়ে গেছে। আমরা ১৯৬৭ সালের পূর্বে বেঁচে থাকা চে’র কথা বলছি না। বলছি আজকে তার ৮৮তম জন্মদিনের সময়কার কথা। গত প্রায় ৫০ বছরে চে কারও কাছে ‘নিশ্চয়ই’ শুধু নয়, বলা উচিত ‘অবশ্যই’ অনিবার্যভাবে ‘বিপ্লবের প্রতীক’ হিসেবে অমর হয়ে আছেন। আমরা তাদের কথা বলছি না।
আমরা তাদের কথা বলছি, যাদের কাছে চে বিপ্লব নয়, বিজ্ঞাপনের প্রতীক! তরুণ সমাজে এই সংখ্যাটা অনেক বেশি। তারা মৃত চেকে বিজ্ঞাপনের ‘মডেল’ হিসেবে চেনে। এই যে বিজ্ঞাপনে চে’র বাহারি উপস্থিতি সেটা আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে না। কনজিউমারইজম ভর করেছে মৃত মানুষটির ওপর। পণ্য বানানোর যে রাজনীতি, সেই রাজনীতির শিকার হয়েছেন চে গুয়েভারা।
বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আলবার্তো কোর্দার তোলা জগদ্বিখ্যাত ‘গেরিলা হিরোইকো’ যে হিরোর কথা বলে সেই হিরো আজ কোথায়? বিজ্ঞাপনে, পণ্যের মোড়কে। হলিউড-বলিউডের সুপারস্টারদের মতো অবস্থা হয়েছে ৪৯ বছর আগে শহীদ হওয়া চে গুয়েরার।
এই চে বড়ই নিষ্প্রয়োজন। প্রয়োজন সেই চে’র- যার স্বপ্ন ছিল, দর্শন ছিল, চেতনা ছিল, সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ছিল, বিপ্লবের অমরত্বে তীব্র আশাবাদ ছিল। বিজ্ঞাপনের জবাব বিজ্ঞাপনেই দিতে হবে। পাল্টা বিজ্ঞাপনে ‘গেরিলা হিরো’ চেকেই উপস্থাপন করে তার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার তাই বিকল্প নেই। সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে কি না সেটা বলা এই শ্রদ্ধা-কথামালার উদ্দেশ্য নয়।
অনিবার্যভাবে, তার মৃত্যুই তাকে মহান করেছে, সেটা তো আগেই বলেছি। তার বিপ্লব স্পন্দিত বুকটাই ঘাতকদের প্রিয় ছিল। কারণ তাতে তাজা-বেগবান স্বপ্ন ছিল। মৃত্যুকে তিনি পরোয়াই করতেন না। নইলে কেন বলবেন, ’মুক্তি অথবা মৃত্যু!’
মাত্র ৩৯ বছর বয়সে শহীদ হওয়ার এক মাস আগেও দেখি, চে গেভারা নিজের জন্য লেখা এপিটাফেও সেই মৃত্যুকে বীরের মতো আলিঙ্গনের কথাই বলেছিলেন। লিখেছিলেন- ‘মৃত্যু যেখানেই আমাদের বিস্মিত করুক না কেন, তাকে স্বাগত জানাও। আমাদের সংগ্রাম হয়তো কিছু উৎসাহী কানে পৌঁছাবেই এবং কিছু হাত আমাদের হাতিয়ার ধরার জন্য প্রশস্ত হবেই হবে।’
আজকের বৃহদাংশ তারুণ্যের হাত প্রশস্ত হলেই ব্যক্তি চে’র পতন সম্ভব। তখন চে গেভারার নৈর্ব্যক্তিক চেতনার বিকাশ অনিবার্য। বুঝতে হবে- সুপারস্টার চে নয়, বিপ্লবের বরপুত্র চেকেই প্রয়োজন এই ফাটকাবাজির কালে।
সময়ের দাবি মেনে আমরা কি সেই আহ্বানটা শুনছি? সেই তাড়নাটা বোধ করছি?
বাংলাদেশ সময়: ১০:০১:২৫ ৪২৮ বার পঠিত