শনিবার, ১১ জুন ২০১৬

খোয়াব চোর | রুমেলা সাহা

Home Page » সাহিত্য » খোয়াব চোর | রুমেলা সাহা
শনিবার, ১১ জুন ২০১৬



খোয়াব চোর | রুমেলা সাহাবঙ্গ-নিউজ: তিরতির করে বয়ে চলে পদ্মা। সূর্যের শেষ আভার স্পর্শদোষে রক্তিম নদী। জলের আয়নায় নিজেকে মেলে দেয় সে। হাজার হাজার টুকরোয় ভেঙে যায় অবয়ব। অবয়ব না সে নিজে। এক একটা ভাঙা টুকরো থেকে জন্মায় খোয়াব। জুগনুর আলো হয়ে খোয়াবরা পাড়ি দেয় আসমানে। ওই যে সারা আসমান জুড়ে ঝিলমিল করে, ওগুলো খোয়াব ছাড়া আর কি… মনের গহীনে জন্ম নেওয়া এক একটা জমাট বাঁধা আলো।হাতে লেগে থাকা মাটিটা পদ্মায় জমা রাখে, আলতো ভাবে। এই মাটি দিয়েই একটু আগে ঢেকে এসেছে খোয়াব চোরকে। গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া বৃদ্ধ শরীরটাকে।

ইরশাদ আলি বলত- খোয়াব সবাই দেখে কিন্তু খোয়াব নিয়ে বাঁচে ক’জন? ঘুম ভাঙলেই মিলিয়ে যাওয়া নয়, জীবনভর রাস্তা দেখানোই তো খোয়াব।

স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায় বিকেলে সে দেখত, নদীর ধারে অশ্বত্থ গাছে ঠেস দিয়ে বসে থাকত মানুষটা, ঝুলিতে বাঁশি।

লোকে বলত ইরশাদ বাঁশিওয়ালা।

বলত- এটা তো বৃন্দাবন নয়, তুমি কার জন্য বাঁশি বাজাও।

বিনম্র হেসে ইরশাদ পদ্মার ওপার দেখিয়ে বলত- ওর জন্য, বাঁশির ডাকে ওই তীর যদি কখনও এদিকে চইলা আসে।

লোকে বলত- পাগল।

চোখ দুটো নেচে উঠত ইরশাদের, বলত- আল্লার মেহেরবানি।

সুরের টানে ইরশাদের পাশে গিয়ে বসত ধ্রুপদ। লোকটার সুরে জাদু ছিল।

বলত- বাপজান তোমার নামটা বড় মিঠা, গলা আর মনটারে এমনি মিঠা রেখো।

সে জানতে চাইত- তুমি আর কি করো বাঁশিওয়ালা?

ছোট্ট ধ্রুপদের মাথায় মমতা মাখিয়ে ইরশাদ বলত- খোয়াব চুরি করি।

-সে আবার কি!

-এই যে পুরনো করবখানা। ওখানে যাঁরা মাটির নীচে শুয়ে থাকে, তাঁদের দেখা খোয়াব আসমানে জুগনু হয়ে জ্বলে। লাওয়ারিশ সেই খোয়াবগুলি চুরি করি।

-কী ভাবে করো?

-সে তো তোমায় বলা যাবে না।

ধ্রুপদ আরও কোলের কাছে এসে বলে- বলো না, কাউকে বলব না।

-ঠিক আছে, আমার এন্তেকালের পর আমার খোয়াবটা তুমি চুরি কোরো, কেমন।

সময়ের তাগিদে সবই সরে সরে যায়। মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা কতই বা দূর? আরও দূর পদ্মার এই দু’পার, মাঝ দিয়ে ৩ প্রজন্ম সময় বয়ে গেল, দূরত্ব কমল না। জলের দাগের মতো মিলিয়ে যাওয়া বাঁশিওয়ালা ধরা পড়ল চোর হয়ে। ২৭ বছর পর।

সে রাতে গাঁয়ে কী হল্লা, বেড়াচোরকে ধরেছে গ্রামবাসী। সীমান্তবর্তী গাঁ হওয়ায় খেতের মাঝ বরাবর কাঁটাতার লাগানো। বেশ কয়েক মাস ধরেই জায়গায় জায়গায় গায়েব হয়ে যাচ্ছে সে বেড়া। চোর যে এটাও ছাড়ে না। রীতিমতো হাসির খোরাক। সেই বেড়াচোর ধরা পড়েছে। বাঁশের খুঁটিতে দু’হাত বাঁধা বৃদ্ধ বাঁশিওয়ালা। ধ্রুপদ কেঁপে ওঠে। গাঁয়ের গুণী প্রবাসী শিল্পীকে সবাই খুব মানে। নিজের দায়িত্বে ছাড়িয়ে আনে তাঁকে, বলে- কেন এমন করো বাঁশিওয়ালা?

বিস্মৃতির কুয়াশা মাখা চোখে অপরিচয়ের ছায়া।

-কী করো বেড়া চুরি করে?

বৃদ্ধের চোখে সূর্যালোক ঝলসে ওঠে, বলে- গোর দি মাটিতে।

-কেন?

-ওই বেজান বেড়াটার জন্য কত চোখের পানি, কত ঘৃণা, কত যন্ত্রণা, কত যুদ্ধ। যার জান নাই তার লাগি কত জান যায়, আমি রাতের আন্ধারে বেড়াটারে খুইলা লই। যেহানে বেড়া নাই সেখানে দেশভাগ নাই। সব এক, কে কইবে কোনটা দেশ আর কোনটা বিদেশ?

-কী লাভ, এতে বিপদ আছে।

-লাভ… যে-বেড়া আমাগো অনুমতি লইয়া তৈরি হয় নাই তারে আমরা এত পাত্তা দিমু ক্যান?

অনেক বুঝিয়েও নিরস্ত্র করতে পারেনি ধ্রুপদ। আবার ধরা পড়ে বাঁশিওয়ালা। তবে শরীরটা। বেড়া কাটার সময় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর গুলিতে ঝাঁঝরা শরীরটাকে মাটির চাদরে ঢেকে এসেছে সে।

পদ্মাপারের অশ্বত্থ গাছের নীচে বসে আসমানের দিকে তাকায় ধ্রুপদ।

তারায় গুঞ্জরিত আসমানে কোন খোয়াবটা বাঁশিওয়ালার? খোঁজে সে।

গত ৬৮ বছরের লক্ষ লক্ষ খোয়াবের মধ্যে হাতড়ে চলে ধ্রুপদ। সব খোয়াবই তো এক রকম দেখতে, কোনটা চুরি করবে সে…

বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৮:২৭   ৩৮৪ বার পঠিত