বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০১৬
কী বিচার চাইব কার বিচার চাইব
Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » কী বিচার চাইব কার বিচার চাইবইউএসএইড কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয় রাব্বি হত্যার পরিকল্পনা হয় দুই মাস আগে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবরে বসে পরিকল্পনা করে ঘাতকরা। এর মধ্যে অন্তত তিনবার কলাবাগানে জুলহাসের বাসার সামনে রেকি করে তারা। সবশেষ রেকি করা হয় ঘটনার দিন সোমবার সকালে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আদাবরের ভাড়া বাসা থেকে একসঙ্গে ঘটনাস্থলে আসে ঘাতকরা। এমন তথ্য জানিয়ে পুলিশ বলছে, ঘাতকদের শনাক্ত করা হয়েছে। এ পর্যায়ে তথ্য যাচাই-বাছাইসহ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মামলা ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।এদিকে এখনো ছেলে হত্যার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না নিহত মাহবুব তনয় রাব্বির মা মাহবুবা রাব্বি। ‘তনয় পরিস্থিতির শিকার’ উল্লেখ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আর কারও যেন এভাবে জীবন দিতে না হয়। একমাত্র ছেলে আমার বুক খালি করে চলে গেছে। কে মারছে, কারা মারছে কাউকে চিনি না, কিছুই জানি না। কার বিচার চাব, কার কাছে, কার বিরুদ্ধে নালিশ করব তাও বুঝতে পারছি না।’ একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পরিবারটির এখন বাকরুদ্ধ।
তনয়ের বোন জাকিয়া করিম বলেন, আমরা জুলহাসকে চিনি না। কাজের ক্ষেত্রে তনয়ের সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় ছিল। সেইভাবে হয়তো পরিচয় হয়েছে। পরীক্ষা শেষে হয়তো সে সেখানে দেখা করতে গেছে। তারপর তার শিল্পকলা একাডেমিতে যাওয়ার কথা ছিল। তা আর হলো না। দোষীরা পার পেয়ে গেলে এ ধরনের অপরাধ বাড়তেই থাকবে বলে মন্তব্য করেন জাকিয়া করিম।
তনয় বেসরকারি আশা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ২৪ এপ্রিল তার ২৫তম জন্মদিন ছিল। জন্মদিনের উৎসব পালনের ঠিক একদিন আগে ঘাতকরা তার প্রাণ কেড়ে নেয়। পরিবারের লোকজন জানায়, তনয় মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই নাটক আর গানবাজনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এর মধ্যে লোকনাট্য দলের সঙ্গে ঘুরেছেন ভারত, ফ্রান্স ও তুরস্ক।
তনয়ের মতো জুলহাস মান্নানের মা বৃদ্ধ সকিনা খাতুনও বাকরুদ্ধ। হত্যাকা-ের পর তাকে নেওয়া হয় বড় ছেলে মান্নান ইমনের গুলশানের বাসায়। নিজের অসুস্থতার পাশাপাশি ছেলেকে নিয়ে আরও ভেঙে পড়েছেন তিনি।
ডিবি পুলিশ বলছে, ঘাতকদের অনেকেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সমকামিতার অভিযোগ এনেই এই হত্যাকা- ঘটানো হয়। তবে জুলহাস মান্নান ঘাতকদের মূল টার্গেট ছিল বলে অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। আদাবরের যে ভাড়া বাসা থেকে জঙ্গিরা জুলহাসকে হত্যা করতে এসেছিল, ওই বাসা ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হয়। আর ভাড়ার চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। ওই বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কিলিং স্কোয়াডের সদস্যরা একসঙ্গে মোনাজাত করেন। এরপর খুনের পর বলেন, আল্লাহু আকবর। এটা ছিল তাদের ওপর কথিত হুজুরের নির্দেশনা।
গত সোমবার রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় খুন হন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয় রাব্বি। পুলিশ ও নিহতের পরিবারের দায়ের করা মামলায় নৃশংস এই হত্যাকা-ে ৫-৬ জন অংশ নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ‘আছিয়া নিবাস’ বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী পারভেজ মোল্লা গতকাল জানান, হত্যাকা-ে সাতজন অংশ নেয়। ঘটনার দিন পারভেজ মোল্লাকে কুপিয়ে আহতও করা হয়। এছাড়া ওই দিন বাড়ির কেয়ারটেকার ও আরেক নিরাপত্তারক্ষী সুমনকে মূল গেটের পাশে একটি ছোট্ট কক্ষে আটকে রাখা হয়।
পারভেজ মোল্লা বলেন, জুলহাসের বাসার ফটকে প্রথমে চারজন পার্সেলের তিনটি বাক্স নিয়ে এসে বলে- পার্সেলগুলো জুলহাস স্যারের। তখন পারভেজ গেটের সিটকিনি আটকে দোতলায় জুলহাসের কাছে পার্সেলের বিষয়টি জানানোর জন্য ওপরে যান। তার সঙ্গে ওই চারজনও ওপরে উঠে যায়। এ সময় জুলহাস দরজা খুললে ঘাতকদের একজন জানায়, তার (জুলহাস) নামে পার্সেল আছে। কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে জুলহাসের কথা হয়। জুলহাস বলেন, তার নামে কোনো পার্সেল আসার কথা নয়। পার্সেল এলেও পার্সেলে কী আছে, সেটা দেখবেন, তারপর গ্রহণ করবেন।
পারভেজের ভাষ্য, কথা বলার একপর্যায়ে তিনি (পারভেজ) ও জুলহাস আগত ব্যক্তিদের সন্দেহ করেন। এ সময় জুলহাস দরজা আটকে দিতে গেলে ঘাতকরা তাকে বাধা দেয়। এ অবস্থায় ঘাতকদের বাধা দিলে একজন পারভেজের বাম বাহুতে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়।
পারভেজ বলেন, তখন আমি বুঝতে পারিনি যে আমাকে কোপ দেওয়া হয়েছে। তারপর তিনি আবার বাধা দিতে গেলে কপালে কোপ দেয়। এতে রক্ত বের হতে শুরু করলে তিনি চিৎকার দিয়ে নিচে নেমে আসেন। তখন ওই চারজন ঘরে ঢুকে জুলহাস ও তনয়কে কুপিয়ে চলে যায়। কোপানোর সময় তারা আল্লাহু আকবর বলেন। নিচে নামার সময় পারভেজ দেখেন, গেটের সামনে আরও দুজন ও গেটের বাইরে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সব মিলিয়ে মোট সাতজনের কথা উল্লেখ করেছেন পারভেজ মোল্লা।
অন্যদিকে জোড়া খুনের ঘটনায় আরও কিছু আলামত পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। গতকাল নিজ কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা (নিহতরা) একটি সংগঠন করত। সেখানে কোনো আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত সমস্যা অথবা কোনো সংঘবদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী ঘটনাটি ঘটিয়েছে কিনা এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছি না। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। দুই-চারদিন গেলেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারব। কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে না। সব ডাইমেনশন মাথায় নিয়ে এগোচ্ছে পুলিশ।
তারপরেও এ ঘটনায় আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি সন্দেহে রাখার কারণ ব্যাখ্যায় ডিএমপি কমিশনার বলেন, তদন্তের স্বার্থে আরও কিছু কথা আপনাদের বলতে পারছি না। আমরা আরও কিছু আলামত পেয়েছি। একজন হত্যাকারী এমন ঘটনা ঘটাতে পারে যাতে তার দায় এড়িয়ে ইঙ্গিত যেন অন্যদিকে যায় সেটিও তো হতে পারে।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, তদন্তকারী অফিসার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এর যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখা। একজন খুন করে অন্যকে ফাঁসানোর জন্য অন্য ধরনের ডাইমেনশন দেওয়ার একটি অপচেষ্টাও হতে পারে। হত্যার আসল উদ্দেশ্য কী ছিল, কারা জড়িত ছিল তা খুঁজে বের করব।
ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও খুনিদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারা পুলিশের ব্যর্থতাÑ বিষয়কে অস্বীকার করে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, পুলিশ গুলি চালালেও তাদের গায়ে লাগেনি। কারণ ওই সময় আসরের নামাজ শেষে মুসল্লিরা রাস্তায় বের হন। তখন সুযোগ বুঝে সন্ত্রাসীরা জনগণের ভিড়ে হারিয়ে যায়। এটি ব্যর্থতা বলব না, দুঃখজনক বলব। পুলিশ সদস্যরা যখন এক খুনিকে জাপটে ধরল তখন মানুষ সহযোগিতা করলে তাদের ধরা যেত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, দেশের এক ধরনের বিপথগামী লোক যারা দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি করতে, অশান্তি তৈরি করতে পরিকল্পিত হত্যাকা- করে দেশে নৈরাজ্য তৈরি করতে একটা অপপ্রয়াস দীর্ঘদিন ধরে করছে। সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাদের কলাকৌশল আছে। নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে সফলতা রয়েছে।
‘আনসার আল ইসলাম’-এর এই হত্যার দায় স্বীকার নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে দায় স্বীকার করা হয়। এর যৌক্তিকতা এবং বাস্তবতা কতটুকু আছে, তা ভেবে দেখা দরকার। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০:৩৬:২০ ৩১২ বার পঠিত