মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল ২০১৬

মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তা খুন

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তা খুন
মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল ২০১৬



কলাবাগানে বাসায় ঢুকে বন্ধুসহ কোপায় তিনজনকে, ধাওয়া করলে কোপায় পুলিশ সদস্যকেও * ‘আল্লাহু আকবর’ বলে গুলি করতে করতে চলে যায় খুনিরা - See more at: http://www.jugantor.com/first-page/2016/04/26/27703/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%A6%E0%A7%82%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%96%E0%A7%81%E0%A6%A8#sthash.9Za3dFq2.dpufকলাবাগানে বাসায় ঢুকে বন্ধুসহ কোপায় তিনজনকে, ধাওয়া করলে কোপায় পুলিশ সদস্যকেও * ‘আল্লাহু আকবর’ বলে গুলি করতে করতে চলে যায় খুনিরা

কলাবাগানে বাসায় ঢুকে বন্ধুসহ কোপায় তিনজনকে, ধাওয়া করলে কোপায় পুলিশ সদস্যকেও * ‘আল্লাহু আকবর’ বলে গুলি করতে করতে চলে যায় খুনিরা
রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ঢুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও তার বন্ধুকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী পরিচয়ে পার্সেল দেয়ার কথা বলে বাসায় ঢুকে খুনিরা। মুহূর্তেই বাসার দারোয়ান ও তাদের কুপিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে ফাঁকা গুলি করতে করতে বের হয়ে যায়। তাদের ধাওয়া করতে গেলে এক পুলিশ সদস্যকেও কোপায় হামলাকারীরা।
নিহতরা হলেন জুলহাস মান্নান (৪০) ও মাহবুব রাব্বী তনয় (৩৮)। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাস ইউএস এইডে কর্মরত ছিলেন। সমকামীদের অধিকারবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘রূপবান’ সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। জুলহাস সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনির খালাতো ভাই। তনয় নাট্যকর্মী। তিনি লোকনাট্য দলের সদস্য।
ইতিপূর্বে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন হওয়া মুক্তমনা ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যার সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডের মিল রয়েছে। তাদের মতো এদেরও চাপাতি দিয়ে মাথায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। খুনিরা ছিল প্রশিক্ষিত ও চৌকস। ছয় খুনির দলটি মাত্র ৫ মিনিটে কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করে চলে যায়।
ধর্মীয় উগ্রপন্থী কোনো গ্রুপ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেছেন, এটি টার্গেটেড কিলিং। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যেই দুর্বৃত্তরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পালিয়ে গেছে। তারা ৬ জন ছিল বলে জানা গেছে। ওদের কাছ থেকে একটি ব্যাগ, মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। এতে গুরুত্বপূর্ণ আলামত পাওয়া গেছে। মোটিভ কি ছিল সেটা জানার চেষ্টা করছি। খুব শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
জুলহাস মান্নানকে হত্যার ঘটনায় ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি এর নিন্দা জানিয়ে হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
জুলহাসের মা সখিনা খাতুন (৯০) ও বাসার গৃহকর্মী জানান, ৩৫, উত্তর ধানমণ্ডির বাসার দোতলায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন জুলহাস। সন্ধ্যার একটু আগে (সাড়ে ৫টা) পার্সেল আছে বলে কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী পরিচয় দিয়ে কয়েক যুবক এ বাসায় আসে। তারা দারোয়ানকে বলে জুলহাসের নামে পার্সেল আছে। দারোয়ান তাদের দাঁড় করিয়ে রেখে দোতলায় উঠেন। তিনি দরজা নক করার পর ভেতর থেকে দরজা খোলা হয়। এ সময় দারোয়ানের পেছনে আসা তিন যুবক দারোয়ানের মাথায় আঘাত করে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কয়েকজন যুবক ভেতরে ঢুকে জুলহাস ও তনয়ের মাথায় কোপায়। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় যুবকরা।
লেক সার্কাসের আছিয়া নিবাস নামে বাসাটিতে সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা গেছে, দোতলার পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাটের বেড রুমের দরজায় জুলহাসের লাশ পড়ে আছে। তার মাথা থেকে মগজ বেরিয়ে কক্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পুরো বাসা রক্তাক্ত। ভেতরে মেঝেতে পড়ে আছে তনয়ের লাশ। তারও মাথার পেছনের অংশে আঘাত করা হয়েছে। তারও মাথা থেকে মগজ বেরিয়ে গেছে। জুলহাসের পরনে ছিল হাফপ্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি। আর তনয়ের পরনে কালো ফুলপ্যান্ট ও গেঞ্জি। পুলিশ ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলে আলামত সংগ্রহ করছে। ফ্ল্যাটের ভেতর কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। পরে রাত পৌনে ১২টায় পুলিশ লাশ দুটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
জুলহাসের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার নরিংপুর গ্রামে। তার বাবা আবদুল মান্নান উপ-সচিব ছিলেন। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে জুলহাস মেজ। তার বড় ভাই ইমন গুলশানে থাকেন। তার একমাত্র বোন আমেরিকা প্রবাসী। জুলহাসের মা সখিনা খাতুন আগে চাঁদপুরের একটি স্কুলে ও পরে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর স্কুলে শিক্ষিকতা করতেন। জুলহাস ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘রূপবান’-এর সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ম্যাগাজিনটি বাংলাদেশে সমকামীদের মুখপত্র হিসেবে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে প্রকাশনা শুরু করে। এর আগে পত্রিকাটি অনলাইন সংস্করণ ছিল। পহেলা বৈশাখে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে সমকামীদের নিয়ে মিছিল করার চেষ্টা করেন জুলহাস। পরে পুলিশের হাতে আটকও হন। পুলিশ ধারণা করছে, এ কারণেই জুলহাস ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হামলার শিকার হন।
নিহত মাহবুব তনয় ‘পিটিএ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে শিশু নাট্য প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি লোকনাট্য দলের সদস্য। তার বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি।
ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী ও হামলায় আহত মো. পারভেজ যুগান্তরকে জানান, জুলহাস ও তনয় বিকাল ৫টার দিকে অফিস থেকে বাসায় আসেন। সন্ধ্যার আগে ৬ থেকে ৭ জন লোক পার্সেল আছে বলে বাসায় ঢুকতে চায়। তাদের পরনে জিন্সের প্যান্ট ও টিশার্ট ছিল। তিনি তাদের দরজায় দাঁড় করিয়ে দ্বিতীয় তলায় জুলহাসের ফ্ল্যাটে যান। কিন্তু তারা কখন পিছু নিয়েছে সেটা খেয়াল করতে পারেননি। বাসার সামনে গিয়ে দরজা নক করার পর তারা আমার মাথায় আঘাত করে। প্রতিবেশী এক নারী জানান, বিকালে ডাকাত, ডাকাত চিৎকার শুনে ওই বাসায় প্রবেশের চেষ্টা করি। প্রথমে যেতে না পারলেও পরে ঘরে গিয়ে দেখি চারদিকে রক্ত ছড়িয়ে আছে। দুই ব্যক্তিকে পড়ে থাকতে দেখি।
আরেক নারী জানান, ডাকাত ডাকাত চিৎকারের পর ওই বাসা থেকে আনুমানিক ছয়-সাতজনকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখি। তারা উপরের দিকে গুলি করছিল আর ‘আল্লাহু আকবর’ বলে আওয়াজ দিচ্ছিল। তাদের সবার বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তাদের সবার পিঠে স্কুলব্যাগ ছিল। তাদের পরনে ছিল জিন্সের প্যান্ট ও পেস্ট কালার শার্ট। সাধারণত কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি শাখার কর্মীরা ওই ধরনের জামা পরে থাকেন। তাদের তিনজন বাসা থেকে দেড়শ’ গজ দূরে গিয়ে জামা বদলে সাদা শার্টও পরেছে। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে। দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যাওয়ার সময় বাসা থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে তেঁতুলতলা মাঠের কাছে টহল পুলিশ তাদের আটকানোর চেষ্টা করে। এ সময় তারা এএসআই মমতাজ নামে একজনকে কুপিয়ে জখম করে। মমতাজ হামলাকারীদের একজনকে জাপটে ধরে ফেলেন এবং তার কাছ থেকে একটি ব্যাগ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করেন। ওই ব্যাগে খুনিদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। মমতাজকে রাজারবাগ পুলিশলাইন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। উপস্থিত লোকজন জানান, পুলিশ সদস্য কম থাকায় এবং তারা চাপাতি দিয়ে কোপাতে শুরু করায় টহল পুলিশও তাদের আটকাতে পারেনি।
হত্যার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান আওয়ামী লীগ নেত্রী ডা. দীপু মনি, সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, কাউন্টার টেরোরিজম (সিটি) ইউনিটের প্রধান ও ডিআইজি মনিরুল ইসলাম, রমনা জোনের উপ-কমিশনার আবদুল বাতেনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেখানে রমনা জোনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। ইতিপূর্বে ওইসব গ্রুপ একই ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন জুলহাস ও তনয় দু’জনেই সমকামী। হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে সিটি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, এটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আলামত সংগ্রহ করেছি। তদন্ত শেষে এর মোটিভ বলতে পারব। কলাবাগান থানার ওসি ইকবাল হোসেন জানান, ঘটনাস্থল থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একজনকে আটক করা হয়েছে। তার নাম আনোয়ার হোসেন রিংকন। সে স্থানীয় একটি কলেজে এইচএসসি পড়ছে। তাকে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আটক করা হয়েছে। তার কাছ থেকে খুনিদের বিষয়ে বিবরণ নেয়া হয়েছে। রিংকনের মা আনোয়ারা বেগম জানান, আমার ছেলে প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফিরছিল। এ সময় তেঁতুলতলা মাঠের কাছে দুর্বৃত্তদের ধাওয়া করার চেষ্টা করে। এ সময় তারা রিংকনের হাতে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। আমার ছেলে নির্দোষ। পুলিশ আমাকে বলেছে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। স্থানীয় এমপি ফজলে নূর তাপস ঘটনাস্থলে গিয়ে বলেন, একটি নির্দিষ্ট গ্রুপ এ ধরনের টার্গেটেড হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তারা সরকারকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে এটা করেছে।
পার্সেলে ছিল নারকেলের ছোবড়া : যে পার্সেল নিয়ে হামলাকারীরা জুলহাসের বাসায় যায় তার ভেতর ছিল কিছু নারকেলের ছোবড়া ও কাগজ। বক্সটি পুলিশ জব্দ করে তা থেকে হাতের ছাপসহ বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করছে।
ক্লু পেয়েছি : জুলহাস ও তনয় হত্যা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘আমরা কিছু আলামত পেয়েছি, আসামিদের ধরে ফেলতে পারব। এটা ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের কাজ। সমকামীদের নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের ওপর আগে থেকেই হুমকি ছিল। পহেলা বৈশাখের দিন তাকে একটি এসএমএস পাঠিয়ে হুমকি দেয়া হয়। তিনি সেটা পুলিশকে জানিয়েছিলেন। এটা অন্য রকম একটি ঘটনা। দেশ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেশে নানাভাবে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। এসব মোকাবেলায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫:০২:৪৫   ২৮৬ বার পঠিত