বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০১৬
অচলাবস্থা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে
Home Page » জাতীয় » অচলাবস্থা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েজনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, যাকে সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের প্রধান চালিকা শক্তিও বলা হয়। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ মন্ত্রণালয়ে কয়েক মাস ধরে এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে। বিষয়টি দৃশ্যত বোঝা না গেলেও ভেতরের বৈরী পরিবেশ অনেকটা স্পষ্ট। নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি এ মন্ত্রণালয়ের রুটিন কাজ হলেও যতসব বিপত্তি ঘটছে এ বিষয়গুলো নিয়ে। নানা কারণে অনেক সময় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে। এতে করে অনেক সময় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নির্দেশনাও যথাসময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কখনও প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। আবার সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী যে প্রস্তাবনা বা সিদ্ধান্তের পক্ষে অটল থাকতে চাইছেন তা সব সময় ধরে রাখতেও পারছেন না। ওদিকে আগের মতো শক্তভাবে ভূমিকা রাখতে পারছেন না মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে পরিচিত এপিডি উইংয়ের প্রধানও। তবে এত সব প্রতিবন্ধকতার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে যুগান্তরের অনুসন্ধানে বিশেষ একটি সূত্র বেরিয়ে এসেছে। আর তা হল, রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া একজন দাপুটে কর্মকর্তার চরম মাত্রায় ক্ষমতার অপব্যবহার।
ফাইলে স্বাক্ষর করার কোনো এখতিয়ার না থাকলেও অভিযোগ রয়েছে অতি ক্ষমতাধর এই কর্মকর্তার মতামতের ভিত্তিতেই ইদানীং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনেক প্রস্তাব সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়। বিষয়টি অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ায় অনেকে বিব্রত ও ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ। ভুক্তভোগীরা মনে করেন, এই কর্মকর্তার কারণে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। যাকে স্যার বলে সম্বোধন করার কথা তিনি তাকে ভাই কিংবা দাদা বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এহেন অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রশাসনবিষয়ক কলামিস্ট ও সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তার নামের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এটি তার ভাষায় অনেক ক্ষেত্রে সেবাপ্রার্থীদের কাছে জননির্যাতন মন্ত্রণালয়।’ তিনি মনে করেন, ‘দিন দিন এ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কাগজে কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। দৃশ্যত চোখে পড়ার মতো কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এছাড়া রুলস অব বিজনেস অনেক ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না।’ তার মতে, ‘যার যে ক্ষমতা থাকার কথা নয়, তাকে যদি সেই ধরনের ক্ষমতা চর্চার এখতিয়ার দেয়া হয় তাহলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অবস্থা বেহাল তো হবেই।’ তিনি বলেন, ‘মন্ত্রীর এখতিয়ার ও বিধিগত নির্দেশনা বা সিদ্ধান্ত কেউ শুনবে না, আবার তিনি চেয়ারে বহাল থাকবেন এটা হতে পারে? হতে দেয়াও উচিত নয়। এছাড়া বাঁশের চেয়ে কঞ্চি মোটা হওয়াও ঠিক নয়।’
গত বছর জুলাইয়ের মাঝামাঝি দফতর পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে এলজিআরডি মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। আগের মন্ত্রণালয়ের পারফরমেন্স নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও সারাজীবন ক্লিন ইমেজের অধিকারী এ মন্ত্রী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আরও ভালো কিছু করার বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এ মন্ত্রণালয়ের সেবাপ্রার্থীরাও তেমনি আশা করেছিলেন। বিশেষ করে পদোন্নতি বঞ্চিত দাবিদার কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন তারা ন্যায়বিচার পাবেন। নতুন করে পদোন্নতি প্রত্যাশী কর্মকর্তারাও আশাবাদী ছিলেন জনপ্রশাসনে নতুন ধারা চালু হবে। যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতেই পদোন্নতি ও পদায়ন হবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে অনেকের সে প্রত্যাশায় চিড় ধরতে শুরু করে। দেখা গেল, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এসব ক্ষেত্রে তার পুরনো নীতি থেকে তেমন একটা সরে আসেনি। উল্টো কিছুদিন পর ভিন্ন চিত্র দৃশ্যমান হতে শুরু করে।
যুগান্তরের অনুসন্ধান ও নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, একটি চক্র ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ক্ষমতা অপব্যবহারের খক্ষ বসাতে শুরু করে। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া একজন কর্মকর্তার পদ ও ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে চক্রটি ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার সহযোগী হিসেবে যুক্ত হয় বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু চিহ্নিত দল ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। তদবিরবাজ হিসেবে প্রশিক্ষিত ভিন্ন পেশার কয়েকজন চিহ্নিত লোকও নিয়মিত আড্ডার সঙ্গী হিসেবে এ দলে ভিড়ে যায়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কয়েকজন পদস্থ গত কয়েক মাস আগে থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পর্দার আড়ালে এক ধরনের অদেখা বিরোধ আর মনোমালিন্যের পরিবেশ তৈরি হয়। এ পর্যায়ে এপিডি উইংয়ের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে তারা সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। যদিও ওই কর্মকর্তার নিজেরও সেখানে আর থাকার ইচ্ছে ছিল না। এরপর চক্রটি তাদের পছন্দ অনুযায়ী একজন আজ্ঞাবহ কর্মকর্তাকে সেখানে নিয়োগ দেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ অনুযায়ী জানা গেছে, নিয়োগ পাওয়া নতুন কর্মকর্তা একধরনের রাবার স্ট্যাম্প পরিণত হয়েছেন। তার নিজের কোনো স্বাধীনতা কিংবা মতামত নেই বললেই চলে। প্রাইজপোস্টিং ও গুরুত্বপূর্ণ রদবদলের ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে ‘নিয়োগপ্রাপ্ত ক্ষমতাধর কর্মকর্তা’ তাকে যেভাবে প্রস্তাব দেন তিনি সেভাবে ফাইল উত্থাপন করেন। আর এসব তদবির সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব যখন সচিব আটকে দেন বা দ্বিমত পোষণ করেন তখনই ঘটে বিপত্তি, যা হয়ে আসছে কিছুদিন থেকে।
এ প্রসঙ্গে এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ইতিমধ্যে এভাবে অনেক মোটা অংকের তদবিরের নিয়োগ বদলি আটকে গেলে ভেতরে ভেতরে চাপা ক্ষোভ আর দ্বন্দ্ব ভিন্নমাত্রায় রূপ নেয়। অবশ্য এর মধ্যে সচিব এক সপ্তাহ বিদেশ থাকার সময় আটকে থাকা অনেক তদবিরের ফাইল জাদুর কাঠির বলে নিষ্পত্তিও হয়ে যায়। তিনি বলেন, অতীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের কোনো নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। সচিব যখন বিদেশে থাকেন তখন শুধু জরুরি রুটিনওয়ার্ক করা হয়। বিশেষ করে সচিব কোনো বিষয়ে আপত্তি দিয়ে থাকলে তার অনুপস্থিতিতে সচিবের দায়িত্বে থাকা কেউ তা অনুমোদন করেন না। কিন্তু এই প্রথম তাও হয়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, এখন তো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো কিছু গোপন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব, সিদ্ধান্ত, সারসংক্ষেপ সবই মুহূর্তেই জানাজানি হয়ে যায়। যেটি অতীতে কখনও ঘটেনি।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, এসব অভিযোগ কিংবা অনুযোগের কথা হয়তো খাতাকলমে কোনোদিন প্রমাণ করা যাবে না। কিন্তু সরকারের নিশ্চয় চৌকস গোয়েন্দা সংস্থা আছে। আছে বিশ্বস্ত নানা সোর্স। তিনি মনে করেন, নির্মহভাবে অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত করলে পর্দার আড়ালে থাকা এসব অনাচারের প্রমাণ অবশ্যই মিলবে।
বিক্ষুব্ধ অপর এক কর্মকর্তা বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়। ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যদি গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে পোস্টিং দেয়া হয় তাহলে সরকারের ঘাড়ে বদনামের বোঝা বাড়বে। কাজের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। আর এ সুযোগে অনৈতিক উপায়ে সরকারবিরোধী কর্মকর্তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছেও। ইতিমধ্যে এ সারির অনেকে পোস্টিংও পেয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, বৈরী পরিবেশের কারণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কেউ কেউ এখন আর এখানে থাকতে চান না। যাদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়তি বিল-ভাউচার নিয়েও অতিষ্ঠ। নিয়মবহির্ভূতভাবে গাড়ি সেবা দেয়ার বিষয় তো আছেই।
জানা গেছে, এখানে এক প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে দ্রুত বদলি করে দেয়ার ক্ষেত্রে নতুন ক্ষোভ-অসন্তোষ ছাড়াও পুরনো একটি ক্ষোভও বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছে। ওই কর্মকর্তার স্ত্রী এর আগে যে মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন সেখানে বিধিবহির্ভূতভাবে একটি গাড়ি কেনার ফাইল আটকে দিয়েছিলেন। যদিও এভাবে প্রতিবাদ করে তিনিও সেখানে বেশি দিন থাকতে পারেননি। এছাড়া তার স্বামীর প্রতি ব্যাচমেটদের পদোন্নতি বঞ্চিত করাসহ কিছু জুনিয়র কর্মকর্তাকে হেনস্থা করার অভিযোগও বেশ চাউর ছিল। তারাও এ সুযোগে একহাত নিতে মরিয়া। যে কারণে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার পদে তার নিয়োগ পাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। অবশ্য এ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এখন যেখানে আছেন খুব ভালো আছেন। এর চেয়ে বেশি ভালো থাকতে চান না। তিনি দাবি করেন, নিজে থেকেই ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার পদে পোস্টিং নিতে চাননি। বরং তার যেসব বন্ধু চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত তারাও হতে পারেননি।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পর্দার আড়ালে থাকা প্রভাবশালী চক্রটি ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার অব্যাহত রাখায় শিগগিরই এখানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পর্যায়ে রদবদলও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। সূত্র জানায়, এখন যাকে ঘিরে এত বিরোধ তিনিও আর এভাবে এ মন্ত্রণালয়ে থাকতে চান না। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তার অর্জনও কম হয়নি। যদিও এ মন্ত্রণালয়ে আসার পর তার বিরুদ্ধে নানা কথা ছড়িয়েছে। ব্যাচমেট থেকে শুরু করে জুনিয়র কর্মকর্তাদের অনেকে তার কাছ থেকে অতীতের মতো ভালো আচরণ পাননি বলে হাজারও অভিযোগ আছে। বিশেষ করে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের ক্ষোভ-অসন্তোষের শেষ নেই।
প্রশাসনের তিন স্তরে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে গত ডিসেম্বরে উদ্যোগ নেয়া হলেও তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। দু’মাস আগে এসএসবি (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) সুপারিশ চূড়ান্ত করলেও এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়নি। এ নিয়ে ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের ক্ষোভ-অসন্তোষ এখন বিক্ষোভে রূপ নেয়ার পথে। বিশেষ করে এ তালিকায় সরকারপন্থী বেশকিছু কর্মকর্তা থাকায় নানামুখী চাপও বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এসএসবির কার্যবিবরণী স্বাক্ষর হয়ে থাকলে তা নিয়ে এভাবে কালক্ষেপণ করা সমীচীন হবে না। দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।
সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, তিনি এসএসবিকে মনে করেন আইএসএসবি। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত এ বোর্ড এ পর্যন্ত বহু যোগ্য কর্মকর্তার প্রাপ্য পদোন্নতি কেড়ে নিয়েছে। দফায় দফায় পদোন্নতিবঞ্চিত করেছে। তার কাছে এ বিষয়ে অনেক প্রমাণ আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩০:৪৪ ৩০৬ বার পঠিত