বুধবার, ২০ এপ্রিল ২০১৬

শফিক রেহমানের বাসায় তল্লাশি

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » শফিক রেহমানের বাসায় তল্লাশি
বুধবার, ২০ এপ্রিল ২০১৬



অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনা মামলায় রিমান্ডে থাকা সাংবাদিক শফিক রেহমানের ইস্কাটনের বাসা থেকে সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কিত ‘এফবিআইয়ের নথি’ জব্দ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। ৫ দিনের পুলিশ রিমান্ডে থাকা শফিক রেহমানকে নিয়ে মঙ্গলবার গোয়েন্দারা তার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে এসব নথি জব্দ করেন। আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর ওই নথিতে প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের যুক্তরাষ্ট্রের বাসার ঠিকানা, গাড়ির নম্বরসহ বেশ কিছু গোপন তথ্য রয়েছে।
অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনা মামলার তদারককারী কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ যুগান্তরকে বলেন, এফবিআইর কাছ থেকে পাওয়া এসব তথ্য এতদিন শফিক রেহমান নিজের সংরক্ষণে রেখেছিলেন। রিমান্ডে স্বীকার করার পর তাকে নিয়ে ওই বাসায় গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ নথি জব্দ করা হয়েছে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, এফবিআই এজেন্ট রবার্ট লাস্টিকের কাছ থেকে এ নথিপত্রগুলো জোগাড় করেছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন শফিক রেহমান।
বাসা তল্লাশির পর গোয়েন্দারা চলে গেলে শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রেহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, গোয়েন্দা পুলিশের বেশ কিছু সদস্য বাসায় এসে কিছু কাগজপত্র নিয়ে গেছেন। এ সময় স্বামী শফিক রেহমানের সঙ্গে তাকে (তালেয়া রেহমান) কিছু সময় কথা বলতে দেয়া হয়েছে। তার স্বামী ষড়যন্ত্রের স্বীকার দাবি করে তিনি বলেন, হত্যার মতো কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তার স্বামী জড়িত থাকতে পারেন- এমন কথা তিনি বিশ্বাস করেন না।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনার একাধিক বৈঠকে সাংবাদিক শফিক রেহমান উপস্থিত ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। মূলত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তার (শফিক রেহমান) দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধু চট্টগ্রামের বাসিন্দা মিল্টন ভূঁইয়ার মাধ্যমে এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়। মিল্টন ভূঁইয়া তাকে পরিচয় করিয়ে দেন জাসাসের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের ছেলে রিজভী আহমেদ সিজারের সঙ্গে। দীর্ঘদিন অবস্থানের সুবাদে মিল্টন ও সিজারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর সাবেক স্পেশাল এজেন্ট রবার্ট লাস্টিক তার বন্ধু জোহান্স থ্যালারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আর এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বাসার ঠিকানা, গাড়ির নম্বর ও কখন কোথায় যান তার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এফবিআইর ওই সদস্য আর তার বন্ধুকে। এজন্য তাদের সঙ্গে মোটা অংকের টাকার চুক্তিও হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে সজীব ওয়াজেদ জয়ের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাবিষয়ক তথ্য সংগ্রহের পরই তাকে সুবিধামতো সময়ে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
অতিরিক্ত কমিশনার আরও বলেন, যেহেতু অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্র হয় যুক্তরাষ্ট্রে তাই খুব শিগগিরই গোয়েন্দা পুলিশের তিন সদস্যের একটি দল সেখানে পাঠানো হবে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে এবং ওই তিন কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে সরকারের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, শফিক রেহমান যে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তার দালিলিক প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। এছাড়া ওই সময় সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে আমার দেশ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ফেডেক্স কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন বলেও তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। এসব তথ্য এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে পাওয়া গেলে দু’জনকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ২০১২ সালে আমেরিকায় যড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন শফিক রেহমান। এসব বৈঠকে জাসাস নেতা মোহাম্মদ উল্লাহ মামুন, তার ছেলে সিজার, মিল্টন ভূঁইয়া ছাড়াও বিএনপির আরও কয়েকজন নেতা ও তিন বিদেশী অংশ নেন। এর একটি বৈঠকে এফবিআইর সাবেক স্পেশাল এজেন্ট রবার্ট লাস্টিক তার বন্ধু জোহান্স থ্যালারকে জয় সম্পর্কে তথ্য দেয়ার জন্য মোটা অংকের অর্থ দেয়ার প্রলোভন দেয়া হয়। যার মধ্যে ৩০ হাজার ডলার ওই দু’জনকে অগ্রিম দেয়া হয়।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হত্যার পরিকল্পনাকারীরা অর্থের বিনিময়ে জয়ের বাসার ঠিকানা, গাড়ি, গাড়ির মডেল ও নম্বর সংগ্রহ করেন। জয় সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ওই সময়ে আমেরিকা থেকে ফেডেক্স কুরিয়ারের মাধ্যমে মাহমুদুর রহমানকে পাঠানো হয় বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ ওইসব নথি ইতিমধ্যেই হাতে পেয়েছে। ষড়যন্ত্রে মাহমুদুর রহমানের সম্পৃক্ততা ছিল বলেই এ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানোর আবেদন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
মনিরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি টের পেয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। পরে এ ঘটনায় রিজভী আহমেদ সিজার, এফবিআইর সাবেক স্পেশাল এজেন্ট রবার্ট লাস্টিক, তার বন্ধু জোহান্স থ্যালারকে গ্রেফতার করে সেখানকার পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্রে জয় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে ইতিমধ্যেই তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। পরে সেখানকার আদালত রিজভী আহমেদ এবং জোহান্স থ্যালরকে যথাক্রমে ৪২ মাস ও ৩০ মাসের সাজা দেন। তাদের আরও ২ বছর নজরদারিতে রাখারও নির্দেশনা দেন আদালত। লাস্টিক অন্য ঘটনায় গ্রেফতার হয়ে আটক হয়েছেন। এ বিষয়ে জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের প্রেস রিলিজে প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনায় রিজভী আহমেদ সিজারের কাছ থেকে লাস্টিক ও থ্যালার মোটা অংকের ইউএস ডলার গ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মনিরুল ইসলাম আরও জানান, সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তদন্তে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তাদের বিষয়ে প্রতিবেদনও হয়েছে। ওই প্রতিবেদন তারা বাংলাদেশকেও দিয়েছে। সেখানে শফিক রেহমানের নাম রয়েছে। তাই তার সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট। শফিক রেহমানের জড়িত থাকার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তেই এসেছে। এসব তথ্য-প্রমাণ আনতে গোয়েন্দা পুলিশের তিন কর্মকর্তাকে খুব শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে বলে তিনি জানান।
এদিকে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের ঘটনায় মামলায় আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সোমবার ঢাকা মহানগর হাকিম গোলাম নবীর আদালতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিনিয়র সহকারী কমিশনার হাসান আরাফাত এ আবেদন জানান। আদালত মাহমুদুর রহমানকে ওই মামলায় গ্রেফতার ও রিমান্ড বিষয়ে শুনানির জন্য ২৫ এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন। ওই দিন মাহমুদুর রহমানকে হাজির করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনাল টিমের ইন্সপেক্টর মো. ফজলুর রহমান ১৮৬০ সালের পেনাল কোড আইনের ১২০-বি ধারায় (পরস্পর যোগসাজশে অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্র) একটি মামলা করেন। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে করা ওই মামলার কাগজপত্রের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি অনুমতিপত্রও তিনি থানায় জমা দেন। এর আগে ঘটনার পরপরই রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে পুলিশ। ওই মামলায় শনিবার সকালে ইস্কাটনের নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার হন সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমান। ওই দিনই তাকে আদালতে হাজির করে গোয়েন্দা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়।
তিন সংস্থার নিন্দা : এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস ও ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনেস্ট টর্চার যুক্ত বিবৃতিতে শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়েছে। তার নিঃশর্ত মুক্তি কামনা করে তারা লিখেছে, পরিকল্পিতভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনের সর্বশেষ শিকার তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:৫০:২৪   ৪২৮ বার পঠিত