রবিবার, ২৭ মার্চ ২০১৬

বুয়েটের জয়জয়কার

Home Page » শিক্ষাঙ্গন » বুয়েটের জয়জয়কার
রবিবার, ২৭ মার্চ ২০১৬



বঙ্গনিউজ ডটকমঃ বাংলাদেশের মানুষ তখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বুঁদ হয়ে আছে। দেশের নাম উজ্জ্বল করতে আমাদের ক্রিকেটাররা যখন ভিন দেশের মাঠে জান দিয়ে খেলছেন, তখন একই লক্ষ্য নিয়ে লড়ছিলেন আরও একদল তরুণ। তাঁদের লড়াই অবশ্য ক্রিকেটের নয়-মেধার, উদ্ভাবনী ক্ষমতার। এ মাসেই বসেছিল দুটি বড় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আসর। চীনে ‘সিগন্যাল প্রসেসিং কাপ’ ও ভারতে ‘অ্যাজিওট্রপি’। দুটি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র একেবারে ভিন্ন। কিন্তু দুই আসরেই বাজিমাত করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। 616fdb1b4848a4fd2a9a34009a3afc8e-4.jpgসিগন্যাল প্রসেসিং কাপ ২০১৬

এই প্রতিযোগিতায় স্নাতকপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ইলেকট্রনিক সংকেত প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। প্রতিবছর এই আয়োজন করে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আই ট্রিপল-ই। এ বছর বিশ্বের ২৮টি দেশের ৫২টি দলকে পেছনে ফেলে সেরা তিনে জায়গা পায় বুয়েটের ‘টিম রেজোন্যান্স’। মূল পর্বে অংশ নিতে টিম রেজোন্যান্স যখন চীনের সাংহাইয়ে পা রেখেছে, শহরটির তাপমাত্রা তখন ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ রোমাঞ্চের উত্তাপে দলের সদস্যরা যেন শুরু থেকেই ঘামছিলেন! দিন শেষে তাঁদের চেষ্টা বৃথা যায়নি। মঞ্চে ঘোষণা হয়েছে চ্যাম্পিয়ন দলের নাম-‘টিম রেজোন্যান্স ফ্রম বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি!’
টিম রেজোন্যান্সের সদস্য মুনিফ ইশাদ মুজিব, রাকিব হায়দার, সাঈদ সাফায়েত, মো. তৌহিদুজ্জামান খান, আশরাফুল আশিক, উদয় সাহা, জয়ন্ত দে, রাতুল খান ও বিল্লাল হোসেন-সবাই তড়িৎকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। তাঁদের সঙ্গে সুপারভাইজার হিসেবে ছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. আরিফুল হক। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল নামকরা দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে-যুক্তরাষ্ট্রের পারডু ইউনিভার্সিটি ও ভারতের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।
এই প্রতিবেদন যখন লিখছি, বুয়েটের দলটা তখনো সাংহাইয়ে। মুঠোফোনে তাঁদের সঙ্গে কথা হলো। জানতে চাইলাম, ‘কী ছিল এবারের চ্যালেঞ্জ?’ দলের সদস্য তৌহিদুজ্জামান বললেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একটি ঘটনার ভিডিও বা অডিও রেকর্ডিং পাওয়া যায়, কিন্তু তার উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। ক্যামেরা বা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা শব্দের মধ্যে চারপাশের বৈদ্যুতিক গ্রিডের একটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা চিহ্ন রয়ে যায়। আমাদের বলা হয়েছিল, এই সংকেত বা সিগন্যাল থেকে ভিডিও চিত্র কিংবা অডিও ক্লিপের উৎসস্থল খুঁজে বের করতে হবে।’ ব্যাপারটা তিনি আরও একটু বুঝিয়ে বলেন, ‘ধরা যাক, কাউকে কিডন্যাপ করে রাখা হয়েছে। মুক্তিপণ দাবি করে যদি অডিও বা ভিডিও পাঠানো হয়, এই পদ্ধতিতে রেকর্ডিংয়ের জায়গা, সময় ইত্যাদি বের করা সম্ভব হবে। আমরা এটা করে দেখিয়েছি।’ শুধু তা-ই নয়, টিম রেজোন্যান্সের দাবি, তাদের বানানো প্রক্রিয়ায় কাজটি সম্পন্ন হবে মাত্র পাঁচ থেকে সাত সেকেন্ডে!
২৩ মার্চ চীনের সাংহাইতে অনুষ্ঠিত ‘৪১তম আই ট্রিপল-ই ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন অ্যাকুয়েস্টিক, স্পিচ অ্যান্ড সিগন্যাল প্রসেসিং (আইসিএএসএসপি) ২০১৬’ শীর্ষক কনফারেন্স শেষে সার্টিফিকেট এবং সম্মাননা তুলে দেওয়া হয় বিজয়ীদের হাতে। পুরস্কার হিসেবে টিম রেজোন্যান্স জিতেছে প্রায় পাঁচ হাজার ডলার! দলের সদস্য সাইদ সাফায়েত বললেন, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করা খুবই কঠিন। তবু একটা দল হয়ে কাজ করেছিলাম বলেই আমাদের জন্য সহজ হয়েছে।’
এই শিক্ষার্থীরাই অংশ নিয়েছিলেন অ্যাজিওট্রপিতেঅ্যাজিওট্রপি ২০১৬
ভারতের আইআইটির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন ১২ ও ১৩ মার্চ আয়োজন করেছিল বার্ষিক সিম্পোজিয়াম-অ্যাজিওট্রপি ২০১৬। সেখানেও বাজিমাত বুয়েটের। এই প্রতিযোগিতা মূলত কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য। বিভাগের তোয়াক্কা না করে হবু প্রকৌশলীরা ঠিকই ফিরেছেন ‘সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের’ খেতাব নিয়ে।
অ্যাজিওট্রপি এককথায় এই উপমহাদেশের কেমিকৌশলের শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। একই ছাদের তলায় হবু কেমিকৌশলীদের দক্ষতার পরীক্ষা হয়ে যায়। ভারতের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের তিন শতাধিক দল অংশ নেয় এবারের সিম্পোজিয়ামে। সঙ্গে ছিল ১০টি করপোরেট হাউস এবং অর্ধশত ইন্ডাস্ট্রির অংশগ্রহণ। দেশে ফেরার পর কথা হলো বুয়েটের অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে।
বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতার মধ্যে চারটিতে অংশ নিয়েছিলেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। সব কটিতেই এসেছে সাফল্য। একটি চ্যালেঞ্জের নাম ‘ল্যামিনিয়ার’। অংশ নেওয়া দলটির সদস্যরা হলেন কাজী জিহান হোসেন, সৈয়দ তারিক-উল ইসলাম, আবদুল্লাহ আল মাসুদ ও প্রমা প্রদীপ্তি। তারিক জানালেন, ‘কৃত্রিমভাবে তৈরি ঝর্ণা বা ফোয়ারার পানি যখন কোনো পাম্পের মাধ্যমে জোরে ছুড়ে দেওয়া হয়, তখন পানির প্রবাহকে কতটা দৃষ্টিনন্দন করা যায়, তা-ই ছিল এই প্রতিযোগিতার শর্ত।’ ৪৫টি দলের মধ্য তৃতীয় স্থান পেয়েছে বুয়েট।
আরেকটি প্রতিযোগিতার নামটা মজার। কেম-ই-কার! শর্ত হলো নিজেদের তৈরি ব্যাটারি দিয়ে চালাতে হবে পরিবেশবান্ধব গাড়ি। নির্দিষ্ট দূরত্বের পর সেই গাড়ি থামাতেও হবে রসায়নের জটিল বিক্রিয়ার মাধ্যমে। তা-ও কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সাহায্য ছাড়াই! এত শর্তেও পিছপা হননি বুয়েটের কাজী জিহান হোসেন, আবদুল্লাহ আল মাসুদ, মাজেদ আলম ও নাফিসা তাসনিমের দল। নাফিসা জানালেন, ‘অনলাইনে নিজেদের গাড়ির বর্ণনা লিখে ৮০টির বেশি দল আবেদন করেছিল। সেখান থেকে চূড়ান্ত পর্বে সুযোগ পাওয়া ৩০টি দলের মধ্যে আমরা তৃতীয় হয়েছি।’
‘কেম-ই-টাইমার’ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে তাসনিম আহমাদুল্লাহ, সৈয়দ তারিক-উল ইসলাম, আতিকুর রহমান ও তাসনিম তাবাসসুম অনুর দল। এখানেও ছিল রসায়নের কঠিন সব ধাঁধা। এ ছাড়া ছিল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতা ‘কিউ-ভিজ-ইট’। সেখানে পুরস্কৃত সেরা পাঁচের মধ্যে বুয়েটের জিহান চতুর্থ এবং তারিক পঞ্চম স্থান দখল করে নেন। জিহান বলেন, ‘প্রতিযোগিতায় আমাদের প্রথম ৪০ জনকে নামকরা কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি বিএএসএফের ভারত অঞ্চলের মাদারপ্ল্যান্টে ভিজিট করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটা অনেক বড় পাওয়া।’ স্বপ্নের মতোই কেটেছে এই তরুণদের মুম্বাই ভ্রমণ। প্রথমবার অংশ নিয়েই অ্যাজিওট্রপিতে এতগুলো পুরস্কার বুয়েটের ঝুলিতে! তাই আয়োজকেরা বুয়েটকে দিয়েছে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননা।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:৫৯:৪৮   ৩৯৩ বার পঠিত