রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৬

সুন্দরবনকে রেহাই দিচ্ছেন না জাহাজ–মালিকেরা

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » সুন্দরবনকে রেহাই দিচ্ছেন না জাহাজ–মালিকেরা
রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৬



শেলা নদী দিয়ে এখনো অবাধে জাহাজ চলছে। গত শনিবার জয়মণি প্রান্ত থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলোশেলা নদী দিয়ে এখনো অবাধে জাহাজ চলছে। গত শনিবার জয়মণি প্রান্ত থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলোবঙ্গনিউজ ডটকমঃসুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এখনো জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শেলা নদী দিয়ে গড়ে ৫০টি জাহাজ চলাচল করছে বলে বন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। মংলা বন্দর এলাকার অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলেও এমন হিসাবই পাওয়া গেছে।

‘রাতে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল করলে বন্য প্রাণী চলাচল বিঘ্নিত হয়। এ ছাড়া রাতে নৌযান চলাচল করলে অবৈধ কাজ সংগঠনের সুযোগ থেকে যায়।’ এই উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ১৩ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পক্ষ থেকে বাগেরহাটের রামপালের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। ওই চিঠির পর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে শেলা নদীর বিকল্প হিসেবে ১৪০ কোটি টাকা খরচ করে ঘষিয়াখালী খাল খনন করা হয়। ওই পথ দিয়ে জাহাজ চলাচলও শুরু হয়েছে। কিন্তু সুন্দরবনকে রেহাই দিচ্ছেন না জাহাজের মালিকেরা।

জানতে চাইলে খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘষিয়াখালী চ্যানেল পুরোপুরি চালু হয়নি। ১০ ফুট গভীরতার (ড্রাফট) জাহাজ এ চ্যানেল দিয়ে চলাচল করতে হলে পূর্ণ জোয়ারের অপেক্ষা করতে হয়। পূর্ণ জোয়ার থাকে মাত্র দুই ঘণ্টা। আর বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নৌযানের অধিকাংশই ১০ ফুট গভীরতার (ড্রাফট) বেশি। ফলে মংলা বন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য পৌঁছাতে আমাদের শেলা নদী ব্যবহার করতে হচ্ছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাঘ-হরিণ ও সাপের যেমন বাঁচতে হবে, তেমনি মানুষকেও বাঁচতে হবে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যেসব জাহাজ চলছে, সেগুলো মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা চাইলেই দ্রুত সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যান চলাচল একদম বন্ধ করে দিতে পারি না। মংলা-ঘষিয়াখালী খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে, সামনে পর্যায়ক্রমে সব জাহাজ ঘষিয়াখালী খাল দিয়ে চলবে।’

তবে গত বছরের ৬ জানুয়ারি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, (গত) ডিসেম্বর থেকে ঘষিয়াখালী খাল দিয়ে সব জাহাজ চলবে। জরুরি প্রয়োজনে বড় জাহাজ শেলা নদী দিয়ে যেতে হলে কোস্টগার্ডের তত্ত্বাবধানে যেতে হবে। কিন্তু ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত যে উপেক্ষিতে হচ্ছে, তা বনমন্ত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্ট। বন বিভাগও চিঠি দিয়ে বিষয়টি অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) চিঠি দিয়েছে।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সরেজমিনে শেলা নদীর জয়মনির ঘোল এলাকায় অবস্থান করে মোট তিনটি জাহাজকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যেতে দেখা গেছে। জয়মনির ঘোল এলাকার বাসিন্দা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইউসুফ শেখ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা প্রতি রাতে ৮ থেকে ১০টি জাহাজ ওই পথ দিয়ে যেতে দেখেন।

২০১১ সালে বিআইডব্লিউটিএ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়। এরপর থেকে ওই পথে তিনটি বড় জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনের ভেতর সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার ঘটনা সারা বিশ্বে উদ্বেগের জন্ম দেয়। কারণ ওই দুর্ঘটনার পর পূর্ব সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়ে। সুন্দরবন ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। বন বিভাগ ও জাতিসংঘ যৌথ সমীক্ষা করে বলেছিল, তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে সুন্দরবনের জলজ জীববৈচিত্র্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। তারা বনের ভেতর দিয়ে নৌপথ বন্ধের সুপারিশ করে। কিন্তু পথটি বন্ধ হয়নি। বরং পরে ওই পথে একটি সার এবং একটি কয়লা ও ছাইবাহী জাহাজ ডোবার ঘটনা ঘটে।

রাশিয়ার কাজেন ফেডারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক কে এম এম রহমান ও এইচ বাউটিসিয়া ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ার ফলে গত এক বছরে সুন্দরবনে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা নিয়ে গবেষণা করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ জার্নালে গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়ায় ডলফিন ও ভোঁদড়ের প্রজনন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া তেল ছড়িয়ে পড়ার পর সুন্দরবনে সাদা ইগলের সংখ্যা কমে যেতে দেখা গেছে। ফার্নেস তেলের মধ্যে যেকোনো প্রাণীর জন্য ক্ষতিকারক মাত্রায় বিষাক্ত দ্রব্য থাকে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই তেল বনের ঘাস, জলজ উদ্ভিদকণা, প্রাণী ও প্রাণীদের জীবনচক্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বন বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ চালু হওয়ার পর বন্য প্রাণী শিকার ও পাচার বেড়ে গেছে। তাদের হিসাবে গত ১৬ বছরে চোরা শিকারিরা ৫২টি বাঘ হত্যা করেছেন। এর মধ্যে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ চালু হওয়ার পর গত দুই বছরে শিকার হওয়া ১০টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বন্য প্রাণী গবেষকদের আশঙ্কা, শিকার হওয়া বাঘের এই সংখ্যা আরও বেশি।

জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধে আমরা একাধিকবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছি। সুন্দরবন রক্ষায় আমাদের সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিএমডব্লিউর উচিত এর প্রতি সম্মান দেখানো।’

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মংলা-ঘষিয়াখালী খাল উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর এ পর্যন্ত ১ হাজার ২৩০টি জাহাজ ওই পথ দিয়ে চলাচল করেছে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল না করতে আমরা জাহাজমালিকদের চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু তারপরও তারা যদি নির্দেশ ভঙ্গ করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশের উপকূলীয় নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা কোস্টগার্ড পশ্চিমাঞ্চলের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেলা নদী বন্ধ করে শুধু মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলে নৌযান চলাচল করবে এমন কোন নির্দেশনা সরকারের কাছ থেকে আমরা পাইনি। সরকারের আগের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা রাতে নৌযান চলাচল বন্ধ রেখেছি। আমাদের নিয়মিত টহল দল কার্গোর ফিটনেস, চালক নিজে নৌযান চালাচ্ছে কি-না, অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন করছে কি-না—এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে থাকে।’

এ ব্যাপারে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কোনোভাবেই জাহাজ চলাচল করতে দেওয়া উচিত হচ্ছে না। এটা মারাত্মক ভুল কাজ হচ্ছে। সরকারের উচিত এখনই শেলা নদী দিয়ে নৌপথ বন্ধ করে দেওয়া।

বাংলাদেশ সময়: ১১:০৫:০৬   ২৮৪ বার পঠিত