মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৬

বিদ্যুতের দাম না কমিয়ে উল্টো বাড়ানোর প্রস্তাব

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » বিদ্যুতের দাম না কমিয়ে উল্টো বাড়ানোর প্রস্তাব
মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৬



বঙ্গনিউজ ডটকমঃ জ্বালানি তেলের দাম কমায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও কমেছে। কিন্তু বিদ্যুতের দাম না কমিয়ে উল্টো বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ গত বছর প্রতি ইউনিট (১ কিলোওয়াট) ছিল ৬ টাকা ২৭ পয়সা। এ বছর তা কমে ৫ টাকা ৮০ পয়সা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত জ্বালানি (ফার্নেস) তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হলে খরচ আরও কমবে।

এই অবস্থায় আরও একবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও বিতরণ কোম্পানিগুলো এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এর মধ্যে পিডিবি বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রির জন্য বিদ্যুতের পাইকারি দাম ২৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। গত পাঁচ বছরে ছয়বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। সর্বশেষ বাড়ানো হয়েছে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় না করার কোনো যুক্তি নেই। সরকার ফার্নেস তেলের দাম সমন্বয় করে বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে দেশের প্রায় সব মানুষ উপকৃত হবে।

বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য আমদানি করা কোনো পণ্যের দামই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কমে না। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে কালক্ষেপণ ছাড়াই দেশে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। আটা-ময়দা থেকে ভোজ্যতেল কিংবা জ্বালানি তেল—সব পণ্যের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য।

জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি হোসেন খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৃথিবীর সব জায়গাতেই এখন জ্বালানির দাম কম। তাই কিছুটা হলেও বিদ্যুতের দাম কমানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু সরকার আবারও একই ভুল করতে যাচ্ছে। এতে করে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং সক্ষমতা কমছে। এমনটি হলে অন্য প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে টিকতে পারব কি না সন্দেহ আছে।’

হোসেন খালেদ আরও বলেন, ‘সরকারের উচিত ব্যবসা করার খরচ বৃদ্ধির ক্ষেত্রগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো বন্ধ করা। শুধু বিদ্যুতের সিস্টেম লস বন্ধ করলেই অনেকটা সমাধান হয়ে যেত। গ্যাস-বিদ্যুতের এত এত চোরাই সংযোগ, এগুলো থামানো হচ্ছে না কেন? আমরা যারা নিয়মিত বিল দিচ্ছি, তাদের ঘাড়েই কেন বাড়তি দাম চাপানো হচ্ছে?’ বিদ্যুৎ কীভাবে সাশ্রয়ী করা যায়, সরকারের সেই চিন্তা করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গত দেড় বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে ৮০ শতাংশের বেশি। কিন্তু দেশে এখন পর্যন্ত কমানো হয়নি। এমনকি সরকার কমানোর কথা ভাবছেও না। ফলে দাম কমার সুবিধা থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রতি লিটার অকটেনের উৎপাদন খরচ ৫০ টাকারও কম। সরকার বিক্রি করছে ৯৯ টাকা। পেট্রলের উৎপাদন ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যেও ব্যবধান প্রায় একই রকম।

সরকার দেশে ডিজেল বিক্রি করছে ৬৮ টাকা লিটার। অথচ ডিজেলের আমদানি মূল্য পড়ছে প্রতি লিটার ৪০ টাকার কম। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস তেল সরকার বিক্রি করছে প্রতি লিটার ৬২ টাকা। ক্রয়মূল্য বর্তমানে ২৫ টাকার মতো।

গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের মে থেকে ২০১৫ সালের মে পর্যন্ত সময়ে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশে কমেছে ৬ শতাংশ। বিশ্ববাজারে দাম ১০ টাকা কমলে দেশে কমে ১ টাকা ১০ পয়সা।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য এবার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাতে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ; ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ৮ দশমিক ৮৬; পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ১০ দশমিক ৭৬ এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর কথা বলেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, পিডিবি এবং বিইআরসির নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে বিইআরসির সদস্য সেলিম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবগুলো নিয়ে কমিশনের কর্মকর্তারা কাজ করছেন।

পিডিবির সূত্র জানায়, ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কয়েকটিতে মালিকদের সরাসরি আমদানি করা জ্বালানি ব্যবহৃত হওয়ায় উৎপাদন খরচ কমেছে। তাঁরা তেল ব্যবহার করছেন আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী আমদানি করে। তাতে বর্তমানে প্রতি লিটার ফার্নেস তেলের দাম পড়ছে ২৫ টাকার মতো। আর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ছয় টাকারও কম।

ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক অন্য কেন্দ্রগুলো ব্যবহার করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সরবরাহ করা জ্বালানি। তার আমদানি মূল্য কম হলেও বিপিসি বিক্রি করছে সরকার নির্ধারিত দামে, প্রতি লিটার ৬২ টাকা দরে। এই কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করা জ্বালানির দামও আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করা হলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ আরও কমত। ফলে দাম বাড়ানোর দরকার হতো না। সরকারেরও কোনো ক্ষতি হতো না।

মন্ত্রণালয় ও পিডিবির সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি (ফার্নেস) তেলের দাম সমন্বয় করার জন্য তারা সরকারের উচ্চপর্যায়ে একাধিকবার যোগাযোগ করেছে। কারণ, জ্বালানির দাম সমন্বয় না করায় বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি মাসে বাড়তি যে টাকা দরকার হয়, তার সংস্থান করা পিডিবির জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই টাকা নিয়মিত কিংবা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনের সময় পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তাও নেই।

সরকার ইতিমধ্যে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ১১টি বিদ্যুৎ কোম্পানিকে তাদের নিজ নিজ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি তেল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট। বেসরকারি এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে সামিট পাওয়ার লিমিটেড।

জানতে চাইলে সামিট গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি মুহম্মদ লতিফ খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সর্বশেষ জ্বালানি তেল (ফার্নেস) আমদানি করেছেন প্রতি লিটার ২৫ টাকারও কম দামে। ফলে তাঁদের উৎপাদিত প্রতি ইউনিট (১ কিলোওয়াট) বিদ্যুতের দাম পড়ছে ছয় টাকার কম। তাঁরা এখন সরকারের কাছে ওই দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করছেন।

অন্যদিকে যে কোম্পানিগুলো নিজেরা তেল আমদানি করছে না, তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকার নির্ধারিত দামে জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে বিপিসি। অর্থাৎ প্রতি লিটার ৬২ টাকা দরে। ফলে তাদের উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে প্রায় ১৫ টাকা।

এভাবে সরকার কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত জ্বালানি তেল বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা করছে। অন্যদিকে ওই কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ বেশি দামে কেনার জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও পিডিবির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরবরাহ করা জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী নির্ধারণ করে দিলে এভাবে এক হাতে মুনাফা এবং আরেক হাতে ভর্তুকি দেওয়ার অর্থহীন কসরত করার কোনো দরকার হতো না। এতে সরকারের তেমন কোনো লাভ কিংবা ক্ষতিও হতো না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের দাম সমন্বয় না হওয়ায় পিডিবিকে এখনো বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। এই টাকা শেষ পর্যন্ত সরকারকেই ভর্তুকি দিতে হবে। তবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এটি তাঁর মন্ত্রণালয়ের একক সিদ্ধান্তের বিষয় নয়।

পিডিবির সূত্র জানায়, গত বছর বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভর্তুকি (নাকি ঋণ?) দিয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ভাড়াভিত্তিক কয়েকটি কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম দামে (প্রতি ইউনিট ছয় টাকারও কম) পাওয়ায় এ বছর ভর্তুকির পরিমাণ অনেক কমে আসবে। আর যদি ভাড়াভিত্তিক সব কেন্দ্রের জন্য জ্বালানির দাম সমন্বয় করে দেওয়া হয়, তাহলে বিদ্যুৎ খাতে আর ভর্তুকির হয়তো প্রয়োজনই হবে না।

ওই সূত্রমতে, পিডিবি সব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করছে প্রতি ইউনিট গড়ে প্রায় পাঁচ টাকা দরে। তেলভিত্তিক প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির দাম সমন্বয় করা হলে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচও বিক্রয়মূল্যের প্রায় সমানই পড়বে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, তাঁদের হিসাবেও জ্বালানির দাম সমন্বয় করা হলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্য সমান হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে যুক্তিহীন পদক্ষেপ। কারণ, অধিকাংশ লোক বিদ্যুৎ ব্যবহারের আওতায় আছে। যারা নেই, তারাও বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর সুযোগ পেতে পারে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে।

বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৭:৫৯   ৯৫৬ বার পঠিত