বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫

ভাঙা সংসার জোড়া দিতে

Home Page » ফিচার » ভাঙা সংসার জোড়া দিতে
বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫



নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে স্বামী–স্ত্রী আলোচনা করে সমাধান করতে পারেন। তাহলে প্রায় ভেঙে যাওয়া ঘরটি আবার জোড়া লেগে যেতে পারে। মডেল: অবাক ও মুন। ছবি: সুমন ইউসুফনিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে স্বামী–স্ত্রী আলোচনা করে সমাধান করতে পারেন। তাহলে প্রায় ভেঙে যাওয়া ঘরটি আবার জোড়া লেগে যেতে পারে। মডেল: অবাক ও মুন। ছবি: সুমন ইউসুফ

বঙ্গনিউজ ডটকমঃ একে অপরের সুখে-দুঃখে দুজনই পাশাপাশি থাকবেন জীবনভর—এ বিশ্বাস নিয়েই শুরু হয় পথচলা। এক ছাদের নিচে দিনযাপন করা। পরস্পরকে বোঝার আগ্রহ। সহ্য করার, মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। সংসারের জন্য, সন্তানের জন্য সবাই কত পরিশ্রমই না করেন। কিন্তু কখন যে সংসারে লু হাওয়া বইতে শুরু করে বুঝতে বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে যায়। লু হাওয়া সংসারের কাঠামোতে, মনের অলিগলিতে যেভাবে তাণ্ডব চালায় তাতে ভুক্তভোগী মানুষকে বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখালেও মনের গভীরে তাদের বড় বড় ক্ষত ও গর্ত তৈরি করে ফেলে। পরস্পরের প্রতি বিষাদের বিতৃষ্ণার ছায়া ফেলে। মনের অজান্তেই ভাঙনের সুর বেজে ওঠে। চাইলেই হয়তো সেই বিষাদের সুর পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে আনন্দের সুর। জোড়া লেগে যেতে পারে ভেঙে যেতে থাকা সংসারটি।

 

কিন্তু ভাঙনই কি শেষ কথা?

আমার কাছে এলেন এক বয়স্ক দম্পতি। দুই যুগেরও বেশি তাঁদের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু কেউ কারও চেহারা এমনকি ছায়া পর্যন্ত দেখতে পারেন না। স্ত্রীর পারিবারিক অবস্থা তাঁর স্বামীর তুলনায় অনেক ভালো। বিয়ের পর তাঁর স্বামী তাঁর গরিব স্বজনদের টানতে থাকেন। স্ত্রীর তুলনায় তাঁর পরিবারের জন্য বেশি করতেন। স্ত্রীর দিকে নজর দেওয়া যতটা প্রয়োজন তা দিতেন না। মনে করতেন তাঁর শ্বশুর তাঁর মেয়েকে তো অঢেল দিচ্ছে। তাঁর খোঁজ না রাখলেও চলবে। কিন্তু স্ত্রী চাইতেন স্বামীর মনোযোগ। কিন্তু স্বামী বেচারা নেওয়া-দেওয়া লুকাতে গিয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে সেই যে ছিটকে পড়লেন আর তা জোড়া লাগাতে পারলেন না। এই শেষ বয়সে এসে দেখলেন যাঁদের জন্য জীবনটাকে এত তিক্ততায় ভরে ফেলেছিলেন তাঁরা আজ কেউ পাশে নেই। আর যাকে কোনো দিন গোনার মধ্যে রাখেননি টের পান, তিনি-ই তাঁর আশপাশে আছেন। শুধু অনুভব করতে পারেন স্পর্শ করার সাহস হারিয়েছেন।

ডিভোর্স বা তালাক শব্দটি বোঝে না, এমন লোক খুবই কম পাওয়া যাবে। এই ডিভোর্স শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনেক কষ্ট, দুঃখ, মান-অভিমান আর দূরত্ব। নিতান্তই ঝামেলা না হলে এর ধারে-কাছে কেউ যায় না।

 

দম্পতির মাঝে ইগো সমস্যা কেন তৈরি হয়?

বিয়েকে লোকে নেহাতই জীবনের একটা অংশ হিসেবে নেয়। সেখানে দায়দায়িত্ব যে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই সমানভাবে বর্তায় তা সবাই মেনে নিতে চান না। পরস্পরকে চাপিয়ে রাখা ও দোষারোপ করার মধ্যেই যেন কৃতিত্ব। একই লোকের দুই চেহারা। বাইরে অফিসে, স্বজনের মধ্যে যে লোক হাসিখুশি মিশুক স্বভাবের; সেই একই লোক ঘরে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাগী কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীর চেহারা নিয়ে থাকে। সমস্যা কোথায়? স্ত্রী যদি তার মিশুক ও সদালাপী চেহারা দেখে ফেলে তাহলে তার মাথায় উঠে বসতে পারে। তারপর হাজার চেষ্টা করেও নামাতে পারবে না।

ভুক্তভোগীদের কাছে জেনেছি—এই নেতিবাচক ধারণাগুলো দেয় পরিবার ও সমাজের কাছের মানুষেরা। ছেলেকে প্রকাশ্যে বলা হয়, বউকে মাথায় তুলবি না। দোস্ত বউ একবার বেশি লাই পেলে খালি শপিং আর শপিং। তোর সারা মাসের বেতন সাত দিনেই শেষ!

ঠিক উল্টোটা আবার বলা হয় মেয়েদের। স্বামীকে বশ করে রাখবে। সে যেন কখনোই নিয়ন্ত্রণ ছাড়া না হয়।

কিছু নারীও আছেন স্বামীর আর্থিক সামাজিক মানসম্মানের তোয়াক্কা করেন না। তাঁদের চাহিদা পূরণ করা, লোক দেখানো আদিখ্যেতা প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। স্বামীর অসহায়ত্ব তাঁদের মনকে নাড়া দেয় না। মানসিক দূরত্ব ক্রমাগত বাড়তেই থাকে।

এরই জের ধরে এক দম্পতি যৌথ সংসার ভেঙে নিজেদের মতো আলাদা বাসা নিলেন। তাতে কার কী লাভ হলো? স্ত্রীর জবাব হলো যৌথ পরিবারের সারাক্ষণ জবাবদিহি থেকে তো রেহাই পেলাম। আর কী হারালেন? বাচ্চারা তাদের দাদা-দাদি, নানা-নানির সাহচর্য হারাল। এত বছরের চেনা পরিবেশ হারিয়ে গেল। আগে যেসব দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতেন যেমন বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনা-নেওয়া করা, বাজার করা সব কাজ এখন নিজ হাতেই করছেন। সর্বোপরি স্বামীর হাসিখুশি চেহারায় কে যেন কালি মাখিয়ে দিয়েছে। তাঁর সাহচর্য আমি হারিয়েছি। বলছিলেন একজন ভুক্তভোগী।

কথায় বলে পাতিল ডেকচি পাশাপাশি থাকলে খুটখাট শব্দ হবেই। সে জন্য কি এগুলো ফেলে দিতে হবে? ঝগড়া-বিবাদ, মান-অভিমান হিংসা-বিদ্বেষ কোনো সংসারে নেই? সামান্য ভুল-বোঝাবুঝির জের সারা জীবন যে টানতে হবে কেন। সংসার তো কেবল রমণীর গুণে সুখের হয় না। সংসার সুখের হয় স্বামী-স্ত্রী উভয়ের গুণে। তাদের সমঝোতায়, ভালোবাসায়, আস্থায়-বিশ্বাসে।

বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি একবার বের হলে ফিরে আসে না। তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যথেষ্ট বিচক্ষণতার প্রয়োজন হয়। সহনশীলতা, ধৈর্য, সমঝোতাকামী মনোভাবের বিকল্প কিছু হতে পারে না।

 

দূরত্ব তৈরি হলে কার কী ক্ষতি?

পরিচিতজন অপরিচিত হয়ে যায়। অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়। বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। দুটি পরিবারের মধ্যে আজীবন শত্রুতা তৈরি হয়। বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় যত্নআত্তি, দেখাশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। বৃদ্ধ বাবা-মা সন্তানদের সংসারের টানাপোড়েনে নিজেরাও অসহায় বোধ করেন। কোনো মা-বাবা সন্তানকে অসুখী দেখতে চান না। সামাজিক মানসিক জাঁতাকলে পড়ে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান এমনকি স্বজনেরাও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন।

 

স্বামী-স্ত্রীর যা করণীয়

যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ধৈর্য ধরে ও সময় নিয়ে দুজনের আলাপে বসা উচিত। যেকোনো ঘটনার পরিণতিটা আগেভাগে ভেবে নেওয়া দরকার। প্রত্যেকে নিজেদের একলা চিন্তা করারও সময় দিন। সংসারে ভাঙন শুধু নিজেদেরই নয়, সন্তানদের ওপরও প্রভাব ফেলে। ওদের ভবিষ্যৎ জীবনও অনিশ্চয়তায় ছেয়ে যায়। নিজেদের জাহির করতে যাওয়ার আগে ভাবুন আপনি আসলে কী চান? আয়নার সামনে দাঁড়ান। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন সুখ আসলে কী? নিজেদের সমস্যা নিজেদের দ্রুত মিটিয়ে নেওয়া দরকার। লোক হাসানোর আগেই সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করুন।

ইগোর লড়াই সারা জীবন চালিয়ে যাওয়ার কী আছে! বরং সংসার যখন শুরু করছেন, নিজেকে জানুন। নিজেকে চিনুন। নিজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করুন। একই অর্থনৈতিক অবস্থানের দুটি মানুষের সব সময় মিলন হয় না। বরং আমাদের সমাজে নিকট অতীতের প্রচলিত রেওয়াজ হলো—অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী বা প্রভাবশালী পরিবারের সঙ্গে কুটুম্বিতা করা। এখনো তা-ই হয়। এটাকে অন্যায় বলছি না। মেলাবে মিলিবে—তবেই তো সংসার-সমাজ আরও সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় হবে। কিন্তু দুই পরিবারের এই বৈষম্য নিয়ে জীবনভর স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে, তার কোনো মানে নেই। সংসার তো স্নায়ুযুদ্ধের ময়দান নয়। সংসারকে বিপন্ন না করে সুখ ও প্রেমকে প্রাধান্য দিন। সেটাকে চালিকাশক্তি করুন। দেখা যাবে বংশানুক্রমে সেটির সুফল পাওয়া যাবে। আপনাদের যাপিত জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো সন্তানও অনুসরণ করবে।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় দেখেছি, সংসারে একবার ইগো বা অহমিকা, বিরোধ-বিবাদের বিষবৃক্ষ বপন হয়ে গেলে সেটি ওপড়ানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সমস্যার সমাধান না করে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সেটি শুধু টেনে লম্বা করা হয়। জীবনের এই নাটকে অপেরায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব অনেকে সৎ পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে আসেন। অনেকে নেতিবাচক নাক গলিয়ে বিষয়টিকে আরও তিক্ত করে তোলেন।

এখনকার জমানায় একটা সংসার জীবনের দৈর্ঘ্য অর্ধশতাব্দী ছাড়িয়ে যায়। যাপিত জীবনের সবচেয়ে বড় এপিসোড আপন বৈবাহিক সংসারের। এখানে তিক্ততার জের টেনে আজীবন দুঃখী ও অসুখী থাকা মূর্খতাজনিত শৌখিনতা বই কিছু নয়।

জীবনের দীর্ঘ পথচলায় স্বামী বা স্ত্রী—এই সফরসঙ্গীর সাহচর্য ও সহযোগিতা পরম আকাঙ্ক্ষিত। পরস্পরের সঙ্গে মিলে সেঞ্চুরি হাঁকানোর টারগেটে নট আউট জুটি গড়ে তুলুন। ক্রিকেটের বাইশ গজের ক্রিজে যেটা সম্ভব, সংসারের ক্রিজে সেটা সম্ভব কেন হবে না। অবশ্যই সম্ভব। এখানে ভাগ্যের কিছু নেই। ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ আপনার-আমার হাতেই।

আরেকটা ব্যাপার, অনেক দম্পতির দেখা পেয়েছি, কয়েক যুগ ধরে অসুখী। কেউ বা আধা যুগ ধরে। এরা ধরেই নেন, একবার যখন সংসারে অশনি দেখা দিয়েছে আর কখনো সুখের দেখা মিলবে না। মঙ্গলময় কিছু ঘটবে না। হতাশার চাদরে নিজেদের মুড়িয়ে নেন তাঁরা। কিন্তু এটা কোনো কাজের কথা নয়। বছরের পর বছর সংসারে অশান্তি চলছে বলে সুখের দেখা আর মিলবে না, এটা ঠিক নয়। বরং হোক না যুগব্যাপী যন্ত্রণার সংসার, তারপরও টানাপোড়েন মিটিয়ে সুখ ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য দরকার সদিচ্ছা। সংসারে প্রেম ও ভালোবাসার উদ্ঘাটন।

 

দুই পক্ষের পরিবারের দায়িত্ব কি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?

বিবদমান স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে কেউ যদি ঘি ঢালে তাহলে কথাই নেই। সংসার যখন জতুগৃহ হয়ে ওঠে, তখন সেই আগুনে আলুপোড়া দিয়ে খাওয়ার লোকের অভাব নেই। তাই সন্তানদের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের অবদানও ফেলনা নয়। তাঁদের ইতিবাচক ভূমিকা অনেক ভাঙা সংসারও জোড়া লাগাতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬:৩৬:১২   ৪৬৬ বার পঠিত