রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫
স্বপ্নের সেতু ঘিরে উচ্ছ্বাস
Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » স্বপ্নের সেতু ঘিরে উচ্ছ্বাসবঙ্গনিউজ ডটকমঃ চারপাশ থেকেই মানুষ আসছেন পিলপিল করে। লঞ্চে করে নদী পেরিয়ে, পায়ে হেঁটে—যে যেভাবে পারছেন, আসছেন। অনেকের হাতেই লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। কেউ কেউ ঢোল নিয়ে এসেছেন। বাজনার সঙ্গে গানও গাইছেন অনেকে। উচ্ছ্বাস-আনন্দে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরতেও দেখা গেল অনেককে। সেই আনন্দে শামিল হয়েছেন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের অনেক চীনা নাগরিকও।
পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং ও নদীশাসনকাজের উদ্বোধন উপলক্ষে গতকাল শনিবার সকাল থেকে এমনই ছিল এপারে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া এবং ওপারে শরীয়তপুরের জাজিরার চিত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেলা একটার দিকে সেতুর মূল কাজের উদ্বোধন করেন।
অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ সাংসদ, রাজনীতিক, পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
২০১৮ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। এই সেতু হয়ে গেলে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ জনপদ। এই সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেনও চলবে। এশিয়ান হাইওয়ের রুট হিসেবেও এই সেতু ব্যবহার করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল সেই স্বপ্নের কথাই শুনিয়েছেন পদ্মাপারের মানুষকে। তিনি বলেছেন, ‘এই সেতু হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। মানুষের আর্থিক উন্নয়ন হবে। কর্মসংস্থান হবে। নতুন স্যাটেলাইট শহর গড়ে উঠবে। পদ্মার দুই পারে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের দুঃখকষ্ট থাকবে না।’
উৎসবমুখর পরিবেশ: সকাল নয়টায় ঢাকা থেকে মাওয়া যাওয়ার পথে চোখে পড়ল সড়কের দুই ধারে র্যা ব-পুলিশের কড়া পাহারা। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের লোকজন হেঁটে জড়ো হয়েছিলেন মাওয়া চৌরাস্তায়। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর ছবি আর ব্যানার নিয়ে হেঁটে হেঁটে গেছেন জনসভার দিকে। মুন্সিগঞ্জ, টঙ্গিবাড়ী, লৌহজং, সিরাজদিখান, ঢাকার কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছেন লোকজন। এর মধ্যে নৌকার ছাপমারা শাড়ি পরা নারীরা দৃষ্টি কেড়েছেন সবার।
এঁদেরই একজন সালেহা বেগম। তিনি মুন্সিগঞ্জের হলুদিয়া ইউনিয়ন থেকে এসেছেন। কিন্তু কেন? বিস্মিত দৃষ্টিতে তিনি বললেন, ‘ক্যান, জানেন না? আজ তো প্রধানমন্ত্রী আসছে আমাগো এলাকায়। তারে দেখতে আসছি।’
শুধু কি সড়কপথে? বেলা ১১টার পর দেখা গেল ট্রলারে করে শত শত লোক আসছেন ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর থেকে। তাঁরাও এসেছেন প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় অংশ নিতে। এঁদেরই একজন শিবচরের হাকিম জমাদ্দার। তিনি বলেন, ‘আমাগো স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ চালু করতে শেখ হাসিনা আসছে। এমুন দিনে কি না আইস্যা পারি?’
বেলা যত গড়িয়েছে, মানুষের উচ্ছ্বাস যেন ততই বেড়েছে। এমনকি দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার জন্য ফেরি কিংবা লঞ্চের অপেক্ষায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরও দেখা গেল উচ্ছ্বসিত। সবার মুখে একটাই কথা—তাঁদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। তাঁদের যাতায়াতে দুর্ভোগসহ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
কুয়াশার কারণে নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা খানেক পরে প্রধানমন্ত্রী গতকাল বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে জাজিরায় গিয়ে পদ্মার নদীশাসনকাজের উদ্বোধন করেন। পরে সেখানে তিনি সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেন। এরপর নৌপথে মাওয়ায় পদ্মা নদীর মধ্যে ৭ নম্বর পিলারের পাইলিং কাজের জায়গাটিও দেখেন প্রধানমন্ত্রী। বেলা একটার দিকে তিনি মাওয়ায় পৌঁছে মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। বেলা সোয়া তিনটায় লৌহজং উপজেলার উত্তর মেদিনীমণ্ডলে খানবাড়ির মাঠে জনসভায় ভাষণ দেন। হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় ফেরার কথা থাকলেও জনসভা শেষ হতে বিকেল হওয়ায় তিনি সড়কপথে ঢাকায় ফেরেন।
সভাস্থলসহ পুরো এলাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অসংখ্য ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড ছিল।
জাজিরায় নদীশাসনকাজ উদ্বোধন: প্রধানমন্ত্রী জাজিরা উপজেলার নাওডোবায় পদ্মা সেতুর নদীশাসনকাজের উদ্বোধন করেন। এরপর তিনি সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেন। এ সময় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। আবুল হোসেনের সময়ই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ নিয়ে সরকারের টানাপোড়েন শুরু হয়।
সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিই। ২০০১ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ বন্ধ করে দেয়। আমরা আবার ক্ষমতায় এসে সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করি। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়া তারা দুর্নীতির একটা অভিযোগ আনে। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি, দুর্নীতি কোথায় হয়েছে, প্রমাণ দিতে হবে। তারা কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। তারা টাকাই ছাড় দেয়নি, তাহলে দুর্নীতিটা হলো কোথায়? এটা নিয়ে কানাডায় মামলা হয়েছে। কানাডার আদালত বিশ্বব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে, কী কী দুর্নীতি হয়েছে তা জানাতে। তারা এখন পর্যন্ত কিছুই জানাতে পারেনি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখানে ঘটনা অন্য ছিল। কোনো এক বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব, তিনি আইন ভঙ্গ করে একটি ব্যাংকের এমডি পদে ছিলেন ১১ বছর। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন তাঁকে এ পদ ছাড়তে বলে, তখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় হেরে তাঁকে এ পদ ছেড়ে দিতে হয়। আপনারা দেখেছেন, উইকিলিকস প্রকাশ করেছে যে তিনি আমেরিকার সরকারের অনেক ঊর্ধ্বতনদের কাছে অনেক ই-মেইল পাঠিয়েছেন। সেই ই-মেইলে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপনিতে নানা ধরনের আবেদন ছিল। তেমন এক মুহূর্তে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট তাঁর শেষ কর্মদিবসে পদ্মা সেতুর টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম। আমি ঘোষণা দিলাম, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করব। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলাম, অনেক সাধারণ মানুষ অর্থ দিতে প্রস্তুত। অনেকে চেকও পাঠিয়েছিলেন। সেটা আমরা নিইনি। কিন্তু তাঁদের এই যে সাহস, সহযোগিতা, সমর্থন—এটাই আমাকে শক্তি জুগিয়েছে।’
সব সমস্যার সমাধান সেতুতে: প্রধানমন্ত্রী আসবেন বলে গতকাল লৌহজংয়ের বিভিন্ন সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা ছিল। শিমুলিয়ায় পদ্মাপাড়ের মূল ফেরিগুলো আটকে ছিল দীর্ঘক্ষণ। বেলা ১১টার দিকে ফেরি কুসুমকলিতে উঠে দেখা যায়, অসংখ্য মানুষ নদী পারাপারের জন্য অপেক্ষা করছেন। এঁদেরই একজন ফরিদপুরের আমজাদ মোল্লা। বয়স ৬০ পেরিয়েছে। ঢাকায় দরজির কাজ করেন। পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু জানেন কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জানব না কেন? আমাদের স্বপ্নের সেতু। এই সেতু হয়ে গেলে এই ঘাটে এসে আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে থাকতে হবে না। সকালে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে আড়াই ঘণ্টায় বাড়ি পৌঁছে যাব।’
মাদারীপুরের কালকিনির রুহুল আমিন ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘এখন ঢাকা থেকে বাড়ি যেতে অনেক খরচ হয়। ভেঙে ভেঙে যেতে হয়। এই সেতু হয়ে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমাদের আজকে ঈদের দিন।’ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বিজন বিশ্বাস বলেন, ‘কেউ টাকা দেয়নি। আমরা আমাদের টাকায় সেতু করছি। এটা আমাদের জন্য গৌরবের।’
গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শতাধিক মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রত্যেকেই পদ্মা সেতুকে ঘিরে এমন ছোট-বড় নানা স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন। তাঁরা সবাই এই বিশ্বাস নিয়ে আছেন—এই সেতু বদলে দেবে তাঁদের জীবন, জীবিকা ও অর্থনীতি। আর সেই আশায় তাঁরা এখন একেকটি দিন গুনছেন স্বপ্ন নিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫৮:১৬ ৩৯৬ বার পঠিত