মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৫

সেতুর জন্য প্রস্তুত পদ্মা

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » সেতুর জন্য প্রস্তুত পদ্মা
মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৫



মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়া এলাকায় পদ্মা সেতুর পাইলিং ও নদীশাসনের কাজ চলছে। ছবিটি গতকাল তোলা l সাইফুল ইসলামমুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়া এলাকায় পদ্মা সেতুর পাইলিং ও নদীশাসনের কাজ চলছে। ছবিটি গতকাল তোলা l সাইফুল ইসলাম

বঙ্গনিউজ ডটকমঃ শীতের সকাল। বর্ষার প্রমত্তা পদ্মা এখন বেশ শান্ত। শান্ত নদীতে কাজের কোলাহল তুলেছেন হেলমেট পরা দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও শ্রমিকেরা। তীর থেকে যত দূর চোখ যায়, চোখে পড়ে পাইলিংয়ের জন্য আনা বিশাল সব পাইপ আর উঁচু উঁচু ক্রেন। যত কাছাকাছি যাওয়া গেল ততই স্পষ্ট হলো নদীতে চলা এক নির্মাণযজ্ঞের।

গতকাল সোমবার সকালে পদ্মা নদীর মাওয়া ঘাটে গিয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের এমন দৃশ্য চোখে পড়ল।

নদীর ভেতর যখন এমন কাজ চলছে, তখন নদীর তীরে গড়ে তোলা কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লোহার পাত কেটে বানানো হচ্ছে বিশাল পাইপ। ক্রেনে সেগুলো নামছে পদ্মার পাড়ে নোঙর করা জাহাজে। এরপর সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নদীতে। ট্রাক মালামাল নিয়ে আসছে, যাচ্ছে। নদীশাসনের জন্য সিমেন্ট-কংক্রিট দিয়ে তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার ব্লক। দুই পাড়ে রাস্তা তৈরির কাজ চলছে।

সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলীরা জানালেন, কাঙ্ক্ষিত গতিতেই এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতুর কাজ। ইতিমধ্যে এক-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থাৎ ২৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ৭ নম্বর পিলারের কাছে ইতিমধ্যে একটি সাপোর্ট পাইল তৈরি করা হয়েছে। আগামী শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর ৭ নম্বর পিলারের মূল পাইলের উদ্বোধন করবেন। এরপর থেকেই দৃশ্যমান অবকাঠামো চোখে পড়বে। আর এমন ৪২টি পিলারেই দাঁড়িয়ে যাবে পদ্মা সেতু।

গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজের অগ্রগতি ও সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি স্থান পায়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আগামী শনিবার পদ্মা সেতুর মূল সেতুর পাইলিং ও নদীশাসন কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে মন্ত্রিসভার সদস্যদের আমন্ত্রণ জানান। এ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সেতু যাতে না হয়, ষড়যন্ত্রকারীদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এটা নির্মাণের জন্য সরকার যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল, তা সফল হতে যাচ্ছে।

পাঁচটি প্রধান ভাগে হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাজ। কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আবদুল কাদের গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মূল সেতু নির্মাণের ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নদীশাসনের কাজ প্রায় ১৪ শতাংশ শেষ হয়েছে। সংযোগ সড়কের মধ্যে শরীয়তপুরের জাজিরায় ৫৯ শতাংশ এবং মাওয়ায় ৬৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, ‘যেভাবে কাজ চলছে, তাতে ২০১৮ সালের শেষেই এ সেতুতে যান চলবে বলে আমরা আশাবাদী।’

নির্মাণ উৎসব: ঢাকা থেকে মাওয়া আসার পথে শ্রীনগরের দোগাছি এলাকা থেকেই চোখে পড়বে কর্মযজ্ঞ। যতই মাওয়ার দিকে এগোনো যায়, ততই স্পষ্ট হয় সেই কাজ। মাওয়া চৌরাস্তা থেকে সোজা গেলে চোখে পড়ে মূল পদ্মা সেতুর কাজ। সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে মাওয়ার কুমারভোগে পদ্মা পাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড। সেই ইয়ার্ডে ঢোকার আগে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তাবেষ্টনী পেরিয়ে ডানে গেলেই চোখে পড়বে, হাজার হাজার ব্লক তৈরি করা হচ্ছে নদীশাসনের জন্য। এ কাজের দায়িত্ব পেয়েছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড।

এ কাজের সঙ্গে জড়িত অপারেটর জুয়েল রানা বলেন, মোট ৭৫ লাখ ব্লক তৈরি হবে।

যেখানে ব্লক তৈরি হচ্ছে, সেখান থেকে একটু সামনে গেলেই চায়নার রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের (এমবিইসি) কার্যালয়। এ প্রতিষ্ঠানটিই মূল পদ্মা সেতুর কাজ পেয়েছে।

গেটের কয়েক দফা নিরাপত্তাচৌকি পেরিয়ে এমবিইসির কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ঢুকলে বিস্মিত হবেন যে কেউ। একদিকে লোহার সারি সারি পাত। সেগুলোকে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে বাঁকিয়ে গোল করা হচ্ছে।

কেমন লাগছে এই কাজ করতে—জানতে চাইলে বাংলাদেশি একজন শ্রমিক মোহাম্মদ ফিরোজ বলেন, ‘অনেক কষ্ট। তবে যখন ভাবি পদ্মা সেতুর কাজে যুক্ত আছি, তখন মন ভালো হয়ে যায়।’

প্রকৌশলীরা জানালেন, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু হবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু। মোট ৪২টি পিলারের ওপর সেতুটি দাঁড়িয়ে থাকবে। এর মধ্যে ৪০টি নদীর ভেতর এবং দুটি সংযোগ সেতুর জন্য। নদীর ভেতরের একেকটি পিলারের জন্য ছয়টি পাইল থাকবে। আর বাইরের দুটির জন্য দুটি করে পাইল। এভাবে মোট ২৬৪টি পাইল থাকবে।’

২০১৮ সালে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা। দ্বিতল এই সেতুর পুরোটা হবে স্টিল আর কংক্রিট স্ট্রাকচারে। সেতুর ওপরের তলায় থাকবে চার লেনের মহাসড়ক আর নিচ দিয়ে যাবে রেললাইন। রেলের গতি হবে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার।

মাওয়ার কুমারভোগে পদ্মা রেস্টুরেন্টের সামনে কথা হয় অন্তত ২০ জনের সঙ্গে। প্রত্যেকে জানালেন, পদ্মা সেতু ঘিরে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন বদলে যাবে বলে তাঁরা আশাবাদী। স্থানীয় ব্যবসায়ী রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু যেমন হবে বলে শুনছি এবং যে কাজ দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে এটি হবে এই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই সেতুকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি—সবকিছুই বদলে যাবে বলে আশা করছি।’

বাংলাদেশ সময়: ১০:৫৮:৫৩   ৬৯২ বার পঠিত