মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৫

নতুন রূপে আদি খাদি

Home Page » বিনোদন » নতুন রূপে আদি খাদি
মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৫



প্যাটার্নেও বেশ বৈচিত্র্য আনা যায় খাদি কাপড়ের পোশাকে। ডিজাইনার: ফারাহ আনজুম বারী, মডেল: জাকিয়া উর্মি, সাজ: পারসোনা, ছবি: সুমন ইউসুফ প্যাটার্নেও বেশ বৈচিত্র্য আনা যায় খাদি কাপড়ের পোশাকে। ডিজাইনার: ফারাহ আনজুম বারী, মডেল: জাকিয়া উর্মি, সাজ: পারসোনা, ছবি: সুমন ইউসুফ

বঙ্গনিউজ ডটকমঃ লাল-নীল পোশাকটা যেন প্রজাপতির দুটি ডানা, হেমন্তের পাতাঝরা প্রকৃতিতে প্রাণের ছোঁয়া। খাদির রুক্ষ, অমসৃণ টেক্সচারের কথা কি একবারও মনে হচ্ছে এই পোশাক দেখে? এটা কিন্তু খাদি কাপড়েই তৈরি। ‘কাগজ কাটাই’ থিম ধরে ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’ আনার চেষ্টা বলে জানালেন ডিজাইনার ফারাহ আনজুম বারী। খাদির এই ভিন্ন রূপ, নতুন ব্যবহার—এসবই তুলে ধরছেন এ সময়ের ডিজাইনাররা। ‘দিশি তাঁতির হাত, দিশি তাঁতির তাঁত (‘চোরাই ধন’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)’ এই কথাটাই যেন প্রতিষ্ঠিত করছেন এ সময়ের ফ্যাশন ডিজাইনাররা। বৈচিত্র্যময় রূপে খাদি কাপড়কে তুলে ধরার জন্য তাই নিত্যনতুন চেষ্টা তাঁদের। খাদি কাপড়ে তৈরি পোশাক বলতে একসময়ে শুধু শাড়ি আর শালই মনে পড়ত। এখন পনচো, হুডি, ধুতি-প্যান্ট, টপ, গাউন—সবই তৈরি হচ্ছে খাদি কাপড় দিয়েই।

শীত আসছে মানেই নগরে নানা আয়োজন। ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি) আয়োজন করেছে এক ফ্যাশন শো ও পোশাক প্রদর্শনী। ১১ ও ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় এ আয়োজন হচ্ছে খাদিকে কেন্দ্র করেই। বাংলাদেশ ও ভারতের ডিজাইনাররা অংশ নিচ্ছেন এতে। নকশার এ আয়োজনে তুলে ধরা হয়েছে সেখানকার কিছু পোশাক।

প্রত্যেক ডিজাইনারই কাজ করছেন নির্দিষ্ট কিছু থিম ধরে। যেমন ফারাহ আনজুম বারী কাগজ কাটাই ধরে কাজ করেছেন। শাহরুখ আমিনের থিম আলপনা, বিপ্লব সাহার শখের হাঁড়ি। এভাবে প্রত্যেকেই খাদি কাপড়ে বাংলাদেশেরই আরেকটি ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন। আধুনিক সময়ে ঐতিহ্যবাহী লোকজ উপকরণগুলো কীভাবে উপস্থাপন করা যায়, সেটা দেখাই ছিল কাউন্সিল সদস্যদের চিন্তা। এ আয়োজন খাদিকে তুলে ধরবে আন্তর্জাতিক বাজারে। আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন খাদি নিয়ে কাজ করতে। এমন আশার কথা জানালেন এফডিসিবির সভাপতি মাহিন খান।

পিস চিহ্নটির ব্যবহারে খাদির পোশাকে এসেছে ভিন্ন আবেদন। ডিজাইনার: আফসানা ফেরদৌসী

ফারাহ আনজুম বারীর কথাতেই ফিরি। এফডিসিবি ফ্যাশন শোর জন্য কাজ করতে গিয়ে নতুন অনেক বিষয়ই জেনেছেন তিনি। ‘অন্যদের মতো আমিও ভাবতাম গাউন তৈরির জন্য শিফন কাপড়টাই উপযুক্ত। কিন্তু খাদি দিয়েও তো করলাম এবার। খাদির বহুমাত্রিক ব্যবহারটা কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম।’ বললেন তিনি। জানালেন, তাঁর সংগ্রহের পোশাকগুলোতে ভ্যালু অ্যাডিশন কম। অর্থাৎ এমব্রয়ডারি, ব্লকপ্রিন্ট, স্ক্রিনপ্রিন্ট ইত্যাদি নকশা তেমন দেখা যাবে না। বরং প্যাটার্নের বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। খাদি কাপড়ে প্যাটার্নের কাজটাও যে চমৎকার ফুটে ওঠে, সেটা তো এখন পরিষ্কার।

খাদি আর আলপনা দুইয়ের মিশেল ডিজাইনার শাহরুখ আমিনকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সদ্য তারুণ্যে। বললেন, ‘হাতে এঁকে নকশা করেছি এবার আমার পোশাকগুলো। বিয়েবাড়ির আলপনা আঁকতাম খুব একসময়। মনে পড়ছিল সে কথা।’ পথের ওপরের আলপনা পোশাকে কেমন ফুটে ওঠে সেটাই দেখালেন তিনি। খাদি কাপড়ে তা যেন হয়েছে আরও বাহারি।

রঙিন ও কোরা দুরকম খাদি নিয়েই কাজ হচ্ছে। ডিজাইনার এমদাদ হক, মডেল: ফাহিম, হাতে আঁকা আলপনা খাদির জমিনে। ডিজাইনার: শাহরুখ আমিন

গুলিস্তানে খদ্দর মার্কেট লেখা দেখে ঢুকে পড়েছিলেন বিপ্লব সাহা। একগাদা কাপড় কিনে এনে তাঁর মাথায় হাত। খাদি ভেবে এনেছেন চায়না মিলের কাপড়। এরপর তো খাদি চিনতে আর ভুল করেননি। খাদি নিয়ে অনেক দিন ধরেই কাজ করছেন তিনি। ‘১৯৯৭-৯৮-এর দিকে বিবি আপার (ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল) একটা প্রদর্শনীতে যাই। থরে থরে কাপড় সাজানো ছিল। রং-বেরঙের সে কাপড় দেখে মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা। অরুণদা ছিলেন সেখানে। তিনিই চেনালেন খাদি। এরপর কুমিল্লা থেকে প্রচুর কাপড় এনে কাজ করেছি।’

অরুণদা মানে অরুণ গুহ। কুমিল্লার খাদির কথা উঠলে গুহ পরিবারের নাম আসবেই। তাঁর বাবা শৈলেন্দ্রনাথ গুহ চান্দিনার খাদি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে অরুণ গুহ হাল ধরেছেন বাবার চালু করা গ্রামীণ খাদি প্রতিষ্ঠানটির। ঢাকার ফ্যাশন হাউসগুলোতে খাদি নিয়ে কাজ করা মানে অরুণ গুহর কাছে অন্তত একবার আসা চাই-ই তাঁদের। সে কথা বলতেই প্রতিবাদ তাঁর, ‘আমার আশপাশে তো আরও কতজন খাদি নিয়ে ভালো কাজ করছে।’ চান্দিনা থেকে সারা দেশে খাদি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা গ্রামীণ খাদির হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বেশ। তবে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় কাপড়ের দামটাও বাড়াতে হয়েছে তাঁদের। যার প্রভাব কাপড় বিক্রিতে পড়বেই—এ আশঙ্কার কথাও জানালেন।

খাদির বৈচিত্র্য এর নানা ধরনেও প্রকাশ পায়। মূলত বর্জ্য সুতা থেকে হাতে কেটেই খাদি কাপড় তৈরি হয়। শুধু সুতি নয়; সিল্ক, তসর, মুগা, উল, লিনেন—এসব কাপড়ের অবশিষ্ট দিয়েও খাদি বোনা সম্ভব। লাওস, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় নানা উপকরণ দিয়ে খাদি কাপড় বোনা হয়। আমাদের দেশে সুতি ও রেশম সুতায় খাদি বোনা হয়। কুমিল্লায় হয় সুতি খাদি। সিল্ক খাদি তৈরি হয় মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে। এসব তথ্য জানালেন ডিজাইনার এমদাদ হক। ‘কার্পাস তুলা থেকে হাতে কাটা সুতা দিয়ে হাতে বোনা কাপড়’ আভিধানিক এই অর্থ থেকে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে খাদিতে। ভারতে সুতার মান উন্নত হওয়ায় খাদি কাপড়ে তারা আরও নানা ভিন্নতা আনতে পারছে বলেও জানালেন এমদাদ হক।

এফডিসিবি এবার কয়েকজন নতুন ডিজাইনারকেও সুযোগ দিয়েছে অংশ নেওয়ার। আফসানা ফেরদৌসী তাঁদের একজন। শীতলপাটি থিম নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। ‘খাদি তো আমাদের দেশি। আন্তর্জাতিক বাজারের কথা ভেবেই তাতে এমন কিছু অনুষঙ্গ যোগ করেছি। বিশ্বজুড়ে সবাই সেটাকে পছন্দ করে। যেমন খাদি কাপড়ে তৈরি টপে পিস বা শান্তি চিহ্নটি স্ক্রিনপ্রিন্ট করে নকশা করেছি।’ বললেন তিনি। ‘সারা বিশ্বে এখন পরিবেশবান্ধব পোশাক পরার আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। মিলের কাপড়ের তুলনায় খাদি কাপড় তৈরিতে শক্তি বা এনার্জি খরচ কম হয়। খাদি বেশ আরামদায়ক, ত্বকের জন্যও ভালো। এভাবেও কিন্তু আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে খাদিকে তুলে ধরতে পারি।’

‘আপনি খদ্দর পরেন না কেন?’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চার অধ্যায় উপন্যাসে এলা জিজ্ঞেস করেছিল অতীনকে। ‘গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, পাট করা মুগার চাদর কাঁধে’ এই অতীন কেন খদ্দর পরে না তা জিজ্ঞেস করার কারণ কিন্তু গভীর। খদ্দর বা খাদি শুধু কাপড় তো নয়। এর সূত্র দেশপ্রেমের সঙ্গে বাঁধা। বিলেতি মিলের কাপড় বর্জন করে দেশি তাঁতে বোনা খদ্দর পরাটা ছিল মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলনের অন্যতম ভিত। উনিশ শতকের শুরুর দিকে যা ছিল স্বাধীনতার আন্দোলন, আজকের প্রেক্ষাপটে তার রূপ অন্য। ব্রিটিশ বাংলা ছেড়েছে। কিন্তু মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেওয়ার যে আহ্বান কবি রজনীকান্ত সেন জানিয়েছিলেন সেই সময়ে তা এখনো পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক। তবে সেই মোটা কাপড়ই পরতে হবে না। রঙে-বাহারে খাদি এখন দারুণ উজ্জ্বল।

টপ-জ্যাকেটে যেমন তেমনি শাড়িতেও খাদি অনন্য। ডিজাইনার: বিপ্লব সাহা। মডেল: অর্পিতা ও সুনেহরা

বাংলাদেশ সময়: ১০:৫৭:৩১   ১১৪৬ বার পঠিত