শনিবার, ৩১ অক্টোবর ২০১৫

রবীন্দ্রনাথের নটীর পূজা এবার থ্রিডিতে

Home Page » সাহিত্য » রবীন্দ্রনাথের নটীর পূজা এবার থ্রিডিতে
শনিবার, ৩১ অক্টোবর ২০১৫



নতুন থ্রিডি নটীর পূজার পরিচালক কার্ল বারদোশবঙ্গনিউজ ডটকমঃ নতুন থ্রিডি নটীর পূজার পরিচালক কার্ল বারদোশরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নটীর পূজা গীতিনাট্যটি তাঁর পরিচালনায় চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছিল ১৯৩১ সালে। কবিগুরুর পরিচালনায় সেটিই একমাত্র চলচ্চিত্র। কয়েক বছর পর নিউ থিয়েটারে রক্ষিত তাঁর একমাত্র নেগেটিভ কপিটি আগুনে পুড়ে যায়। সে ঘটনার প্রায় সাড়ে আট দশক পর নটীর পূজাকে নতুন করে চলচ্চিত্রে রূপ দিতে এগিয়ে এসেছেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র বিষয়ের অধ্যাপক ও খ্যাতিমান হাঙ্গেরীয় চলচ্চিত্রকার কার্ল বারদোশ।
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কার্যালয়ে কথা হলো বারদোশের সঙ্গে। তাঁর কক্ষে ঢুকতেই নজরে এল দেয়ালে রয়েছে কবিগুরুর ছবি, বইয়ের তাকে একাধিক রবীন্দ্রনাথবিষয়ক গ্রন্থ। বারদোশ বললেন, ‘গুরুদেব গীতাঞ্জলির জন্য নোবেল পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে। সেই ঘটনার শতবর্ষ পরে এই ছবি হবে এক মহান কবির প্রতি তাঁর এক হাঙ্গেরীয় ভক্তের অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি।’
নিউ থিয়েটারের যে স্টুডিও ফ্লোরে নটীর পূজা পরিচালনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ঠিক সেখানেই গীতিনাট্যটি নতুন করে চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন বারদোশ। তবে এই চিত্রায়ণের বৈশিষ্ট্য হলো, এটি তিনি ধারণ করেছেন থ্রি-ডাইমেনশন প্রযুক্তিতে। ‘সিঙ্গেল শট’ চিত্রায়ণপদ্ধতিতে ধারণ করা এই চলচ্চিত্র দর্শকদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা হবে বলে বারদোশের বিশ্বাস।
নটীর পূজা লেখা হয়েছিল ‘পূজারিণী’ কবিতা অবলম্বনে। পুত্রবধূ প্রতীমা দেবীর অনুরোধে কবিতাটির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৬ সালে কলকাতার মঞ্চে সে গীতিনাট্যের মঞ্চায়ন দারুণ সাড়া ফেলেছিল। ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ৭০-কলকাতার নিউ থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী বি এন সরকার কবিকে অনুরোধ করেছিলেন নটীর পূজা গীতিনাট্যটির চলচ্চিত্রে রূপ দিতে। এই নতুন মাধ্যমের সঙ্গে রবিঠাকুরের পরিচয় ছিল, কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের কারিগরি বিভিন্ন দিক নিয়ে হাতেকলমে তাঁর তখনো কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। অতঃপর চিত্রগ্রাহক নিতীন বোসের সাহায্যে নটীর পূজাকে মঞ্চ নাটক হিসেবে ধারণ করেন তিনি। এতে তাঁর সময় লাগে চার দিন। ১৯৩২ সালের মার্চে কলকাতার চিত্রা টকিজে প্রদর্শনী শুরু হয় সেই ছবির। তখন খ্যাতির শীর্ষে রবীন্দ্রনাথ, বি এন সরকার আশা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি ছবিটিকে বাণিজ্যিক সফলতা দেবে। বাস্তবে অবশ্য সেটা হয়নি।
এই ঘটনার ৮০ বছর পর অধ্যাপক কার্ল বারদোশ প্রবেশ করলেন মঞ্চে। হাঙ্গেরিতে ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ১৯২৬ সালে হাঙ্গেরির বিখ্যাত বালাতন লেকে কয়েক সপ্তাহ অবকাশ যাপন করেছিলেন কবি। সেই স্মৃতি হিসেবে বালাতনে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি। বারদোশ অনেকবারই সেখানে গেছেন। ডাকঘর তাঁর প্রিয় নাটকের একটি। গীতাঞ্জলির অনেক কবিতাই তাঁর স্মৃতিতে ধরা আছে অবিকল।
নটীর পূজা চলচ্চিত্রে অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর১৯৯০-এর গোড়া থেকে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগে অধ্যাপনা করছেন বারদোশ। চলচ্চিত্রকার হিসেবে হাঙ্গেরিতে তিনি অবশ্য অনেক আগে থেকেই সুপরিচিত-১৯৮৭-তে বারদোশ পরিচালিত তথ্যচিত্র ক্রসিং দ্য ব্রিজ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি দেয় তাঁকে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি একাধিক চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন তিনি। তাঁর রচনা ও প্রযোজনায় নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ওপর ভিত্তি করে বানানো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ফোর্সড মার্চ প্রশংসিত হয়েছে ছবিটির বিষণ্ন-কাব্যিকতার জন্য। অধ্যাপক বারদোশ সেলুলার ফোনে চলচ্চিত্র ধারণের যে কৌশল আবিষ্কার করেছেন, তার ভিত্তিতে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষ কোর্স পড়ান তিনি।
নটীর পূজার চলচ্চিত্র ধারণ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে, কিন্তু নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়নি এখনো। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব থিয়েটারে অধ্যাপক বারদোশের সঙ্গে বসে ওই ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। চলচ্চিত্রটি থ্রি-ডাইমেনশনাল, ফলে চোখে একধরনের চশমা পরে দেখতে হলো। পর্দায় যে চলচ্চিত্র দেখে আমরা অভ্যস্ত, তাতে থাকে একমাত্রিক ইমেজ, কিন্তু থ্রিডিতে প্রতিটি চরিত্র তার স্বাভাবিক শারীরিক মাত্রা বা ডাইমেনশন নিয়ে প্রকাশিত হয়। যে কারণে এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা ব্যাস দৃশ্যমান হয় আমাদের কাছে। ফলে প্রতিটি চরিত্র হয়ে ওঠে অনেক বেশি জীবন্ত ও বাস্তব।
রবীন্দ্রনাথের মতো বারদোশও মঞ্চ নাটক হিসেবেই চিত্রায়িত করেছেন নটীর পূজা, তবে এই কাজে তিনি যে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন, তার নাম ‘সিঙ্গেল শট ফটোগ্রাফি’। একই ক্যামেরার সাহায্যে অবিচ্ছিন্নভাবে চলচ্চিত্র ধারণের এই প্রযুক্তিটির আবিষ্কারক বিখ্যাত ডাচ-ইন্দোনেশীয় সিনেমাটোগ্রাফার রেটেল হেল্মরিশ। আলোচ্য ছবির ক্যামেরার দায়িত্ব তিনিই পালন করছেন।
এ গীতিনাট্যের অবিকল চিত্রায়ণ বারদোশের লক্ষ্য নয়, বরং তাঁর জন্য এই উদ্যোগ দীর্ঘদিন পুষে রাখা এক অভিলাসের বাস্তবায়ন। যে কবিকে তিনি আজীবন গুরুদেব বলে জেনেছেন, তাঁর জন্মস্থানে তিনি ফিরে গেছেন এক তীর্থযাত্রায়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে সে যাত্রার শুরু এবং গঙ্গার ধারে কালীঘাটে কবির শেষ পদচিহ্ন অনুসরণের মধ্য দিয়ে যাত্রার সমাপ্তি। এই দুইয়ের মাঝখানে নিউ থিয়েটারে নটীর পূজার চলচ্চিত্রায়ণ ঠিক সেই মঞ্চে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজে সেজেছিলেন ওই নাটকের একমাত্র পুরুষ চরিত্র। এ যেন চলচ্চিত্রের ভেতর আরেক চলচ্চিত্র-বারদোশ তাঁর নটীর পূজাকে সেভাবেই নির্মাণ করেছেন। মূল নাটকটি অবিকল ধারণের বদলে অনুসরণ করেছেন কাহিনির মুখ্য ধারাটি, আর এর সঙ্গে রেখেছেন আধুনিক সময়ে এই নাটকের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিভিন্নজনের মন্তব্য। বিশেষজ্ঞ ছাড়াও এই গীতিনাট্যে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, অধিকাংশই শান্তিনিকেতনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী-তাঁদের কেউ কেউ নিজের মতো করে এ নাটকের অর্থ বিবৃত করেছেন।
নটীর পূজার কাহিনি রবিঠাকুর আহরণ করেছিলেন আড়াই হাজার বছর আগের পুরোনো এক বৌদ্ধ গাঁথা থেকে। এ নাটকটি বর্ণবিভেদ ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। বারদোশের চোখে এ বিষয়টি এখনো কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, সবার জন্য গভীরভাবে শিক্ষণীয়ও বটে। এই বোধই তাঁকে গীতিনাট্যটি নতুনভাবে চিত্রায়ণে অনুপ্রাণিত করেছে, ‘গোটা বিশ্ব আজ যখন ধর্মের নামে একে অন্যের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী বিবাদে লিপ্ত, সে সময় নটীর পূজা আমাদের সহিষ্ণুতায় উদ্বুদ্ধ করবে। দেরিতে হলেও কবিগুরুর প্রতি এ আমার সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য।’-বললেন অধ্যাপক বারদোশ।
তিনি আশা করছেন এই থ্রিডি চলচ্চিত্রটি আগামী বছরের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে। তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা বাংলাদেশেও মুক্তি পাক নটীর পূজা। বাংলাদেশের খুব বেশি সিনেমা হলে যেহেতু থ্রিডি প্রযুক্তির ব্যবহার নেই, ফলে সমস্যা নিরসণে ছবিটির একটি গতানুগতিক ভিডিও সংস্করণও একই সময়ে মুক্তি দিতে চান তিনি। তাতে সিনেমা হলের পাশাপাশি টেলিভিশনেও চলচ্চিত্রটি দেখানো যাবে।
কথার এক পর্যায়ে আমার হাতে হাত রেখে পরিচালক কার্ল বারদোশ বললেন, ‘তোমার দেশে এই ছবি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত আমার অপেক্ষার শেষ হবে না।’

বাংলাদেশ সময়: ১৮:১১:০০   ৩৮১ বার পঠিত