বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর ২০১৫
কমিউনিস্টদের বুদ্ধি আছে, কিন্তু আক্কেল নেই।
Home Page » মুক্তমত » কমিউনিস্টদের বুদ্ধি আছে, কিন্তু আক্কেল নেই।বঙ্গনিউজ ডটকমঃ মাসুক হেলালবাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কয়েক দিনের জন্য নিউইয়র্কে এসেছিলেন। মেয়েকে কলেজে ভর্তি করানোর কাজ ছিল, সেটা সেরে প্রবাসের বাঙালিদের সঙ্গে বার দুয়েক মতবিনিময়ে অংশ নিলেন। সেখানেই শুনলাম, সিপিবি এখন দুর্দান্ত অবস্থায় রয়েছে। দেশের প্রতিটি আন্দোলনের নেতৃত্বেই তারা। সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে শুরু করে গণজাগরণ মঞ্চ-সর্বত্রই কমিউনিস্ট নেতৃত্ব। সে কথা শুনে আমরা কেউ কেউ ঢোঁক গিলছি, তা ঠাহর করায় সেলিম ভাই বোঝালেন: চুলায় ভাত রান্না হচ্ছে, কিন্তু এখনো পুরোপুরি সেদ্ধ হয়নি। হলেই সে খবর আপনারা জানতে পারবেন।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি জানালেন। বঙ্গবন্ধু নাকি একসময় সেলিম ভাইকেই সরাসরি বলেছিলেন, তোদের, অর্থাৎ কমিউনিস্টদের বুদ্ধি আছে, কিন্তু আক্কেল নেই। ‘এখন আমরা আক্কেলমন্দ হওয়ার পথে আছি।’ বললেন সেলিম ভাই।
চলতি রাজনীতি নিয়েও কিছু কথা বললেন। আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্রের পথে আসার বুদ্ধি দিলেন, বিএনপিকে বললেন জামায়াত ছাড়ো। বামপন্থী বিভিন্ন দলকে এক হওয়ার আহ্বান জানালেন, কিন্তু এক হওয়ার ডাক প্রকাশ্যে কেন দিচ্ছেন না, সে কথার ব্যাখ্যা অবশ্য খুব স্পষ্ট হলো না। আশ্বাস দিলেন, খুব শিগগির দেশের মানুষ জেগে উঠবে, দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে। তবে আর যা-ই হোক, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের গাঁটছড়া বাঁধার সম্ভাবনা নেই।
বাম জাগরণের এ কথা কতটা সত্যি, কতটা কল্পনা, সে বিতর্কে যাব না। সেলিম ভাই ছাত্রজীবনে আমার নেতা ছিলেন, তাঁর প্রতিটি কথা হাঁ করে গিলতাম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, তিনি কান্ডারি হয়ে এগিয়ে এসেছেন। তাঁর চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান সতীর্থরা অবশ্য সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন মন্ত্রী বাহাদুর। অনুমান করি, চাইলে তিনিও সে কোটায় ঢুকে পড়তে পারতেন।
একসময় কমিউনিস্টরা আমাদের নতুন বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ত্যাগী, আদর্শবান নেতা-কর্মীর অভাব ছিল না। কিন্তু পৃথিবীর যে দেশেই কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দেখল করেছে, সেখানে নতুন বিশ্ব গড়ার বদলে নিজেদের পকেট ভরেছে, আর বিরোধী সবাইকে হয় গুলির সামনে পাঠিয়েছে, অথবা জেলে পুরেছে। আমি শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলছি না, সে দেশের কথা সবাই জানেন। চীন থেকে কিউবা, ইথিওপিয়া থেকে ইয়েমেন, সর্বত্র একই দৃশ্য। আর আঙুল ফুলে কলাগাছ? একসময়ের মহা বাম নিকারাগুয়ার দানিয়েল অরতেগা এখন সে দেশের নব্য ধনীদের শিরোমণি। প্রমাণের জন্য অত দূর নয়, পাশের বাড়ির বাম নেতা জ্যোতি বসুর সুযোগ্য পুত্র চন্দন বসুর আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার উদাহরণটা মনে রাখলেই চলবে। বস্তুত, ইথিওপিয়া থেকে ইয়েমেন-যেখানেই কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছে, দেশটা চিড়ে-ছিবড়ে খেয়ে তারপর মানুষের দাবড়ানি খেয়ে ইঁদুরের গর্তে ঢুকেছে।
ইউরোপের বাইরে লাতিন আমেরিকায় একটি শক্ত বাম হাওয়া বইছে দীর্ঘদিন থেকেই। ব্রাজিল, বলিভিয়া ও ভেনেজুয়েলায় সরকার জনগণতন্ত্রী রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যার প্রধান লক্ষ্য দারিদ্র্য অবলুপ্তি ও বৈষম্য হ্রাসকমিউনিস্ট শাসনের অবসান হয়তো হয়েছে, কিন্তু বিশ্বকে বদলানোর যে কথা একসময় কমিউনিস্টরা বলতেন, তা যে উবে গেছে, তা মোটেই নয়। কমিউনিস্ট শব্দটা এখন আর তেমন সম্মানজনক নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের রাজা-বাদশাহদের হাতের রক্ত বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্টের হাতেও লেগে রয়েছে। বিলম্বে হলেও নিজেদের পাপমুক্ত করতে পৃথিবীর অনেক দেশেই কমিউনিস্ট পার্টির বদলে গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। বিপ্লবের বদলে তারা এখন পরিবর্তনের কথা বলে, যে পরিবর্তনের লক্ষ্য নাগরিক অধিকারের সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক অসাম্যের অবসান। কমিউনিস্টরা এই পরিবর্তনটাই চাইত, কিন্তু কোথাও তারা সেই স্বপ্ন পূরণে যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারেনি। আশার কথা, কমিউনিস্টদের সেই স্বপ্ন পূরণে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছে এক ‘নতুন বাম’।
আমেরিকার কথা ভাবুন। লেনিন আমেরিকার কথা মাথায় রেখেই সাম্রাজ্যবাদকে ধনতন্ত্রের শেষ পর্যায় বলে চিহ্নিত করেছিলেন। সেই আমেরিকায় এখন যে লোকটি দেশের মানুষকে এক ভিন্ন ধরনের গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, তিনি নিজেকে কোনো রাখঢাক ছাড়াই ‘সমাজতন্ত্রী’ হিসেবে পরিচিত করান। ভারমন্টের প্রবীণ স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এ দেশের ‘বিলিয়নিয়ার ক্লাস’-এর বিরুদ্ধে তাঁর নিজস্ব ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেছেন। এ দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ওয়ালস্ট্রিটের ধনকুবেরদের আধিপত্য ভেঙে দেওয়ার জন্য তিনি নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। অসাম্যের শিকার দরিদ্র শ্রেণি এবং বৈষম্যের শিকার অবৈধ অভিবাসীদের পক্ষে জনমত গড়ার এক কঠিন লড়াইয়ে অংশ নিতে দেশের মানুষকে ডাক দিয়েছেন। আমেরিকার আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থিতার জন্য লড়াই করছেন। তিনি সেই মনোনয়ন পান অথবা না পান, তাঁর জনপ্রিয়তার কারণেই দলের প্রধান প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন নিজের এজেন্ডা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন, অসাম্য হ্রাসের পক্ষে ও অভিবাসী অধিকারের সমর্থনে নিজেকে যুক্ত করেছেন।
রাজনৈতিক কর্মসূচি ও রণকৌশলের দিক দিয়ে গ্রিসের সিরিজা পার্টি কোনো রাখঢাক ছাড়াই বামপন্থী অবস্থান গ্রহণ করেছে। অথবা স্পেনে পদেমোস পার্টি তাত্ত্বিক শুদ্ধতার কথা ভেবে সমাজের সবচেয়ে প্রান্তবর্তী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। সিরিজার প্রধান এলেক্সি সিপরাস ও পদেমোসের প্রধান পাবলো ইগ্লেশিয়াস একসময় যাঁর যাঁর দেশের যুব কমিউনিস্ট লিগের সদস্য ছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘ব্যয় সংকোচন’ নীতির চাপে চিড়ে-চ্যাপটা হয়ে আসা প্রান্তবর্তী মানুষের সংখ্যা এ দুই দেশে ক্রমেই বাড়ছে। তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে সরকারি খাত সংকোচনের বদলে তা সম্প্রসারণের পক্ষে তাঁরা। তাঁরা উভয়েই সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমার পক্ষে, সবার ওপর সম্পত্তি কর আরোপের বদলে শুধু ধনিক শ্রেণি, বিশেষত যাঁদের একাধিক বাড়ি আছে, তাঁদের ওপর ধার্য করার নীতি তাঁরা প্রস্তাব করেছেন। এই নীতিকে যদি কেউ কমিউনিস্ট বলে, তাতে ক্ষতি নেই। চীনা নেতা দেং শিয়াও পিংই তো বলেছিলেন, বিড়ালটা কালো না সাদা সেটা বড় প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলো তা ইঁদুর ধরতে পারে কি না।
সবচেয়ে বিস্ময়কর খবর এসেছে আমেরিকার ‘ছোট ভাই’ ব্রিটেন থেকে। সেখানে প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন জেরেমি করবিন। তিনি এ দলের সবচেয়ে পরিচিত, সবচেয়ে পরীক্ষিত বাম নেতা। সিরিজা ও পদেমোসের মতো তিনিও সরকারি খাতের সম্প্রসারণ চান, অভাবীদের জন্য ‘সামাজিক নিরাপত্তা জাল’ বাড়াতে চান এবং চলতি রক্ষণশীল সরকারের ‘ব্যয় সংকোচন’ নীতি আমূল বদলে দিতে চান। এমনকি তিনি ব্রিটেনের প্রধান শিল্পসমূহের রাষ্ট্রীয়করণ ও আণবিক অস্ত্রভান্ডার পুরোপুরি বাতিল করতে চান। এর চেয়ে অধিক বামপন্থী-কারও কারও ভাষ্যে কমিউনিস্ট-কর্মসূচি আর কী হতে পারে? আয়ারল্যান্ড ও পর্তুগালেও বামপন্থীরা জনমত জরিপে এগিয়ে।
ইউরোপের বাইরে লাতিন আমেরিকায় একটি শক্ত বাম হাওয়া বইছে দীর্ঘদিন থেকেই। ব্রাজিল, বলিভিয়া ও ভেনেজুয়েলায় সরকার জনগণতন্ত্রী রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যার প্রধান লক্ষ্য দারিদ্র্য অবলুপ্তি ও বৈষম্য হ্রাস। তবে এ কথাও যোগ করা ভালো, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে এসব দেশে একনায়কতন্ত্রী একটি লক্ষণ ফুটে উঠছে। বাড়ির পাশে পশ্চিম বাংলায় বামপন্থীদের পতনের সেটি ছিল অন্যতম কারণ।
বামপন্থীদের এই উত্থান, যা মোটেই কল্পনা নয়, তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব? আসলে তথাকথিত বিশ্বায়নের চাপে সর্বত্রই ক্ষমতার মেরুকরণ ঘটছে। প্রতিটি দেশেই মাত্র ১-২ শতাংশ মানুষের হাতে শুধু অর্থনৈতিক সম্পদই নয়, সব রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। অক্সফামের হিসাব অনুসারে, ২০১৬ সালের মধ্যে বিশ্বের সব সম্পদের ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করবে এই ১ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বের ৮০ শতাংশ মানুষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৫ শতাংশ সম্পদ। বাংলাদেশের চিত্র যে এ থেকে ভিন্ন নয়, সে কথা আমাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে?
এই পাহাড়সমান অসাম্যের কারণেই একসময় ফ্রান্সে বিপ্লব হয়েছিল। বিপ্লব হয়েছিল রাশিয়ায় ও চীনে। তথাকথিত মূলধারার দলসমূহ-যেমন: আমেরিকার রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টি, ব্রিটেনের লেবার ও কনজারভেটিভ পার্টি বা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-তারা বরাবরই ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করেছে, ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেদের পকেট ভারী করেছে। এই অবস্থায় অবশিষ্ট ৯৯ শতাংশের পক্ষে যারা, অবাক কী, দেশের মানুষ তাদের দিকেই ঝুঁকবে।
সেলিম ভাই ভাত সেদ্ধ হওয়ার যে উপমাটি ব্যবহার করেছেন, এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা মাথায় রাখলে তার অর্থ পরিষ্কার হয়। দেশের মানুষ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু সেই বাস্তবতাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা ও ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে রণকৌশল। সিরিজা ও পদেমোসের সাফল্যের সেটিই কারণ। তারা উভয়েই নিজেদের কর্মসূচির সপক্ষে রাজনৈতিক জোট গড়তে সক্ষম হয়েছে।
নিজের শত্রু-মিত্র সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তেমন ইস্যুভিত্তিক কোয়ালিশন বাংলাদেশের বামেরাই বা পারবে না কেন? ভাত যদি সেদ্ধ হতে হয়, তাহলে চুলায় হাঁড়ি বসানোর আগে এই জোগাড়যন্ত্রটুকু অত্যন্ত জরুরি। তবে এর জন্য যে আক্কেল দরকার, সন্দেহ হয়, আমাদের কমিউনিস্টদের তা এখনো হয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১১:০০:৫৭ ৪২৭ বার পঠিত