বুধবার, ৭ অক্টোবর ২০১৫
জঙ্গি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের ধারণা অস্পষ্ট
Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » জঙ্গি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের ধারণা অস্পষ্টবঙ্গনিউজ ডটকমঃ দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড ও তাঁদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগাযোগ অনেক পুরোনো। তবে এদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা বেসরকারি গবেষকদের ধারণাও অস্পষ্ট। জঙ্গিবিরোধী কাজে সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে।
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত ‘জঙ্গিবাদ ও বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এ কথা বলেছেন। তাঁরা বলেন, অবশ্য এ দেশে আইএসের অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত প্রমাণিত নয়, ধারণাপ্রসূত। সরকার একাধিক মামলায় আইএস হিসেবে কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আসামি করেছে। এসব মামলার বিচারে প্রমাণিত হতে পারে, দেশে আইএসের অস্তিত্ব আছে কি না।
গতকাল মঙ্গলবার ডেইলি স্টার সেন্টারের এ এস মাহমুদ সেমিনার হলে এই গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ডেইলি স্টার-এর স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহেদুল আনাম খান অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। আলোচনা শেষে জঙ্গিবাদবিরোধী উদ্যোগে সমগ্র সমাজকে যুক্ত করা, রাজনৈতিক শূন্যতার নিরসন করা, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয়, জঙ্গিবিরোধী গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো, প্রয়োজনে র্যাবকে শুধু জঙ্গিবিরোধী কাজে নিয়োজিত রাখাসহ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘দেশে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বাড়িয়ে বলা যেমন উচিত নয়, তেমনি কমিয়ে বলারও সুযোগ নেই। দরকার প্রকৃত তথ্য জনগণকে জানানো এবং জঙ্গিবিরোধী কাজে সবার একাত্মতা। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী তা প্রশংসিত হয়েছে। জঙ্গি প্রতিরোধেও আমাদের হেরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সে জন্য কর্মপন্থা কী হওয়া উচিত, কোন কোন ক্ষেত্রে কাজে জোর দেওয়া দরকার, সে সম্পর্কে জানাই এই আলোচনার উদ্দেশ্য।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কাজকর্ম ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। সরকারের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক রকম বক্তব্য দেওয়ায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা যে এ দেশে তৎপর তা সবারই জানা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, সমগ্র সমাজে এর বিস্তার ঘটছে। এর সঙ্গে মূলধারার রাজনীতিকেও যুক্ত করা হচ্ছে। দুই বিদেশি নাগরিক হত্যায় একই ধরনের অস্ত্র ও গুলি ব্যবহৃত হওয়ার তথ্যও গভীর উদ্বেগের। কারণ এতে প্রমাণিত হয়, হত্যাকাণ্ড দুটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিসারি ও একই গোষ্ঠীর কাজ। তা ছাড়া, ওই নির্দিষ্ট অস্ত্র খুব বেশি দেশ তৈরি করে না।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, এ দেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সামান্য। এখানে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কভুক্ত জঙ্গি নেই বলেই ধারণা করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের প্রভাব এ দেশের জঙ্গিদের ওপরও পড়ে। মূলত এরা দেশেই গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করায় দেশে এদের বিস্তার ঘটেছে সহজে। বর্তমানে বৈশ্বিক বাস্তবতায় জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা ও সমন্বয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দেশে অনেকগুলো ছোট ছোট জঙ্গি গ্রুপ রয়েছে উল্লেখ করে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইশফাক এলাহী বলেন, তাঁদের মধ্যে মতভিন্নতা আছে। তবে মূল লক্ষ্য অভিন্ন। এদের প্রতিরোধের কৌশল কী হবে, তা নির্ধারণ করা জরুরি। এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হয়ে কিংবা সন্দেহভাজন হিসেবে যতগুলো জঙ্গি ধরা হয়েছে, তাদের বিচার হয়নি। দেশে আইএসের অস্তিত্ব প্রমাণিত না হলেও এখানকার জঙ্গিরা যে আইএসের দ্বারা অনুপ্রাণিত, তা বোঝা যায়। আইএসের মতোই তাদেরও লক্ষ্য মূলত অমুসলিম, মাজারকেন্দ্রিক পীর-দরবেশ ও অন্য ধর্মীয় নেতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক এ এস এম আলী আশরাফ বলেন, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা এ দেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। আইএস-বিরোধী আন্তর্জাতিক উদ্যোগে প্রায় ৬০টি দেশ যুক্ত। ইতালি ও জাপান এর মধ্যে আছে। সেদিক থেকে ওই দুই দেশের দুই নাগরিক হত্যা একটি নতুন ইঙ্গিতবহ হতে পারে। এ দেশের জঙ্গিরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া প্রতিহত ও রাজনৈতিক সহিংসতায় অংশ নেয় বলে ধারণা করা হয়। এসব বিষয় গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখা দরকার। পেশাদার অপরাধ তদন্ত অব্যাহতভাবে পরিচালনা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
গত এক বছরে জঙ্গিরা বিশ্বে মোট ৩৩ হাজার মানুষ হত্যা করেছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ফয়েজ সোবহান বলেন, এ দেশের হুজি, জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের যোগসাজশ থাকতে পারে। একই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও এদের সম্পৃক্ততা আছে বলে জানা যায়। তাই এরা আতঙ্কের পরিবশে সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, বিদেশি বিনিয়োগ, পর্যটন প্রভৃতি বাধাগ্রস্ত করা এবং জঙ্গি তৎপরতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকতে পারে। রাজনৈতিক স্বার্থবাদী কোনো গ্রুপেরও এই ধারায় সম্পৃক্ত থাকা অস্বাভাবিক নয়। এদের সবার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটা চক্র সক্রিয় আছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের বিশেষায়িত অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর টেররিজম রিসার্চের গবেষক শাফকাত মুনির বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছাড়া কোনো দেশে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর টিকে থাকতে পারার কথা নয়। এ দেশে পাকিস্তানি, থাই ও মিয়ানমারের সন্ত্রাসীদের আনাগোনার রেকর্ড আছে। আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি গোষ্ঠীও এখানে গড়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কিছু না কিছু সংযোগ থাকাও অস্বাভাবিক নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, এ দেশে গত আশির দশকে সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের যাত্রা শুরু হয়। তাই যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করাসহ রাজনৈতিক প্ররোচনায় এদের ব্যবহৃত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এর সঙ্গে বিপুল অর্থও জড়িত। তবে কোনো ঘটনা ঘটলেই আইএসকে টেনে আনা সঠিক নয়। এ-সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য খুঁজতে হবে।
সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, জঙ্গি তৎপরতার উদ্দেশ্য দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজনৈতিক সমঝোতা ও সবার একাত্মতা দরকার। গণমাধ্যমের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ববহ।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, অস্ট্রেলিয়ার খেলতে না আসা, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা, আমেরিকান ক্লাব-স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা প্রভৃতি এক সূত্রে গাঁথা। এর সঙ্গে আইএস জড়িত বলার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে জঙ্গিবিরোধী অবস্থান নিতে হবে। জঙ্গিদের সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালাতে হবে।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, দেশের জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কয়েক দশকের। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের গঠিত ফ্রিডম পার্টির কয়েক শ নেতা-কর্মী লিবিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন। জঙ্গি সংগঠন হুজি গঠন করে আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়ে ফিরে আসা জঙ্গিরা। এরাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। সেই অস্ত্রের উৎসও ছিল বিদেশ। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে থাইল্যান্ডে বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত জঙ্গির বাংলাদেশে আসা ও অবস্থানে এ দেশের জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক যোগযোগের প্রমাণ মেলে।
বিআইআইএসের শাহিন আকতার বলেন, এ দেশে আইএসের অস্তিত্ব আছে এমন কোনো তথ্য নেই। এ ধরনের প্রচার দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। তাই এ থেকে বিরত হওয়া এবং প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করা উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ১১:০১:৪৬ ৩১৯ বার পঠিত