শনিবার, ৩ অক্টোবর ২০১৫

বাংলাদেশ রেলওয়ের ১৫জন নারী এখন ট্রেন চালায়.

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » বাংলাদেশ রেলওয়ের ১৫জন নারী এখন ট্রেন চালায়.
শনিবার, ৩ অক্টোবর ২০১৫



158419_1

বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ

কেউ তাঁদের দেখে বিস্মিত হন। কেউ মুগ্ধ। কারও কারও তো আবার প্রশ্নের শেষ নেই। কেউ কেউ জানতে চান, ‘এত সাহস হলো কী করে আপনাদের?’ তাঁরা সবাই ট্রেনের সহকারী লোকোমাস্টার (এএলএম) বা সহকারী ট্রেনচালক। এই দেশে যখন নারীদের নানা বাধাবিপত্তিতে পড়তে হয়, তখন তাঁরা সাহসের সঙ্গে ছুটে বেড়ান রেলগাড়ি চালিয়ে। ফলে সাধারণ মানুষদের অবাক হওয়ারই কথা। বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেল, বর্তমানে রেলওয়েতে ট্রেন চালনায় ১৫ জন নারী আছেন। এর মধ্যে সালমা খাতুন বাংলাদেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক। তিনি এখন ঢাকায় লোকোমাস্টার। বাকিরা এখনো সহকারী লোকোমাস্টার। প্রতিটি ট্রেনে একজন মূল চালকের সঙ্গে এএলএম থাকেন। এএলএম থেকে লোকোমাস্টার বা পূর্ণাঙ্গ চালক হতে সময় লাগে কমপক্ষে ১০-১২ বছর। কেবল ট্রেন চালনাই নয়, তাঁদের ট্রেনের ইঞ্জিনের যান্ত্রিক ও তড়িৎ (মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল) দিকগুলো শিখতে হয়। জানতে হয় সিগন্যালব্যবস্থা থেকে শুরু করে ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণসহ ছোটখাটো মেরামতের কাজও। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরুষের পাশাপাশি সব ধরনের কাজ শিখলেও এখনো দূরের রাস্তায় নানা কারণেই আমরা মেয়েদের পাঠাতে পারছি না। অথচ তাঁরা সেটিও পারবেন। মেয়েদের যেমন এই পেশার চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে, তেমনি সমাজের সবাইকেও ইতিবাচক মনোভব পোষণ করতে হবে।’ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে চারজন এএলএম আছেন লালমনিরহাটে। তাঁরা হলেন আফরোজা বেগম, ফরিদা আক্তার, নাছরিন আক্তার ও মুনিফা আক্তার। চট্টগ্রামে আছেন ছয়জন-সালমা বেগম, খুরশিদা আক্তার, উম্মে সালমা সিদ্দীকা, কুলসুম আক্তার, রেহানা আবেদিন ও কোহিনুর আক্তার। কৃষ্ণা সরকার আছেন পাবনার ঈশ্বরদীতে। তাঁরা সবাই যোগ দিয়েছিলেন ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। আর ২০১৪ সালে বেবি ইয়াসমিন, ছিপি খাতুন ও এ্যানি যোগ দিয়েছেন রেলওয়েতে। তাঁরা রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে কাজ করছেন। প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, তাঁরা এই পেশাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। এঁদের কয়েকজনের কথা থাকছে এই প্রতিবেদনে। পথ দেখিয়েছেন সালমা ট্রেনচালক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম সহকারী লোকোমাস্টার পদে যোগ দেন টাঙ্গাইলের সালমা খাতুন। এখন তিনি সাব-লোকোমাস্টার। কিছুদিনের মধ্যেই লোকোমাস্টার হয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চালাবেন সালমা। চ্যালেঞ্জিং পেশায় কাজ করার আগ্রহ তাঁর ছোটবেলা থেকেই। প্রিয় খেলনা ছিল ট্রেন, সেই থেকেই ট্রেনের প্রতি ভালোবাসা। সালমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথাগত পেশার বাইরে কিছু করার স্বপ্ন ছিল। তবে কাজটি সহজ নয়। রেলওয়েতে বাবার চাকরির সুবাদে এ পেশা সম্পর্কে আমি আগে থেকেই জানতাম। আমি আমার কাজটাকে ভালোবাসি। ভালো লাগে এই কারণে যে আজ আরও অনেক মেয়ে আসছেন। যত বেশি মেয়ে এ পেশায় আসবেন, তত তাড়াতাড়ি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে।’ প্রথম নারী চালক হিসেবে কেমন লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন কমলাপুরে কাজ করছি। কোনো ট্রেন এলে ইঞ্জিন খুলে সেটি চালিয়ে আরেকটাতে লাগাই। লোকজন তখন বিস্ময় নিয়ে দেখে। অনেক পুরুষ তাঁদের স্ত্রীদের দেখান। তবে এ কাজটা কিন্তু চ্যালেঞ্জের। আমি সেই চ্যালেঞ্জটাই উপভোগ করি।’ প্রশ্নের শেষ নেই নরসিংদীর মেয়ে সালমা বেগম ছোটবেলা থেকেই সাহসী। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে যোগ দেন এএলএম হিসেবে। তবে এখনো লেখপাড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রাম কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন। প্রায়ই ডেমু ট্রেন নিয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সালমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সপ্তাহে চার দিন, মাঝেমধ্যে পুরো সপ্তাহই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেমু নিয়ে যাই। আমাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের প্রশ্নের শেষ নেই। তাঁরা জানতে চান মেয়ে হয়েও এত সাহস পাই কী করে?’ কী করে আসলে সাহস পান জানতে চাইলে সালমা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি একটু সাহসী। অন্য ভাইবোন কিংবা কাজিনরা যেটা করতে সাহস পেত না, আমি সেটা করতে পারতাম।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ভালো লাগে ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে এএলএম হয়েছেন চাঁদপুরের মেয়ে কুলসুম আক্তার। তাঁরও চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল। তবে রেলওয়েতে যোগ দেবেন এমনটা ভাবেননি। তিনি বলেন, ‘নানা জায়গায় চাকরির আবেদন করেছিলাম। এখানে হয়ে গেল। মনের মতো কাজ পেলাম।’ পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছেন রেলেরই এএলএম গোলাম মোস্তফাকে। দেড় বছরের একটি মেয়ে আছে তাঁদের। ডেমু ট্রেন নিয়ে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে মাঝেমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। এত শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে খুব ভালো লাগে তাঁর। ছোট মেয়ের বড় দায়িত্ব দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বাড়ি নাছরিন আক্তারের। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট্ট এই মেয়েটি এখন রেলের সহকারী চালক। ডিগ্রি পাস করে তিনি এই কাজে যোগ দিয়েছেন। নাছরিন বলেন, ‘ট্রেনে থাকার খুব বেশি সুযোগ পাই না। বেশির ভাগ কাজ অফিসেই। তবে নতুন যে ডেমু ট্রেন আসছে, সেটার সহকারী চালক হিসেবে কয়েকবার লালমনিরহাট থেকে পার্বতীপুর গিয়েছি। আমার পাঁচ বছরের মেয়েটাকেও কয়েকবার আমার সঙ্গে নিয়েছি। ও খুব উপভোগ করে।’ মানুষের অনেক আগ্রহ কুমিল্লার মেয়ে রেহানা আবেদিনের বেড়ে ওঠা ট্রেনের সঙ্গেই। নানা ছিলেন রেলের লোকোমাস্টার। বাবাও রেলের কর্মকর্তা। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে নিজেও চলে এলেন রেলে। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরেও বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করেছেন। মাঝেমধ্যেই ট্রেনে সহকারী চালক হিসেবে থাকেন। কেমন লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিয়ে মানুষের অনেক আগ্রহ।’ মনে হলো আমিও পারব নড়াইলের লোহাগড়ার মেয়ে কৃষ্ণা সরকার। তিন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। যশোর সরকারি মহিলা কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে তিনি এসেছেন এই পেশায়। এখন কাজ করছেন পাবনার ঈশ্বরদীর লোকোশেডে। স্নাতকোত্তর নিয়েও কেন এই পেশায় এলেন? কৃষ্ণা বলেন, ‘আমি আসলে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখার আগে এ সম্পর্কে জানতাম না। কিন্তু খবরের কাগজে পড়েছিলাম সালমা আপার কথা। মনে হলো আমিও পারব। আমি মনে করি শিক্ষিত লোকজন এই পেশায় এলে মানুষের শ্রদ্ধা আরও বাড়বে।’ ছোটবেলার বড় ট্রেন এখন আর বড় নয় চট্টগ্রামের মেয়ে উম্মে সালমা সিদ্দিকী স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। এ বছর স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেবেন। তাঁর বাসা ষোলশহরের রেলস্টেশনের খুব কাছেই। বললেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ট্রেন দেখছি। তখন অনেক বড় মনে হতো একেকটা ট্রেনকে। এখন যখন ট্রেনের সহকারী চালক হিসেবে থাকি, তখন আর এত বড় মনে হয় না।’ লোকজনের বিস্ময় উপভোগ করি আফরোজারা চার বোন। রেলওয়েতেই ছিলেন, ২০১১ সালে পরীক্ষা দিয়ে এএলএম হয়েছেন আফরোজা। বিভাগীয় পরীক্ষার্থী হিসেবে এই পদে আসা একমাত্র নারী তিনিই। বাড়ি লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগরে। প্রশিক্ষণ শেষে লালমনিরহাট থেকে পার্বতীপুর তিনি ট্রেন চালাতেন। এখন লালমনিরহাটেই আছেন। তিনি বলেন, ‘অনেকে চালকের স্থানে একজন নারীকে দেখে বিস্মিত হন। এই বিস্ময় উপভোগ করি। অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা জানতে চায় কাজটা কেমন? আমিও উৎসাহ দিই।’ আফরোজার স্বামীও ট্রেনচালক। তবে স্বামী-স্ত্রী এখনো একসঙ্গে কোনো ট্রেন চালাননি বলে হাসিমুখে জানান আফরোজা। একটুও ভয় লাগে না ২০১২ সালে যে ৫৩ জন এএলএম যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন নারী ফরিদা আক্তার। প্রশ্ন করেছিলাম এত বড় ট্রেন চালাতে ভয় লাগে না? বগুড়ার এই মেয়েটি জানান, একটুও না।

বাংলাদেশ সময়: ২১:০২:০১   ২৬৪ বার পঠিত