সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫
পে-স্কেল ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
Home Page » প্রথমপাতা » পে-স্কেল ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানবঙ্গনিউজ ডটকমঃ আইনগত অধিকার না থাকায় বেসরকারি শিক্ষকদের তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্তির জন্য রাষ্ট্রের করুণার ওপর নির্ভর করতে হয়। এটি একেবারেই অনভিপ্রেত। বেসরকারি শিক্ষকেরা বাড়িভাড়া পান ৫০০ টাকা। এ টাকায় বাড়িভাড়া তো দূরের কথা বাড়ির বারান্দাও পাওয়া সম্ভব নয়। চিকিৎসাভাতা পান ৩০০ টাকা। তা নিন্তাতই অপ্রতুল এবং উৎসবভাতা পান স্ব স্ব স্কেলের ২৫ ভাগ। বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকেরা শিক্ষাভাতা, টিফিনভাতা ও পাহাড়িভাতা পান না। পুরো চাকরি জীবনে মাত্র একটি ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকেন। তাদের পদোন্নতির কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি কলেজে এমন অনেক মেধাবী শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন যাদের এসএসসি থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যন্ত অনেক বিষয়ে প্রথম শ্রেণী রয়েছে। অনেকের এমফিল ও পিএইচডি আছে।
উচ্চ ডিগ্রি থাকার পরও প্রভাষক হিসেবে জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। বেসরকারি কলেজে পদোন্নতির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন এই সম্মানিত পেশায় আসতে অনীহা প্রকাশ করেন। পৃথিবীর কোনো উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এমন বৈষম্য নেই। শিক্ষামন্ত্রী দীর্ঘ দিন থেকে শিক্ষকদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেয়ার ঘোষণা দিয়ে আসছেন। কিন্তু তার এই ঘোষণা ঘোষণা হিসেবেই থাকল, আলোর মুখ দেখল না। সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল, মর্যাদাবোধ, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্টস পাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেছেন। সম্মানিত শিক্ষকদের এ আন্দোলন অত্যন্ত যৌক্তিক বলে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরা মনে করেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আর এম দেবনাথ সম্প্রতি দৈনিক যুগান্তরে তার এক নিবন্ধে লিখেন, একজন হাইস্কুলের শিক্ষক তাকে জানালেন নির্দিষ্ট ডিগ্রি নিয়ে হাইস্কুলে একজন শিক্ষক এখন যোগদান করলেই ২০-২৫ হাজার ভারতীয় রুপি পান, যা চাকরিতে যোগদান করলে বাংলাদেশের একজন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকও পান না। তাই এই স্বাধীন দেশের একজন শিক্ষক তার জন্য নির্ধারিত সম্মানীর মাধ্যমে পরিবারের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা না পেয়ে হতাশায় আত্মহত্যা করেন। কিংবা এই মহান পেশা ছেড়ে দিয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে অন্য কোনো পেশায় জড়িয়ে যান। তখন স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কথা। এ জন্য অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী করতে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অবশ্যই সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই দেশে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি হবে এবং যোগ্য সুনাগরিক প্রত্যাশা করা যায়।
প্রায় তিন দশকের যুদ্ধে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬.৬ শতাংশ বিনিয়োগ করে প্রতিযোগিতায় বিশ্বে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেখানে আমাদের বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন মাত্র ২.২ শতাংশ, জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ ও জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করলে আমরা সার্কভুক্ত দেশের সাথে পাল্লা দিতে পারব। ইউনেস্কোর হিসাব অনুসারে শিক্ষা খাতের ব্যয় ৬.৬ শতাংশ হওয়া উচিত। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষা খাতে বাজেটের ২১ শতাংশ বরাদ্দ থাকত। এখন তা কমিয়ে ১১ শতাংশে নামানো হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালের বাজেটে মোট বাজেটের ১১.৬৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে শিক্ষা খাতে। এই বরাদ্দ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়- এ দুই মন্ত্রণালয়ে বণ্টন করা হয়েছে, যদিও মোট পরিমাপের দিক থেকে শিক্ষা বাজেট বেড়েছে, কিন্তু শতাংশ হিসাবে শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দের হার গত পাঁচ অর্থবছরে ক্রমাগত কমেছে। গত ২৬ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে চট্টগ্রাম মহানগরের একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেন, আমি যখন দায়িত্ব নিই তখন শিক্ষা বাজেট ছিল শতকরা ১৪ ভাগ। পরের বছরে তা কমে হয় ১৩ ভাগ এখন সেটা ১১ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে যখন শিক্ষা বাজেট বাড়ছে আমাদের তখন ক্রমেই কমতে শুরু করেছে। অথচ দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষাকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল। কারণ শিক্ষা একমাত্র দেশকে পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্ত করতে পারে। শিক্ষামন্ত্রী প্রায়ই বলেন, আমরা শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন দিতে পারি না।
ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট দেশজ সম্পদের ৪ শতাংশের বেশি, ভুটানে ৫ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৮ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ১২ শতাংশ, ব্রাজিল ও চিলিতে ৪ শতাংশের মতো। শিক্ষা খাতে ব্যয় সঠিকভাবে ব্যয়িত হলে তা দেশের উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করে এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় দক্ষ মানবসম্পদের কেবল জোগান দেয় না বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সঠিক মাত্রার মানবসম্পদ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও ভাষাগতভাবে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। আর এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাস্তবায়ন করবেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকেরা। তাই এই পাঁচ লাখ বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে কখনোই সরকারের এই মহৎ উদ্দেশ্য সফল হবে না। বেসরকারি শিক্ষকদের নতুন বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত না করলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন, রাষ্ট্র এবং সমাজে সব পেশার মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হবেন। ফলে তারা ক্লাসে ঠিকমতো মনোযোগ দিয়ে পাঠদান করতে পারবেন না। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। শিক্ষকেরা স্কুল, কলেজে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য রাস্তায় নেমে আসবেন এবং বর্তমান সরকারের এই অযৌক্তিক ও হটকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রবল জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। বর্তমান সরকারের জন্য তা কখনোই সুখকর হবে না। আমরা বেসরকারি শিক্ষকসমাজ চাই না, সরকার কোনো অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে এমন কোনো হটকারী সিদ্ধান্ত যেন না নেয়। -
বাংলাদেশ সময়: ২০:২২:২৯ ৩২০ বার পঠিত