মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট ২০১৫

ইনি পন্থায়ই আইনের প্রয়োগ হতে হবে

Home Page » বিবিধ » ইনি পন্থায়ই আইনের প্রয়োগ হতে হবে
মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট ২০১৫



অলংকরণ: তুলিবঙ্গনিউজ ডটকমঃ অলংকরণ: তুলিঅ্যাকশন শুরু। একটি পত্রিকার শিরোনাম। মাত্র কদিন আগে ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের দুজন নেতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া-সংক্রান্ত। এ ধরনের অন্য প্রায় সব ঘটনার মতো এখানেও স্বজনেরা বলছেন, তাঁদের ধরে নিয়ে হত্যা করে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজানো হয়েছে। সরকারি দল ও তার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের স্থানীয় নেতারা বলছেন, তাঁরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে মেনে নেবেন না। তবে সরকারের এক দায়িত্বশীল মন্ত্রী, যিনি দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাও বটে; এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। যদিও মন্ত্রী পরে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিনি নির্দিষ্ট ঘটনা নিয়ে ও কথা বলেননি। বলেছেন সাধারণভাবে।
এ দুটি ঘটনায় নিহত একজন রাজধানীর হাজারীবাগ থানার। তিনি চুরির অভিযোগে একজন কিশোরকে পিটিয়ে মারার প্রধান আসামি। অপরজন মাগুরার। নিজ সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে নিজদের মাঝে গুলিবিনিময়ের সময় একজন বৃদ্ধ নিহত এবং মাতৃগর্ভে একজন শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় তিনি আসামি। এ-জাতীয় ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি-সংকটের ক্ষেত্রে সরকার নিজ দল-সমর্থক কাউকেও ছাড় না দেওয়ার কঠোর মনোভাব নিয়েছে বলে জানা যায়। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনা এরই বহিঃপ্রকাশ বলে সংবাদ বিশ্লেষকেরা ধরে নিচ্ছেন। এর পরদিনই কুষ্টিয়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন একজন যুবলীগ নেতা। এরপরও এ ধরনের ঘটনা চলছে এবং নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে থাকছেন সরকার-সমর্থক ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
সংবাদপত্র সূত্রে আরও জানা যায়, শাসক দলের অপরাধীদের তালিকা করছে পুলিশ। এ ব্যাপারে সব জেলায় পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনাও পাঠিয়েছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে আরেকটি গুরুত্ববহ মন্তব্য এসেছে ঢাকার একজন প্রভাবশালী সাংসদের পক্ষ থেকে। তাঁর মতে, হাজারীবাগে নিহত ছাত্রলীগ নেতাকে বন্দুকযুদ্ধে নয়, গ্রেপ্তারের পর হত্যা করা হয়েছে। এ বক্তব্যের সমর্থনে ক্ষমতাসীন দলের আরও নেতা একই রকম মন্তব্য করছেন। এসব খবর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং জনগণের নজর কাড়ে।
সরকারি দল আর এর সমর্থক ছাত্র, যুব কিংবা অনেক সংগঠনের বেশ কিছু নেতা-কর্মী, এমনকি সাংসদ স্থানীয় পর্যায়ে আইনের শাসনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা দেখাচ্ছেন না, অনেক ক্ষেত্রেই। তাঁরাই বেশ কিছু ক্ষেত্রে কার্যত নিেজদের একটি সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা চালু করেছেন। কেউ সরকারি কর্মকর্তাকে কর্তব্যকাজে বাধা দিচ্ছেন, কেউ বা করছেন মারধর। কেউ রিভলবার নিয়ে ভয় দেখান। কারও বিরুদ্ধে বা অভিযোগ থাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জমি দখল কিংবা বিহারি ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগে ইন্ধন দেওয়ার। আর অনেকেই সরকারি কর্মচারীদের চাপের মুখে রেখে নিজদের বেআইনি অসাধু উদ্দেশ্য সাধনে রয়েছেন তৎপর। এগুলো সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের অজানা থাকার কথা নয়। এসবের ফলে সরকারের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। দেরি অনেক হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও স্বাগত জানাতে হয় ‘অ্যাকশন শুরুর’ উদ্যোগটিকে। তবে বিতর্ক থাকবে অ্যাকশন কীভাবে নেবে তা নিয়ে।
২০০৪ সাল থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অপরাধ দমনে ক্ষেত্রবিশেষে বিচারবহির্ভূত হত্যা করে-এমন অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের অভিযানে নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার নামে পরিচিতি পেয়েছে। এটা সত্য, এ-জাতীয় অভিযানে নিহত বেশ কিছু ব্যক্তি গুরুতর অপরাধীরূপে সমাজে পরিচিত ছিল। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তাও পায় এসব ঘটনা। তবে সচেতন মানুষের অবস্থান সব সময় এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে। আর তারা সরকারি বা বিরোধী দল কিংবা নির্দলীয় যা-ই হোক, সব ক্ষেত্রে। তবে আমাদের দেশে বিচার-প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় নেয়। কোনো কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনের ফাঁকে জামিনও পেয়ে যায়। এতে হতাশ হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সাধারণ জনগণ। এরই ফলে এরূপ ঘটতে পারে বলে মনে করা হয়।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যের ওপর ক্ষেত্রবিশেষে হামলা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা পাল্টা হামলা চালাবেন, এতে ভিন্নমত নেই। তবে যাকে গ্রেপ্তার করা হলো, তার জীবন রক্ষা তাঁদের দায়িত্বের অংশ, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে আইনের আওতায় গ্রেপ্তার, তদন্ত ও বিচারের ওপর সবারই আস্থা রাখা সংগত। আইনের অনুশাসন মেনেই বিচার হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার। তেমনি জেএমবি সন্ত্রাসীদেরও। একইভাবে বিচার চলছে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের। এসব তদন্তকাজে তো সংশ্লিষ্ট ছিলেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। তাহলে দেশে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, সম্পত্তি দখল, টেন্ডারবাজির মতো অপরাধ যারা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনের আওতাতেই তো ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আর তা নিতেও হবে। বিচারবহির্ভূত কোনো প্রক্রিয়াকে নৈতিক সমর্থন দেওয়ার পরিণতি নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার মতো বিয়োগান্ত অনেক কিছু হতে পারে। এ ধরনের কিছু ঘটনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অনেক ভালো কাজ ম্লান হয়ে যায়।
রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ বা সমর্থক সংগঠনগুলোর বেআইনি কার্যকলাপ চোখে পড়ার মতো। যখন যারা সরকারে থাকছে, তাদের সমর্থকেরাই তা করছে। আর দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে এর আকৃতি ও প্রকৃতি। এই সংস্থাগুলোর নেতা-কর্মীরা ঢাল হিসেবে কিন্তু পেয়ে যান স্থানীয় এক বা একাধিক নেতাকে। তাঁরা একে অপরের স্বার্থের পরিপূরক। এভাবে জোট বেঁধে অপরাধমূলক কাজের মাধ্যমে নিজেরা অঢেল বিত্তের অধিকারী হচ্ছেন। আর অনেকটা এসব কারণেই পদ দখলের প্রতিযোগিতা চলে। তা করতেই সময়ে সময়ে চলে টাকার খেলা; এমনকি প্রাণঘাতী সংঘর্ষ। এ অসাধু চক্রটি শুধু চলমান থাকছে না, ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করছে। এই শক্তিবলয়ে আইনানুগ পন্থায় অবিরাম আঘাত করার বিকল্প কিছুই নেই। আর সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলে এটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার রয়েছে। সেসব সংস্থার যেসব অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এদের সহায়ক রূপে চিহ্নিত আছেন বা হবেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সচরাচর এ-জাতীয় অ্যাকশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রথাসিদ্ধভাবে সরকারবিরোধী কিংবা মানবাধিকার-সংক্রান্ত সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেই আসত। অতি সাম্প্রতিক কালের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, এতে যুক্ত হয়েছেন সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা সমর্থকরূপে চিহ্নিত ব্যক্তিরাও। অতীতে এমনটা ঘটেনি। এটা ভালো দিকই বটে। তেমনটি আমরা দেখলাম সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে নাজেহাল করার ঘটনায়ও। দলীয় আনুগত্যের প্রাচীর ডিঙিয়ে এখানে প্রতিবাদ করেছেন সরকারি দলের অনেক নেতা-কর্মী। নাগরিক সমাজের একটি অংশও এতে যোগ দিয়েছে। এ প্রতিবাদ যথোপযুক্ত ও ন্যায্য। ত্বরিত সুফলও পাওয়া গেছে। ঠিক তেমনি সরকারবিরোধী দলের কাউকে এরূপ নিগ্রহের ঘটনায় এমনই প্রতিবাদ হওয়া উচিত।
মূল আলোচ্য বিষয়ের একটি ছোট সংবাদের কিছু বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। খবরটি হচ্ছে সরকারি দল-সমর্থিত যেসব ক্যাডার বেপরোয়া অপরাধ কর্মকাণ্ড শুরু করেছে, তাদের তালিকা তৈরি করছে পুলিশ। যা-ই হোক ধরে নিতে হয়, সরকার চাইছে দলমত-নির্বিশেষে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে। এই সংবাদটি উৎসাহজনক। প্রতিকূল বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে এটার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে অপরাধজগৎকে শিগগিরই লাল সংকেত দেখানো যাবে, এতে সন্দেহ নেই। তবে অতীত অভিজ্ঞতা সে আস্থার ভিতে চিড় ধরিয়ে দেয়। অনেক অভিযান হয়েছে। অন্তত ২০০৪ সাল থেকে চলা অভিযানগুলোর ধারাবাহিকতা না থাকায় স্থায়ী রূপ পায়নি এর সুফল। বরং সময়ে সময়ে অপরাধজগৎ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আর সেই অপরাধীদের মাঝে শুধু তৃণমূল পর্যায়ে দু-চারজন কর্মী নন। নেতাও রয়েছেন কেউ কেউ। তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা দুঃসাধ্য কোনো কাজ নয়। কিন্তু আইন প্রয়োগের কাজটি হতে হবে আইনি পন্থায়। আর যা-ই হোক, বেআইনিভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫৮:৫০   ২৪৫ বার পঠিত