মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট ২০১৫

টেরাকোটা

Home Page » সাহিত্য » টেরাকোটা
মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট ২০১৫



বঙ্গনিউজ ডটকমঃটেরাকোটা ইতালির শব্দ যুগল। টেরা অর্থ মাটি এবং কোটা অর্থ দগ্ধতাই টেরাকোটা হচ্ছে পোড়ামাটির শিল্প। আমাদের দেশের পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি এসব স্থানে এ শিল্পের বহু নিদর্শন শিল্পরসিকদের প্রশংসা কুড়িয়ে আসছে বহুকাল থেকেই। 

টেরাকোটায় দৃশ্যমান রাম-রাবণ, রাধাকৃষ্ণ, শিব-দুর্গা,কালী-স্বরসতী, লক্ষ্মী নারায়ণসহ বিভিন্ন ফুল-ফল-পাতা, পালকি আর পশুপাখির মূর্তি। এগুলো বেশির ভাগই ছাঁচে তৈরি। কোনো কোনো মূর্তি আবার হাতেও তৈরি। রাজশাহী, দিনাজপুর, নাটোর, পাবনা, ফরিদপুর, যশোর, বরিশাল, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে এসব শিল্প নিদর্শন দেখা যায়। পোড়ামাটির এই শিল্পকর্মে রঙের ব্যবহার খুবই চোখে পড়ে। 
আধুনিককালের শিল্পীদের শিল্পকর্ম সূক্ষ্ম ও মসৃণ। দেশের অনেক জায়গায় পাথর দুষ্প্রাপ্য। ফলে লোকশিল্পীরা সহজ প্রাপ্য মাটির ওপর নির্ভর করেছে স্বাভাবিকভাবেই। লোকশিল্পীরা হাতের কাছে পাওয়া মাটি দিয়ে বিভিন্ন মূর্তি তৈরি করে শুকানোর পর তা রঙ করেছে এবং শিল্পকর্মগুলোকে স্থায়িত্ব দান করার জন্যই পরে পোড়ানো হয়েছে। এর ফলে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম পেয়েছে দীর্ঘস্থায়ী রূপ। 
চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলার বহু মসজিদে ও মন্দিরে টেরাকোটার শিল্পকর্ম দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে আউলিয়া মসজিদ, গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ, বিবিচিনি শাহী মসজিদ, বাবা আদম মসজিদ, বাঘা মসজিদ, পাবনার জোড়বাংলা মন্দিরের কথা বলা যায়। লোকজীবনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে গৌরবমণ্ডিত টেরাকোটা শিল্প। তবে আলোচিত টেরাকোটা শিল্প ছিন সম্রাটের সমাধির সৈনিক ও ঘোড়া। কৌতূহল জাগে ছিন সম্রাটের সমাধির সৈনিক ও ঘোড়ার টেরাকোটা কিভাবে তৈরি করা হয়?
১৯৮৯ সালে চীনের সমাজ একাডেমির প্রতœতত্ত্ব গবেষণালয়ের হান রাজবংশের ছাংআন-বিষয়ক কর্মদল সিনআন শহরের লিউছুনফু থানার একটি সবজির জমিতে প্রতœতাত্ত্বিক জরিপের খননকাজ চালানোর সময় প্রায় ২১০০ বছর আগে পশ্চিম হান রাজবংশ আমলের একটি বিরাট আকারের সৈনিক ও ঘোড়া আকারের টেরাকোটা পোড়ানোর ২১টি ভাঁটি আবিষ্কার করেছে এবং এতে কয়েক হাজার উন্নতমানের টেরাকোটা পাওয়া গেছে। এটা সম্রাট এবং সরকারের জন্য সমাধিতে ব্যবহার্য সৈনিক ও ঘোড়ার টেরাকোটা পোড়ানোর সরকারি ভাঁটি। এসব সরকারি ভাঁটির আকার খুবই বড়, উৎপাদন খুব বেশি ছিল। এগুলোর দুটি ভাঁটিতে ভরা ছিল পোড়ানোর আগে মাটির সৈনিক ( যেগুলো পোড়ানো হলেই টেরাকোটা হবে) ,প্রত্যেক ভাঁটিতে ছিল ৩৫০ থেকে ৪০০টি। মোট ২১টি ভাঁটিতে পোড়ানোর মাধ্যমে প্রত্যেকবার ৭৩৫০ থেকে ৮৪০০টি বিরাট আকারের টেরাকোটা তৈরি করা যায়। তাই এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ছিন আর হান রাজবংশের আমলে সৈনিক ও ঘোড়ার টেরাকোটা উৎপাদনের পরিমাণ খুবই বিরাট। 
এই খননকাজ থেকে জানা গেছে, সৈনিক ও ঘোড়ার টেরাকোটার শরীরের বিভিন্ন অংশ (কাদামাটি দিয়ে তৈরি) ছাঁচে গড়া হয়, তবে মুখের অংশ পোড়ানোর আগে ভাস্কর্য কর্মের মতো খোদাই করতে হয়। এসব নরম মাটির মূর্তি পোড়ানোর আগে যথাযথভাবে রঙ লাগানো হয় না, বরং সাধারণত মাটি পোড়ানোর পরই কেবল সাদা ইত্যাদি রঙ লাগিয়ে সৈনিকের সাদা পোশাকের রঙ হয়। ভাঁটিতে পোড়ানোর সময় মাটির সৈনিক ও ঘোড়া যেভাবে সাজিয়ে রাখা হয়, তাও আমাদের কল্পনার বাইরে। অর্থাৎ সেগুলো উল্টা করে রাখা হয় : পা উপরের দিকে এবং মাথা নিচে রাখা হয়। 
আসলে এভাবে সাজিয়ে রাখার পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত, কারণ মানুষের উপরের অংশ নিচের অংশের চেয়ে বেশি ভারী, মাথা নিচে রাখা হলে পোড়ানোর সময় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। 
এতে প্রমাণ হয়েছে, দুই হাজার বছর আগেই চীনা জনগণ এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আয়ত্ত করেছেন। 
ছিন সম্রাটের সমাধির সৈনিক ও ঘোড়ার টেরাকোটা আবিষ্কৃত হওয়ার পর আমাদের লোক প্রথম দিকে এসব টেরাকোটার অনুকরণ করে অনুরূপ ধরনের টেরাকোটা তৈরির প্রচেষ্টা করার প্রথম দিকে এই পদ্ধতি আয়ত্ত করেননি বলে, ভাঁটিতে মাটির ঘোড়ার পা নিচের দিকে রেখেছিলেন এবং পোড়াবার প্রক্রিয়ায় সেগুলো বারবার ধসে পড়েছিল এবং অনুকরণমূলক উৎপাদনের প্রয়াস বারবার ব্যর্থ হয়েছিল। 
তা ছাড়া ছিন রাজবংশের আমলে যেসব কুমোর, শ্রমিক বা মিস্ত্রি টেরাকোটা বানিয়েছেন, তারা তাদের নাম টেরাকোটায় ছাপিয়েছেন বা খোদাই করেছেন , যাতে তাদের কাজের পরিমাণ ও গুণগত মান সহজেই পরীক্ষা করা যায় এবং গুণগত মান সুনিশ্চিত করা যায়। এই ব্যবস্থা নেয়ার ফলে আজ প্রচুর সংখ্যক প্রাচীন কুমোর ও ভাস্কর্য শিল্পীর নাম জানা গেছে। আজ কোং পিং এবং কোং চিয়া প্রমুখ ৮৫ জন মিস্ত্রির নাম শনাক্ত করা হয়েছে।

 `

বাংলাদেশ সময়: ১৮:৫৭:৩০   ৩৪৬ বার পঠিত