সোমবার, ১৭ আগস্ট ২০১৫

খুলনা যেন ক্রিকেটার তৈরির যন্তরমন্তর

Home Page » এক্সক্লুসিভ » খুলনা যেন ক্রিকেটার তৈরির যন্তরমন্তর
সোমবার, ১৭ আগস্ট ২০১৫



খুলনা বিভাগে এখন স্কুল-পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রিকেটার হওয়ার ঝোঁকটা আগের চেয়েও বেশি। ছবি: প্রথম আলো* বলুন তো, এখন খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি কী উৎপাদিত হয়?

উত্তর: ক্রিকেটার!
বঙ্গনিউজ ডটকমঃ মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, ইমরুল কায়েস, রুবেল হোসেন, এনামুল হক, সৌম্য সরকার, মুস্তাফিজুর রহমান। এঁরা তো জাতীয় দলের স্কোয়াডেই আছেন। জাতীয় দলের বৃত্তের মধ্যে আছেন রবিউল ইসলাম, আল-আমিন হোসেন, জিয়াউর রহমান। আবদুর রাজ্জাক দীর্ঘ দিন দলের বোলিংয়ের হাল ধরে রেখেছিলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের বদলে যাওয়ার শুরুটা হয়েছিল হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে। সৈয়দ রাসেল, তুষার ইমরান, মঞ্জুরুল ইসলাম, মানজারুল ইসলামরাও জাতীয় দলে অবদান রেখেছেন।
খুলনা বিভাগ থেকে উঠে আসা বাংলাদেশের ক্রিকেটের এঁরা এক ঝাঁক নক্ষত্র। কদিন আগে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে তো পাঁচ-ছয়জন ছিলেন কেবল খুলনা বিভাগের। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হয়েছেন এ বিভাগের তিনজন—হাবিবুল, মাশরাফি ও সাকিব।
মাশরাফিরা খেলেন লাল-সবুজের ঝান্ডা ওড়াতেই, দেশের হয়ে। এমনিতেই ছোট দেশ, তাই কে কোন বিভাগের তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু খুলনা থেকে একের পর এক ক্রিকেটার উঠে আসা, সম্প্রতি সৌম্য-মুস্তাফিজদের অভিষেকের ছড়ানো উজ্জ্বলতা আলাদা করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, খুলনা বিভাগে এত ক্রিকেটার উঠে আসার রহস্যটা কী? আসলেই যদি থাকে কোনো সাফল্যের মন্ত্র, সেটা তো বাকি বিভাগগুলোতেও ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।
সেই কারণ খুঁজতে হাবিবুলের দ্বারস্থ হওয়া। নির্বাচকের ভূমিকায় ফারুক আহমেদ-মিনহাজুল আবেদিনের সঙ্গে মিলে হাবিবুলই সৌম্য-মুস্তাফিজদের সুযোগ দিয়েছেন। খুলনা বিভাগীয় দলের সাবেক অধিনায়ক বললেন, ‘আসলে নির্দিষ্ট কারণ বলা মুশকিল। ক্রিকেটার তৈরিতে এখনকার মাটি বোধ হয় উর্বর! অন্য বিভাগের তুলনায় খুলনা বিভাগের ক্রিকেট অবকাঠামো খুব যে উন্নত, তা বলা যাবে না। তবে খুলনা বিভাগ থেকে এত খেলোয়াড় উঠে আসার পেছনে দুটো কারণ বলা যেতে পারে, সবাই ভীষণ পরিশ্রমী এবং প্রতিভাবান।’
বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্পিনার রাজ্জাক উঠে এসেছেন খুলনা থেকে। খুলনা বিভাগ থেকে প্রচুর খেলোয়াড় উঠে আসার পেছনে চাপমুক্ত মানসিকতা একটি কারণ বলে মনে করেন ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি, ‘খুলনা অঞ্চলের খেলোয়াড়েরা মন খুলে খেলে ছোটবেলা থেকে। বাড়তি কোনো চাপ নেয় না। জাতীয় দলে খেলতে হবে বা অনেক কিছু করতে হবে, এমন চিন্তা খুব একটা কাজ করে না ভেতরে। এভাবে খেলতে খেলতে একদিন ঠিকই জাতীয় দলে খেলে ফেলে! তা ছাড়া এ অঞ্চলে প্রচুর খেলা হয়। বেশির ভাগ ফাইভ স্টার, টেনিস বা টেপ টেনিস বলে। এ টুর্নামেন্টগুলো খুবই প্রতিযোগিতামূলক।’
এ ক্ষেত্রে স্থানীয় কোচ ও সংগঠকদের পাশাপাশি বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন খুলনা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও যুগ্ম সম্পাদক শেখ নিজাম উদ্দিন। বিসিবির সাবেক এ পরিচালক বললেন, ‘এ অঞ্চলের কিছু কোচ ও সংগঠকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁরা অনেক খেলোয়াড় তৈরি করেছেন। তা ছাড়া এ বিভাগে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটকে ভীষণ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় খুলনা বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে। প্রতিটি জেলা চায়, নিজেদের খেলোয়াড় যেন বিভাগীয় পর্যায়ে সুযোগ পায়। বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে বেশ স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে প্রতিভা তুলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কিছু কার্যকরী উদ্যোগের কথাও বলতে হবে।’
রাজ্জাকও মনে করেন এ বিভাগের বয়সভিত্তিক ক্রিকেট এখন অনেক শক্তিশালী, ‘এখানকার বয়সভিত্তিক ক্রিকেট আগের তুলনায় অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। বিভাগীয় দলে সুযোগ পাওয়া অনেক কঠিন। এমনকি জাতীয় লিগে বিভাগের সেরা একাদশ নির্বাচনও অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়।’
হাবিবুল অবশ্য জানালেন, অন্য বিভাগের তুলনায় এ বিভাগে খুব বেশি টুর্নামেন্ট-লিগ হচ্ছে, তা নয়। তবে তিনিও মনে করেন, সাকিব-মাশরাফিদের সাফল্য এই অঞ্চলের কিশোরদের মনে ক্রিকেটার হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার বীজ বুনে দিয়েছে, ‘মফস্বল বা গ্রামীণ পর্যায়ে প্রচুর ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। সেটা টেপ টেনিসে হোক কিংবা অন্য বলে। সেখানে জাতীয় দলের অনেক খেলোয়াড়ও খেলেছে। এর বাইরে আরও একটি ব্যাপার রয়েছে। প্রায় প্রতিটি জেলাতেই দুই-একজন জাতীয় দলের খেলোয়াড় আছে। ফলে সেসব জেলার খুদে ক্রিকেটাররা আদর্শ হিসেবে নিজের এলাকারই কাউকে বেছে নিতে পারছে। ওই খেলোয়াড়ের পর্যায়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।’
শেখ নিজামও একমত হাবিবুলের সঙ্গে। সাতক্ষীরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার এ সাধারণ সম্পাদক বললেন, ‘আন্তর্জাতিক কিংবা আমাদের জাতীয় কোনো তারকাকে দেখে হোক, স্কুল-পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রিকেটার হওয়ার ঝোঁকটা আগের চেয়েও বেশি। এ আগ্রহ-উদ্দীপনা অন্য বিভাগের তুলনায় খুলনায় একটু বেশিই। এখানকার অভিভাবকেরাও ছেলে-মেয়েকে ক্রিকেটার বানাতে ভীষণ আগ্রহী।’
তবে সবকিছুর পরও কথা থেকে যায়। সেটিই মনে করিয়ে দিতে চাইলেন হাবিবুল, ‘ক্রিকেট বা যেকোনো খেলাতেই বড় খেলোয়াড় হতে হলে সৃষ্টিকর্তা-প্রদত্ত প্রতিভা থাকতেই হয়। ভেতরে কিছু না থাকলে জাতীয় পর্যায়ে আসা যায় না। খুলনা বিভাগের ভাগ্য ভালো, এমন বহু প্রতিভাবান খেলোয়াড় পেয়েছে। প্রত্যাশা থাকবে, এ ধারাটা যেন অব্যাহত থাকে।’
সেই সঙ্গে সবাই প্রায় অভিন্ন সুরে আরেকটি কথা বলেছেন। প্রতিভা ছড়িয়ে আছে সবখানেই, খুঁজে বের করে আনতে হবে। সেই প্রতিভাকে লালন করতে হবে। ঠিকমতো পরিচর্যা না হলে সুন্দর ফুলের গাছও যে অকালে ঝরে যায়

বাংলাদেশ সময়: ১৩:৫৩:৪৪   ৪২৫ বার পঠিত