বুধবার, ১২ আগস্ট ২০১৫

গ্যাস মজুদ কমলেও অপচয় ঠেকাতে উদ্যোগ নেই

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » গ্যাস মজুদ কমলেও অপচয় ঠেকাতে উদ্যোগ নেই
বুধবার, ১২ আগস্ট ২০১৫



গ্যাস মজুদ কমলেও অপচয় ঠেকাতে উদ্যোগ নেইবঙ্গনিউজ ডটকমঃ বর্তমানে দেশে ঘোষিত গ্যাসের মজুদ কমে এলেও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান কার্যক্রমে তেমন গতি নেই। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিদিন মোট উত্পাদনের প্রায় ১৬ শতাংশ বা ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস অপচয় হচ্ছে। অথচ গ্যাস স্বল্পতায় বিদ্যুতের উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে। সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুত্ উত্পাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে সার কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। কিন্তু এই অপচয় কমানোর কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয় না। আবার আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগও নেই।

গ্যাস খাতে দীর্ঘদিন ধরেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামীতে জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় প্রাকৃতিক গ্যাসের আরও নতুন উত্স খুঁজে তা থেকে গ্যাস উত্তোলনের পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি এর চুরি ও অপচয় রোধ করা এবং বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি না করলে সঙ্কট আরও বাড়বে।

 

গত ৯ আগস্ট জ্বালানি নিরাপত্তা দিবসের আলোচনায় বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, গ্যাস খাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোনো হচ্ছে। গ্যাসের ব্যবহারে পরিবর্তন এনে বর্তমান গ্যাসকেই আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সারাদেশে অবৈধ গ্যাস সংযোগে ভরে গেছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। শিল্প খাতে যে জ্বালানি প্রয়োজন তা দেওয়া যাচ্ছে না। উদীয়মান শিল্প খাত গ্যাস সঙ্কটে স্থবির হয়ে আছে।

এজন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

 

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব আবু বক্কর সিদ্দিকী সকালের খবরকে বলেন, এখনও আমাদের ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সঙ্কট রয়েছে। চাহিদা মেটাতে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান কার্যক্রমের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। গ্যাসের এই সঙ্কট মোকাবেলা করতে দীর্ঘমেয়াদি নানা পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এগুলো বাস্তবায়িত হবে।

গ্যাস সংযোগে বিশৃঙ্খলা : প্রায় ছয় বছর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকার পর সরকার শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সংযোগ দিতে যাচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই সংযোগ দেওয়া হবে। ২০০৯ সালের ৩১ জুলাই থেকে এই খাতে নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। তবে সিলেট অঞ্চল এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে। কারণ হিসেবে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছিল, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় সিলেটের ক্ষেত্রগুলো থেকে তোলা সব গ্যাস দেশের অন্যত্র সঞ্চালন করা যাচ্ছে না। অবকাঠামোর সেই সীমাবদ্ধতা এখনও কাটেনি।

এদিকে ২০১০ সালের ১৩ জুন আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ বন্ধ করা হয়। ২০১৩ সালের ৭ মে আবার তা চালু করা হয়। মধ্যবর্তী এই সময়ে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে বহু অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। এখন আবার আবাসিক সংযোগ বন্ধ করা হলে আগের মতোই দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট মহল। আবার ২০১৩ সালে আবাসিকে নতুন সংযোগ চালু করার পর যারা আবেদন করেছিলেন তাদের অনেকেই এখনও সংযোগ পাননি। কিন্তু অবৈধভাবে যারা সংযোগ নিয়েছেন তারা ঠিকই গ্যাস ব্যবহার করছেন। অবৈধ সংযোগ বন্ধের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিকরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন বলে বিতরণ কোম্পানিগুলোর অভিযোগ রয়েছে।

একদিকে ঘাটতি অন্যদিকে অপচয় : বর্তমানে দৈনিক গড়ে ২৭০ কোটি ঘনফুট উত্পাদন হলেও গ্যাসের চাহিদা ৩২০ কোটি ঘনফুটের বেশি। ঘাটতি অন্তত ৫০ কোটি ঘনফুট। এ অবস্থায়ও দৈনিক প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস অপচয় হচ্ছে। পেট্রোবাংলা ও তিতাস গ্যাস সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সবচেয়ে বেশি গ্যাসের অপচয় হচ্ছে বিদ্যুেকন্দ্র, সার কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। এছাড়া আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতেও হচ্ছে গ্যাসের অপচয়। এর বাইরে রয়েছে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে গ্যাস চুরি।

 

তিতাসের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন আবাসিক খাতে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, শিল্পে প্রতিদিন প্রায় সে পরিমাণ গ্যাস অপচয় হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরনো বিদ্যুেকন্দ্র ও সার কারখানার অদক্ষ যন্ত্রপাতি এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সেকেলে প্রযুক্তির বয়লার এ অপচয়ের প্রধান কারণ। এগুলো নতুন প্রযুক্তিতে রূপান্তর করে গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব। এই রূপান্তর ব্যয়ও বেশি নয়। এছাড়া আবাসিক গ্রাহকদের চুলাগুলো উন্নত প্রযুক্তির করা হলে এবং রাস্তা থেকে রান্নাঘরে গ্যাস নেওয়ার লাইনগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমেও গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব।

বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, দেশে গ্যাসচালিত বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর মোট উত্পাদনক্ষমতা ৬ হাজার ৮০৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপভিত্তিক কেন্দ্র। এগুলোর জ্বালানি দক্ষতা ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তির কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুেকন্দ্র করা হলে এর দক্ষতা হবে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ। বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, পুরনো বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উত্পাদনে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে ইউরিয়া সার কারখানাগুলোতেও জ্বালানির অপচয় ব্যাপক। একই পরিমাণ সার উত্পাদনে একেক কারখানায় একেক পরিমাণ গ্যাস লাগছে।

 

কমছে মজুদ : দেশের ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রের ওপর জরিপ চালিয়ে চলতি বছরের শুরুতে পেট্রোবাংলা একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, গ্যাসের যে ঘাটতি রয়েছে তা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। ২০১৯ সালে এই ঘাটতি হবে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৭ সালের জুন মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন করা সম্ভব হবে। এরপর উত্পাদন কমতে থাকবে।

পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, ভবিষ্যত্ চাহিদা মেটাতে বেশি করে গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে। স্থল ও সমুদ্রের বেশিরভাগ স্থানেই এখনও অনুসন্ধান করা হয়নি। গ্যাসের উত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অপচয় বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। আমদানি করা এলএনজি দিয়ে এই সঙ্কট পূরণ করতে গেলে গ্যাসের দাম অনেক বেড়ে যাবে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম সকালের খবরকে বলেন-গ্যাস উত্পাদন, সরবরাহ ও বণ্টন পুরো প্রক্রিয়া বিপথে চলছে। রেশনিং প্রক্রিয়ায় একদিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে অন্যদিকে চালু করা হচ্ছে। গ্যাসের মজুদ কমে এলেও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান কিংবা বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ ও অপচয় রোধ করতে পারছে না সরকার। এক কথায় যাচ্ছেতাই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

‘সরকার গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ দিতে যাচ্ছে। কারিগরি বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন কেন বিবেচনা করা হবে?’-এমন প্রশ্ন তোলেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, কারিগরি দিক বিবেচনায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। ব্যক্তিস্বার্থে যারা এই গ্যাস খাতকে জিম্মি করেছে, রাষ্ট্র তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এভাবে চললে ভবিষ্যত্ পরিণতি মোটেও ভালো হবে না। এজন্য এখনই দীর্ঘমেয়াদি সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। অপচয় ও চুরি রোধের পাশাপাশি নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান এবং বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম সকালের খবরকে বলেন, গ্যাস সেক্টরে দীর্ঘদিন ধরেই অরাজকতা চলছে। নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমও স্থবির হয়ে আছে। তিনি বলেন, গ্যাসের মজুদ কমে আসায় বাসাবাড়িতে নতুন করে সংযোগ না দিয়ে এলপিজি সরবরাহ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে এলপিজি ও আবাসিকের গ্যাসের দামের মধ্যে একটা সমন্বয় থাকা দরকার। তামিমের মতে, যতদিন কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুেকন্দ্র তৈরি না হবে ততদিন গ্যাসের এই সঙ্কট থাকবেই। এজন্য এখন থেকেই সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। না হলে সঙ্কট আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭:৩৫:০০   ৪৪৮ বার পঠিত