বুধবার, ১২ আগস্ট ২০১৫
মাথাব্যথার রকমভেদ
Home Page » স্বাস্থ্য ও সেবা » মাথাব্যথার রকমভেদবঙ্গনিউজ ডটকমঃমাথাব্যথা। মাঝে মধ্যে মাথাব্যথায় ভোগেন না, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। কারো সকালে, কারো বিকেলে, কারো কাজের চাপে, কারো মনের চাপে, কারো রোদে গেলে, কারো ঠাণ্ডা লাগলে, কারো বা চোখের সমস্যা হলে ইত্যাদি হরেক রকমের মাথাব্যথার কথা আমরা জানি। ‘মুখ তো নয়… মেলট্রেন… চলছে… চলছে… শুনে শুনে মাথাব্যথা, মনপ্রাণ টলছে। এ সবই মাথাব্যথার রকমভেদ।
লিখেছেন অধ্যাপক ডা: জি এম ফারুক
নানা রকম মাথাব্যথার ভিড়ে টেনশন-হেডেক বা টেনশনজনিত মাথাব্যথা সবার ওপরে। ভারী ভারী একটানা একধরনের ব্যথা মাথার দুই দিকে থাকে। মৃদু থেকে বেশি। মনে হয় মাথা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। অথবা মাথার চার দিকে একটি ব্যান্ড বেঁধে দিয়েছে কেউ। ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে ঘাড়ে। মেজাজ হয় খিটখিটে। ইচ্ছে করে কেউ কথা না বলুক। এ ধরনের মাথাব্যথা সাধারণত দিনের শেষে হয়। ১-২ ঘণ্টা থাকে। বিশ্রাম নিলেই কমে যায়। কেউ বা ব্যথানাশক খেয়ে নেন। ক্রনিক টেনশন-হেডেক প্রতিদিন হতে পারে। অবেগজনিত চাপ বড় কারণ। ধরুন, কারো কর্মক্ষেত্রে সমস্যা অথবা বাড়িতে স্ত্রীর সাথে মিলমিশের অভাব কিংবা ঋণের টাকার চাপ ইত্যাদি সব মানসিক চাপ- এ ধরনের মাথাব্যথার জন্য দায়ী। তাই যারা এ ধরনের মাথাব্যথায় আক্রান্ত তারা তাদের টেনশনের কারণ চিহ্নিত করুন। সমস্যাটিকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সমাধানের পরিকল্পনা হাতে নিন। প্রয়োজনে সাইকোথেরাপিস্ট দেখান। নিজে নিজে ওষুধ সেবন না করে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
সাইনোসাইটিস থেকে যদি মাথাব্যথা হয়, তা মৃদু থেকে মোটামুটি তীব্র সাইনাস সংক্রমণের কারণে হতে পারে। ইনফেকশন থাকাকালীন সময়ে এ ব্যথা থাকবে সাধারণত নাকের দু’পাশে, চোখের ভ্রুর ওপরে এবং চোখের ভেতরে। এ অবস্থায় জ্বর জ্বর ভাব, নাক দিয়ে হালকা বা ঘন পুঁজের মতো পড়া এবং মাথা নাড়লে বা ঝাঁকালে মাথাব্যথা বাড়তে পারে। নানা ধরনের সাইনোসাইটিসের মধ্যে ফ্রন্টাল সাইনোসাইটিস সাধারণত সকালে বৃদ্ধি পায়। ম্যাক্সিলারি সাইনোসাইটিসের ব্যথা বিকেলে দেখা দেয়। সাইনোসাইটিস ভালো হয়ে গেলে সাধারণত এই মাথাব্যথা আর থাকে না।
মারাত্মক এবং উগ্র মাথাব্যথা হলো মাইগ্রেন। পৃথিবীতে সব দেশে ক্রনিক মাথাব্যথার বড় কারণ হচ্ছে মাইগ্রেন। মাইগ্রেন অনেক সময় বংশগত। মহিলাদের মধ্যে এ রোগ বেশি হয়ে থাকে। মাথার এক পাশে ব্যথা শুরু হয়ে থাকে। মাথার এক পাশে ব্যথা শুরু হয়ে তা অন্য পাশে ছড়িয়ে পড়ে। ধরুন, মাথার বাম পাশে ব্যথার শুরু। তারপর কপালে ছড়িয়ে মাথার তালুতে যেয়ে ব্যথা ডান পাশে চলে যাবে। কখনো তা পুরো মাথায়ও ছড়াতে পারে। মাথার শিরায় দপদপ করা, আলোর দিকে তাকাতে কষ্ট হওয়া, সেই সাথে বমির ভাব, কখনো কখনো বমি হয়ে যাওয়া, শ্রবণে গণ্ডগোল, কথা জড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি মাইগ্রেনের লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। সাধারণ মাইগ্রেনের ব্যথা ২-৩-৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। তবে তিন-চার দিন পর্যন্ত মাথাব্যথার একটি আক্রমণ স্থায়ী হতে পারে। তবে বমি হলে ব্যথার উপশম হয়। মাইগ্রেনের আক্রমণের আগেই তার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। যেমন- দৃষ্টিতে বিভ্রম, যার ফালে উজ্জ্বল আলোক কণা অথবা আঁকাবাঁকা আলোক রেখা দু’চোখেই দেখা দেয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুখ, হাত ও পা দুর্বলতায় কাঁপে এবং অবশ হতে শুরু করে। এ সবের সাথে থাকে বিভ্রান্তি এবং গা ঝিমঝিম করা। কথাও কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসব বিভিন্ন উপসর্গ শরীরের একাংশ থেকে বিভিন্নাংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রাথমিক এসব নানা উপসর্গ ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় প্রচণ্ড স্পন্দিত মাথাব্যথা, যা মাথার বিপরীত দিকেও অনুভূত হতে পারে। এ সময় বেশি যেহেতু আলো সহ্য করতে পারে না, তাই আলো নিভিয়ে বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। এখানে মনে রাখা দরকার, মাইগ্রেন তাদেরই বেশি হয় যারা কঠোর পরিশ্রম করেন। অত্যধিক কাজের ফলে বা অনুভূতি সংক্রান্ত পীড়নে তাদের মাথাব্যথা হয়। তাই যারা মাইগ্রেনের রোগী তারা অত্যধিক পরিশ্রমের কাজ এড়িয়ে চলুন। আবেগতাড়িত নানা সমস্যা থেকে দূরে থাকুন। নিয়মিত ব্যায়াম করুন। প্রচুর পানি পান করুন। ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলুন। মধপান, ধূমপান, পনির, চকলেট ইত্যাদি যাতে ফিনাইলইথাইল-অ্যামিন থাকে তা এড়িয়ে চলুন; কারণ, এর কারণে মাইগ্রেন বাড়তে পারে। যেসব মহিলার মইগ্রেন আছে তারা গর্ভনিরোধ বড়ি সেবন থেকে বিরত থাকুন; কারণ, তা আপনার মাইগ্রেনকে বাড়িয়ে দিতে পারে। মাইগ্রেনের রোগীরা নিয়মিত ডায়েরি লিখুন, যাতে আপনার সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সারা দিনের রোজনামচা লেখা থাকবে। এখানে বয়স্ক মহিলাদের জন্য একটি সুখবর হচ্ছে, রজঃনিবৃত্তির পর সাধারণত এ রোগ আর হয় না।
স্কুলপড়–য়া ছেলেমেয়েদের অনেকেরই মাথাব্যথা থাকে। কখনো কখনো স্কুল থেকে ফেরার পরে অথবা বেশ কিছুক্ষণ পড়াশোনার পর ছেলেমেয়েরা মাথাব্যথার কথা বলে। অনেকেরই ধারণা, এটা পড়ার চাপ বা টেনশন-জনিত মাথাব্যথা। কিন্তু বেশির ভাগ সময় এর মূল কারণ হলো চোখের সমস্যা, যার জন্য হয়তো চশমার প্রয়োজন। শিশুটি যদি ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসে এবং বলে যে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা সে ভালোভাবে দেখতে পায় না। তাহলে স্পষ্টই বোঝা যায়, তার চোখ খারাপ। এ ধরনের ছেলেমেয়েদের দ্রুত ডাক্তার দেখানো দরকার।
বয়স্ক ব্যক্তিরাও মাথাব্যথায় ভোগেন। তারা অনেকে মনে করেন মাথার মধ্যে যেন কিছু একটা কাঁপছে। সকালের দিকে এবং মাথা ঝুঁকলে তা বেশি হয়। মাথার সামনের দিকে এবং রগের পাশ দুটো বেশি আক্রান্ত হয় এবং মাথা ঝিমঝিম করে। এ ধরনের মাথাব্যথায় রক্তের চাপ পরীক্ষা করা প্রয়োজন; কারণ, এ সবই রক্তের চাপ বেশি হওয়ার লক্ষণ।
মস্তিষ্কের ভেতরে যেকোনো রোগ হলে মাথাব্যথার সম্ভাবনা থাকে। এ ধরনের অনেক রোগ মাথাব্যথা উপসর্গ দিয়ে শুরু হয়। মস্তিষ্কের পর্দায় বা কোষে প্রদাহ হলে, মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তপাত হলে, মস্তিষ্কের উপরিভাগে সামান্য আঘাতে রক্ত জামট বেঁধে গেলে ইত্যাদি কারণে মাথাব্যথা হতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার।
ক্লাস্টার হেডেক আরেক ধরনের মাথাব্যথা, যা পুরুষদের মধ্যে বেশি (৯০%) হয়। ২০-৩০ বছর বয়সে বেশি হয়। ব্যথা তীব্র হয়। মনে হয় ছুরি দিয়ে একটা চোখ কেটে ফেলছে। অনেক দিন পর পর ব্যথার আক্রমণ। সব সময় মাথার একই পাশে ব্যথা হবে। রাতেই বেশি হয়। ব্যথায় রোগীর ঘুম ভেঙে যায়।
আরো বহু ধরনের মাথাব্যথা রয়েছে। যেমন- মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের সপ্তাহখানেক আগে মাথাব্যথা হতে পারে। এ ধরনের মাথাব্যথাকে বলে ‘প্রাক-ঋতুস্রাব মাথাব্যথা’। এ সময়ে দেহে অত্যধিক তরল পদার্থ জমা হয় বলে এটা হতে পারে। তা ছাড়া হরমোনসংক্রান্ত পরিবর্তনের জন্য এ ব্যথা হতে পারে। আবার কিছু কিছু মহিলা, যারা যৌনতার ব্যাপারে শীতল বা অত্যন্ত রক্ষণশীল জীবন যাপন করেন তাদের ক্ষেত্রে যৌনসঙ্গমের পর মাথাব্যথা হতে পারে। সাইকোলজিক্যাল কারণেও অনেকের মাথাব্যথা হতে পারে। মাথাব্যথার আরো একটা কারণ হলো ঘাড়ের হাড়ের ক্ষয় ও ক্ষত, যাকে বলা হয় ‘স্পন্ডিলোসিস’। কানের ভেতরে অবস্থিত বিভিন্ন কাঠামোর প্রদাহ (ওটাইটিস) এবং কানের ঠিক পেছনের হাড়ের প্রদাহের কারণেও (ম্যাস্টয়ডাইটিস) মাথাব্যথা হতে পারে।
মাথাব্যথার বিস্তৃত বিবরণ এখানে দেয়া সম্ভব নয়। মাথাব্যথার যেসব ধরন বেশি আক্রমণাত্মক সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা হলো সংক্ষিপ্তভাবে। মাথাব্যথার চিকিৎসায় কারণগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। নিজে নিজে ওষুধ সেবন না করাই ভালো। অন্যান্য চিকিৎসাপদ্ধতির মতো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায়ও মাথাব্যথা নিরাময় হয়। বিজ্ঞ চিকিৎসক সঠিক রোগচিত্র মূল্যায়ন করে যথাযথভাবে ওষুধ প্রয়োগ করতে পারলে রোগী দ্রুত উপকার পায়। তা ছাড়া হোমিওপ্যাথিক পর্যাপ্ত ওষুধভাণ্ডার রয়েছে মাথাব্যথার বিভিন্ন ধরনের জন্য। যেমন- সাইনোসাইটিসের জন্য আর্সেনিক অ্যল্বাম, ব্রায়োনিয়া, কেলকেরিয়া কার্ব, কেলকেরিয়া সালফ, ডালকামারা, হিপার সালফ, কেলি আয়োড, মার্কসাল, নাক্সভম ইত্যাদি। মাইগ্রেনের জন্য রয়েছে : অ্যাগারিকাস, ব্রায়োনিয়া, চায়না, জেলসেমিয়াম ইগনেশিয়া, ল্যাকক্যান, ন্যাট্রাম মিউর, ন্যাট্রাম সালফ, নাক্স, ফসফরাস, পালস, স্যাংগুইনাইরিয়া, সিপিয়া, সালফার, থুজা ইত্যাদি। গর্ভাবস্থার মাথাব্যথায় বেলেডোনা, ক্যামোমিলা, পালস, সিপিয়া প্রভৃতি ওষুধ বেশ ভালো কাজ করে। ধূমপানজনিত মাথাব্যথায় ক্যালেডিয়াম, ইগনেশিয়া ও ন্যাট্রাম আর্স ফলপ্রদ ওষুধ। আবেগতাড়িত সমস্যায় মাথাব্যথা হলে ইগনেশিয়া, ন্যাট্রাম মিউর, ফসফরাস প্রভৃতি ওষুধ কার্যকর। রাগজনিত মাথাব্যথায় স্ট্যাফিমেগরিয়া ভালো ওষুধ। অ্যালকোহল পানজনিত মাথাব্যথায় অ্যাগারিকাস, ল্যাকেসিস, নাক্সভম প্রভৃতি ওষুধ ব্যবহৃত হয়। ঠাণ্ডাজনিত মাথাব্যথায় একোনাইট, বেলেডোনা, ব্রায়োনিয়া, ডালকামারা, নাক্সভম ইত্যাদি ওষুধ কার্যকর। ড্রাগ এবিউজের ফলে মাথাব্যথা হলে এভেনা স্যাটাইভা, নাক্সভম খুবই পরিচিত ওধুষ। মানসিক চাপজনিত মাথাব্যথায় অরামমেট, ক্যালকেরিয়া ফস, গ্লোনইন, কেলিফস, লাইকোপডিয়াম, ন্যাটামকার্ব, ন্যাট্রাম মিউর, ন্যাট্রাম ফস, নাক্সভম, পালস, সালফার ইত্যাদি অনেক ওষুধ রয়েছে হোমিওপ্যাথির ভাণ্ডারে। অর্থাৎ আমরা বলতে চাচ্ছি, বিভিন্ন ধরনের মাথাব্যথায় কার্যকর বহু ওষুধ রয়েছে হোমিওপ্যাথিতে এবং এসব ওষুধের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। অভিজ্ঞ চিকিৎসক তার ক্লিনিক্যাল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মাথা ব্যথার কার্যকর ওষুধ বাছাই করে প্রয়োগ করলে আশাপ্রদ ফল পাওয়া যাবে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ
- See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/45403#sthash.jSURnb3e.dpuf
বাংলাদেশ সময়: ১:৪৬:৪১ ৫৩১ বার পঠিত