মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট ২০১৫

এজলাস সঙ্কট, বিপত্তি বিচারকাজে

Home Page » প্রথমপাতা » এজলাস সঙ্কট, বিপত্তি বিচারকাজে
মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট ২০১৫



এজলাস সঙ্কট, বিপত্তি বিচারকাজেবঙ্গনিউজ ডটকমঃ কুমিল্লা জেলা জজ আদালতের বারান্দা দিয়ে হাঁটছেন আর মনের অজান্তে ফিস ফিস করে বলছেন, ‘কোর্টে ওঠেনি। জজও এজলাসে বসেনি। জজ উঠবেন কখন? আর আমার মামলার বিচার শুরু হবে কখন?’ রোজার ঈদের আগে জমি সংক্রান্ত মামলার কাজে কুমিল্লার আদালতে এসেছিলেন রহিম শেখ। তিনিই ওই কথাগুলো বলছিলেন। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের সামনে উদভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করছিলেন রাহিমা খাতুন। চার বছর আগে এক লাখ এক টাকা দেনমোহরে সুলতান মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় রাহিমা খাতুনের। তার দুই বছরের এক কন্যা রয়েছে।

রাহিমা খাতুনের সঙ্গে চার বছর সংসার করে বিনা অনুমতিতে স্বামী আরেক নারীকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে রাহিমা খাতুনের স্বামী তাকে তালাক দেন। তালাকের নোটিস পাওয়ার পর দেনমোহর না দেওয়ায় রাহিমা খাতুন ঢাকার পারিবারিক আদালতে সুলতান মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এক লাখ টাকা আদায়ের মামলা চালাতে রাহিমা খাতুন কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু এখনও তার মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। গত মে মাসে রাহিমা খাতুনের সঙ্গে ঢাকার আদালত পাড়ায় কথা হয়। বিচার শেষ না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এজলাস সঙ্কটের কারণে স্যারেরা (বিচারক) ঠিকমতো বসতে পারেন না। এ ছাড়া আসামিপক্ষ মামলায় বারবার সময় নিচ্ছে। এ জন্যই মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে।

বর্তমানে ৪৭ জেলায় ১৭১টি এজলাস বা আদালত কক্ষ না থাকায় বিচারকরা বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারছেন না। বিচারকরা একটি এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। আর প্রয়োজনীয় আদালত ভবন না থাকায় নতুন এজলাস স্থাপন করা যাচ্ছে না। লাখ লাখ মামলার ফয়সালাও হচ্ছে না। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বর্তমান সরকার দেশের ৬৪ জেলায় মুখ্য বিচারিক হাকিমের (সিজিএম) নতুন আদালত ভবন বা পুরনো আদালত সম্প্রসারণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সিজিএম ভবন নির্মাণ হয়ে গেলে দেশে কোনো এজলাস সঙ্কট থাকবে না। আপাতত যেখানে এজলাস কম রয়েছে, সেখানে এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকাজ পরিচালনা করতে বিচারকদের আহ্বান জানানো হয়েছে।

সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় থেকে জানা যায়, দেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে সরকার অনুমোদিত বিচারকের পদ রয়েছে ১ হাজার ৬৫৫টি। সারাদেশে নিম্ন আদালতে বিচারকের শূন্য পদ আছে ৪৫৭টি। অর্থাত্ ১ হাজার ১৯৮ জন বিচারক কর্মরত আছেন। এই হিসেবে ১ লাখ ৫২ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে মাত্র ১ জন বিচারক নিয়োজিত আছেন। দেশে অনিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ৩০ লাখ।

১১৯৮ বিচারকের মধ্যে এজলাস নেই ১৭১ জনের। ৪৭ জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ ঢাকা ও কুমিল্লায় ৯টি করে ১৮টি এজলাসের ঘাটতি রয়েছে। জামালপুরে আটটি, পাবনায় সাতটি; রাজশাহী, নরসিংদী, শেরপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা ও চাঁদপুরে ছয়টি করে ৩৬টি; নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, কুড়িগ্রাম, কুষ্টিয়া, বগুড়া ও নাটোরে পাঁচটি করে ৩৫টি; গোপালগঞ্জ, যশোর, সুনামগঞ্জে চারটি করে ১২টি; মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, দিনাজপুর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, রাঙামাটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনটি করে ২৭টি; টাঙ্গাইল, মাদারীপুর, পঞ্চগড়, রংপুর, লক্ষ্মীপুর, বাগেরহাট, হবিগঞ্জ, সাতক্ষীরা, মৌলভীবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুটি করে ২০টি এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নীলফামারী, সিলেট, বরগুনা, নড়াইল, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে একটি করে এজলাস কম রয়েছে। জানা গেছে, নরসিংদীর দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতের এজলাস কক্ষ তিনজন বিচারক ভাগ করে বিচারকাজ করছেন।

 

রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের তথ্যমতে, বর্তমান সরকার এজলাস সঙ্কট কমিয়ে আনার জন্য ৬৪ জেলার মধ্যে ৩০ জেলায় মুখ্য বিচারিক হাকিমের (সিজিএম) আদালত ভবন নির্মাণের কাজ হাতে নেয়। এর মধ্যে খুলনা, ঝিনাইদহ, টাঙ্গাইল, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় আদালত ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সরকার বাকি ৩৪টি সিজিএম আদালত ভবন নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এর মধ্যে মাত্র চারটি ভবন নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা গেছে। নির্মাণকাজও শুরু হচ্ছে। ২০১১ সালে যশোরে সিজিএম আদালত ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হলেও শেষ হয়নি। আইন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে গণপূর্ত অধিদফতর ভবনগুলো নির্মাণ করছে। এ জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় ২০১১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প অনুমোদন হয়। ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে এই প্রকল্প। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু আজও শেষ হয়নি।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত কর্তৃপক্ষ প্রথম দফায় ২০০৭ সালে এজলাস কক্ষ বাড়ানোর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। এরপর কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হলেও এজলাস বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি আইন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় জানায়, বাকি জেলাতে ওই আদালত ভবন নির্মাণ করতে আরও ২০ বছর লাগবে।

 

২০১১ সালের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকার জেলা জজ ও সিজিএম পর্যায়ের আদালত রয়েছে ৮১টি। এর বিপরীতে এজলাস আছে মাত্র ৫৮টি। অর্থাত্ ২৩ এজলাস কম। ঢাকা জেলা জজ ও সিজিএমের আদালত ভবন সম্প্রসারণ করা হয়নি। তবে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত ভবন সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তাই এ আদালতে এজলাস সঙ্কট কিছুটা কম।

রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম সকালের খবরকে বলেন, নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হলেও বিচার বিভাগের বিভিন্ন ঘাটতি কেউ নজরে নিচ্ছে না। আমরা সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে পারছি না। দেশে যে পরিমাণ মামলা রয়েছে, সেই পরিমাণ বিচারক নেই। পাশাপাশি বিচারক থাকলেও এজলাস সঙ্কটের কারণে বিচারকাজ পরিচালনা করা যাচ্ছে না। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শম রেজাউল করিম বলেন, দেশে এমনিতেই গরিব মানুষ ন্যায়বিচার পান না। তারপরও এজলাস সঙ্কটের কারণে বিচার শেষ হতে দেরি হলে দরিদ্ররা বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারাবেন। এ জন্য এজলাস বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:০৪:১৬   ২৯৭ বার পঠিত