শনিবার, ১ আগস্ট ২০১৫
সংবিধানের অস্পষ্টতা নিরসন জরুরি
Home Page » জাতীয় » সংবিধানের অস্পষ্টতা নিরসন জরুরিবঙ্গ নিউজ ডটকম ঃআমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। সংবিধান অন্যান্য আইনের মতো সংসদে প্রণীত হলেও অন্যান্য আইনের সাথে সংবিধানের পার্থক্য হলো এটির সংশোধন প্রক্রিয়া জটিলতর। সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেরূপ সংসদের সদস্য সংখ্যার দু-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন, অনুরূপ সংবিধানে যেকোনো ধরনের সংযোজন, বিয়োজন বা প্রতিস্থাপনের জন্যও দু-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। সংবিধান ছাড়া অপরাপর যেকোনো আইন প্রণয়ন এবং যেকোনো আইনে সংযোজন, বিয়োজন বা প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিলে তা অনুমোদনের জন্য সংসদে উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন।
আমাদের সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন হওয়া বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৭(২)-এ স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের সাথে দেশের অপর কোনো আইন সাংঘর্ষিক বা অসামঞ্জস্য হলে সে আইনের যতটুকু সাংঘর্ষিক বা অসামঞ্জস্য ততটুকু বাতিল হবে। এ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৭(২)- এ বলা হয়েছে, অন্য কোনো আইন যদি এ সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে।
আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগ মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত। সংবিধানে যেসব অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে জাতিসঙ্ঘ সর্বজনীন মানবাধিকার দলিল, ১৯৪৮ এ সেসব অধিকার মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬(২)-এ রাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এ ভাগের কোনো বিধানের সাথে অসামঞ্জস্য কোনো আইন প্রণয়ন করবে না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হলে তা এ ভাগের কোনো বিধানের সাথে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হয়ে যাবে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ বলবৎ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৪(১)-এ বলা হয়েছে, এ ভাগে প্রদত্ত অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য এ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের নিকট মামলা রুজু করার অধিকারের নিশ্চয়তা দান করা হলো।
উল্লেখ্য, যদিও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(২) এবং ২৬(২)-এ বলা হয়েছে, সংবিধান বা সংবিধানের তৃতীয় ভাগের সাথে কোনো আইন অসামঞ্জস্য হলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হবে কিন্তু কোন্ োআদালত কী পদ্ধতিতে এটি বাতিল করবে, সে বিষয়ে সংবিধানে অস্পষ্টতা রয়েছে। এ অস্পষ্টতা দূর করার জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রবর্তনকালে ৪৪ অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনয়নপূর্বক মৌলিক অধিকার বলবৎ বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজু করার অধিকার হরণ করে এ অধিকারগুলো বলবৎ করার জন্য সংসদ কর্তৃক আইনের মাধ্যমে একটি সাংবিধানিক আদালত, ট্রাইব্যুনাল অথবা কমিশন প্রতিষ্ঠার বিধান প্রবর্তন করেন।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রণয়ন পরবর্তী সাত মাসের মাথায় দুঃখজনক এক ঘটনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে দেশে সামরিক শাসন আসে। অতঃপর সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর দ্বারা সে সংশোধনকে পূর্ণতা দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলেও সংবিধানের ৪৪(১) অনুচ্ছেদ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত বিধানকে কার্যকর রূপ দিতে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন এবং সংবিধানের বিধানাবলি বিষয়ে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭৮(১) অবলোকনে প্রতীয়মান হয়, সংসদের কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করার কোনো অবকাশ নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয় সংসদের কার্যধারা বলতে কী বোঝায়? বেশির ভাগ সংবিধান বিশেষজ্ঞের অভিমত সংসদ কক্ষে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য প্রত্যেকটি প্রস্তাব বিল আকারে উপস্থাপন, এর ওপর আলোচনা এবং সংসদে বিলটি গৃহীত হওয়া পর্যন্ত সামগ্রিক কার্যক্রম সংসদের কার্যধারা। সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে প্রতীয়মান হয় সংসদ প্রণীত আইন অথবা সংসদে বিদ্যমান কোনো আইনে সংযোজন, বিয়োজন বা প্রতিস্থাপন করা হলে অথবা কোনো আইন বাতিল করা হলে সে বিষয়ে কোনো আদালতে মামলা করা যাবে কি না, এ প্রশ্নে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।
আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারকেরা নিয়োগ লাভ পরবর্তী যতক্ষণ পর্যন্ত না সংবিধান অনুসৃত পদ্ধতিতে শপথবাক্য পাঠ না করেন ততক্ষণ পর্যন্ত পদে আসীন হন না। উচ্চ আদালতের একজন বিচারককে সাংবিধানিক পদধারী হিসেবে শপথ নেয়ার সময় অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ব্যক্ত করতে হয় যে, তিনি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের এ শপথের কারণে তিনি শপথ নেয়ার সময় সংবিধান ও অন্যান্য আইনের যে অবস্থান ছিল তিনি সংবিধান ও অন্যান্য আইনে সংযোজন, বিয়োজন বা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সংশোধনী আনার পরবর্তী মামলা সংশ্লেষে যদি সংবিধান ও অন্যান্য আইন বিষয়ে শপথ নেয়ার সময় অবস্থান থেকে ভিন্নতর অবস্থান গ্রহণ করেন তাতে তার শপথ ক্ষুণ্ন হবে কি না, এ প্রশ্নে বিতর্ক দেখা দেয়া অমূলক নয়।
সংসদে প্রণীত যেকোনো আইন সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তিসমষ্টির সমর্থনে গৃহীত হয়। এরূপ ব্যক্তিসমষ্টি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২(২)(ক) (অ) (আ) তে উল্লিখিত ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করে কি না, সে প্রশ্নটি এসে যায়। আর যদি আকৃষ্ট করে না থাকে সে ক্ষেত্রে সংসদে প্রণীত আইন বা অনুরূপ আইনের সংযোজন, বিয়োজন বা প্রতিস্থাপন বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপের ব্যাপ্তি কতটুকু বিস্তৃত, তা নিরূপণ যথার্থ বিবেচিত হয়। উপরউল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু যে সাংবিধানিক আদালত, ট্রাইব্যুনাল অথবা কমিশন প্রতিষ্ঠার বিধান প্রবর্তন করেছিলেন তা যে সংবিধানের অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা নিরসনে সহায়ক হতো সে প্রশ্নে দ্বিমত পোষণের সুযোগ আছে মর্মে প্রতীয়মান হয় না।
আমাদের দেশের অপরাপর সাধারণ ও বিশেষ আইনকে সংবিধানের নিচে অবস্থান দেয়া হলেও একটি বিশেষ আইন যথা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ কে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ ওই সালের ২০ জুলাই কার্যকর হয়। এ আইনটি কার্যকর হওয়ার আগে ১৫ জুলাই, ১৯৭৩ সংবিধানে প্রথম সংশোধনী আনয়নপূর্বক অনুচ্ছেদ ৪৭ এর দফা (৩) এবং অনুচ্ছেদ ৪৭ক সন্নিবেশন করা হয়। অনুচ্ছেদ ৪৭ এর দফা (৩)-এ বলা হয়, এ সংবিধানে যা বলা হয়েছে তা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোনো সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য বা অন্য কোনো ব্যক্তি, ব্যক্তিসমষ্টি বা সংগঠন কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারিতে সোপর্দ কিংবা দণ্ড দান করার বিধানসংবলিত কোনো আইন বা আইনের বিধান এ সংবিধানের কোনো বিধানের সাথে অসামঞ্জস্য বা তার পরিপন্থী, এ কারণে বাতিল বা বেআইনি হয়েছে বলে গণ্য হবে না কিংবা বাতিল বা বেআইনি বলে গণ্য হবে না। পরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে (৩) দফায় ‘সহায়ক বাহিনীর সদস্য’ শব্দগুলোর পর ‘বা অন্য কোনো ব্যক্তি, ব্যক্তিসমষ্টি বা সংগঠন’ শব্দগুলো ও কমা সন্নিবেশিত হয়। সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে সন্নিবেশিত অনুচ্ছেদ ৪৭(ক) এর দফা (১)-এ বলা হয়, যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোনো আইন প্রযোজ্য হয় সে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ, ৩৫ অনুচ্ছেদের (১) ও (৩) দফা এবং ৪৪ অনুচ্ছেদের অধীন নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য হবে না।
এ অনুচ্ছেদের দফা (২)-এ বলা হয়, এ সংবিধানে যা বলা হয়েছে, তা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোনো আইন প্রযোজ্য হয়, এ সংবিধানের অধীন কোনো প্রতিকারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার কোনো অধিকার সে ব্যক্তির থাকবে না।
উল্লেখ্য, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারসংক্রান্ত। ওই অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইন অনুযায়ী ও কেবল আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইন অনুযায়ী ছাড়া এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
অনুচ্ছেদ ৩৫ বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ বিষয়ক। ওই অনুচ্ছেদের দফা (১)-এ বলা হয়েছে, অপরাধের দায়যুক্ত কার্য সংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এরূপ আইন ভঙ্গ করার অপরাধ ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সে আইন বলে যে দণ্ড দেয়া যেত, তাকে তার অধিক বা তা থেকে ভিন্ন দণ্ড দেয়া যাবে না।
এ অনুচ্ছেদটির দফা (৩)-এ বলা হয়েছে, ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিয্ক্তু প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হবেন।
অনুচ্ছেদ ৪৪-এ নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য না হওয়ার অর্থ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য অনুচ্ছেদ ১০২ এর দফা (১) অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজু করার অধিকার হরণ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য অভিয্ক্তু ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির আটক, বিচার ও দণ্ড প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রণীত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে একজন চেয়ারম্যান এবং অন্যূন দুই ও অনূর্ধ্ব চারজন সদস্য সমন্বয়ে এক বা একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের যোগ্যতা বিষয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভের যোগ্য অথবা ওই আদালতে বিচারক হিসেবে কর্মরত অথবা বাহিনী আইনের অধীন জেনারেল কোর্ট মার্শালের সদস্য হওয়ার জন্য যোগ্য ব্যক্তিকে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বা সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের অধীন ট্রাইব্যুনালস গঠনপূর্বক চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ বিষয়ে দেখা যায় ট্রাইব্যুনাল সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কর্মরত বিচারক সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ন্যায় পরিত্যক্ত ভবন (অতিরিক্ত বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ তে কোর্ট অব সেটেলমেন্টের চেয়ারম্যান পদে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অথবা অতিরিক্ত বিচারক অথবা বিচারক বা অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য যোগ্য ব্যক্তিকে পদায়ন করার বিধান করা হলে সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন হাইকোর্ট বিভাগের জনৈক বিচারককে কোর্ট অব সেটেলমেন্টের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তাৎক্ষণিক হাইকোর্ট বিভাগের ওই বিচারক সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪ এর দফা (৩) এর বিধানাবলির প্রতি প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। উল্লেখ্য, অনুচ্ছেদ ৯৪(৩) এ বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগে নিযুক্ত বিচারকগণ কেবল উক্ত বিভাগে এবং অন্যান্য বিচারক কেবল হাইকোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণ করবেন। ওই ঘটনার পর সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন বা অপর কোনো প্রধান বিচারপতি কোর্ট অব সেটেলমেন্টের চেয়ারম্যান পদে হাইকোর্ট বিভাগের কোনো কর্মরত বিচাকরকে নিয়োগের উদ্যোগ নেননি যদিও এ পদে হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের নিয়োগের নজির রয়েছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৭ এর দফা (৩) অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের কোন কোন বিচারক সমন্বয়ে কোন বিভাগের কোন বেঞ্চ গঠিত হবে এবং কোন কোন বিচারক কোন উদ্দেশ্যে আসন গ্রহণ করবেন তা এককভাবে প্রধান বিচারপতি নির্ধারণ করে থাকেন। এ বাস্তবতায় সরকার কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিভাগের কোনো বিচারককে সুপ্রিম কোর্ট বহির্ভূত অন্য কোনো বিচারালয়ে নিয়োগ দেয়া হলে প্রধান বিচারপতির সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণœ হয় কি না, এ বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। এখানে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ অনুযায়ী নিয়োগ কার্যটি সমাধা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্ন অনাবশ্যক যেহেতু অনুচ্ছেদ ১০৭(৩) প্রধান বিচারপতির একক এখতিয়ারের কথাই ব্যক্ত করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের কোনো বিধান সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে তা বাতিল বা বেআইনি গণ্য হবে না বলা হলেও আইনের ছাত্রদের মনে প্রশ্নের উদয় হওয়া স্বাভাবিক কোনো অধস্তন আইন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪ এর দফা (৩) এর বিধানাবলি উপেক্ষা করতে পারে কি না? সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এর দফা (২) দ্বারা দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে অন্যান্য আইনের ওপর সংবিধানের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সংবিধানের এ প্রাধান্যের বিষয়টিকে মূল উপপাদ্য হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সংবিধানের অষ্টম, পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করা হয়েছিল। আর তাই প্রশ্ন দেখা দেয়া স্বাভাবিক অনুচ্ছেদ ৭ এর দফা (২) এর সাথে অনুচ্ছেদ ৪৭ এর দফা (৩) ও ৪৭ক এর সহঅবস্থান সংবিধানের চেতনার আলোকে যৌক্তিক কি না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ২৩ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, এ আইনের অধীন কোন কার্যধারার ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এবং সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ প্রযোজ্য হবে না। স্পষ্টত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন এ ধারাটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৯ এর সাথে সাংঘর্ষিক। অনুচ্ছেদ ১৪৯ প্রচলিত আইনের হেফাজতসংক্রান্ত। এ অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছে, এ সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে সকল প্রচলিত আইনের কার্যকারিতা অব্যাহত থাকবে, তবে অনুরূপ আইন এ সংবিধানের অধীন প্রণীত আইনের দ্বারা সংশোধিত বা রহিত হতে পারবে। অপরাপর আইনের ওপর সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য বিবেচনায় নেয়া হলে কোনো অধস্তন আইন দ্বারা যে অনুরূপ অধস্তন অপর কোনো আইনের কার্যকারিতা স্থগিত করা যায় না সে প্রশ্নটি এসে যায়।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭ক সন্নিবেশন করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদটি অবলোকনে প্রতীয়মান হয় শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে অথবা সংবিধানের কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে এ কার্যটি রাষ্ট্রদ্রোহ হবে। সংবিধানের বিধানাবলি ও সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী যেকোনো কাজই সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করে এমনটি প্রতীয়মান হয়।
আমাদের সংবিধান এক দিকে দেশের অপর সব আইনের ওপর সংবিধানকে প্রাধান্য দেয়ায় এবং অপর দিকে সংবিধান দ্বারা অনুমোদিত নয় এমন পন্থায় সংবিধান রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত অথবা সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে অভিহিত করায় অনুকূল বা প্রতিকূল পরিবেশে সংবিধানের ভিন্নতর ব্যাখ্যা দেয়ার কোনো অবকাশ নেই।
সংবিধানের কোনো বিধানাবলি বিষয়ে অস্পষ্টতা দেখা দিলে কোনো একটি অনুচ্ছেদের একক অধ্যয়ন অস্পষ্টতা নিরসনে সহায়ক নয়। সংবিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং চেতনা অনুধাবন করতে হলে সামগ্রিকভাবে সংবিধানের সব অনুচ্ছেদের অধ্যয়ন প্রয়োজন। এ কথাটি অনস্বীকার্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য দেয়ায় সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যার বিষয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ক্ষেত্রে এ ধরনের জটিলতা কাম্য নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে দণ্ডিত ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করার অধিকার দেয়া হয়েছে। এ ধরনের আপিলকে বলা হয় সংবিধান নয় আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের অধীন দায়ের করা। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে সংবিধানের অধীন আপিল দায়েরের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হলে সে অধিকার রায় পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না, এমন প্রশ্নের উদ্ভব অস্বাভাবিক গণ্যে রুদ্ধ নয়।
সংবিধান যেখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে সংবিধানের সাথে অন্য কোনো আইনের সাংঘর্ষিকতাকে অনুমোদন করে না, সেখানে অধস্তন কোনো আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও সংবিধানের ওপর প্রাধান্য পাওয়া জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিতে রচিত সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্বকে ক্ষুণ্ন করে। এরূপ ক্ষুণ্ন হওয়া অস্পষ্টতাকে প্রশ্রয় দেয়। আর যেকোনো অস্পষ্টতার ব্যাখ্যা পরিস্থিতি বিবেচনায় সব সময় যে সমরূপ হবে অতীত অভিজ্ঞতা ধারণা দেয় এমন প্রত্যাশার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
(নিবন্ধটি শিক্ষামূলক আলোচনা বিধায় সংবিধান অবলোকনে স্বীয় অনুধাবনের অনুবলে রচিত)
লেখক : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক -
বাংলাদেশ সময়: ১৮:১২:৫০ ৪৭৩ বার পঠিত