সোমবার, ২৭ জুলাই ২০১৫
মিলন হত্যার চার বছর
Home Page » প্রথমপাতা » মিলন হত্যার চার বছরএকদিকে ছিল মামলা না চালানোর জন্য চাপ, অন্যদিকে ছিল প্রলোভন। একই সঙ্গে চলছিল তদন্ত বিলম্বিত করার কৌশল। ৫২ বার আদালত থেকে সময় নিয়ে তদন্ত দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। চার বছরের মাথায় অসহায় বাদী শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে পুলিশের কাছে হার মেনেছেন। পাঁচ লাখ টাকায় রফা করে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের কিশোর শামছুদ্দিন মিলন হত্যা মামলাটি শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের নামে আপাতত মাটিচাপা দিতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।
২০১১ সালের ২৭ জুলাই কোম্পানীগঞ্জের চর কাঁকড়া ইউনিয়নের নিরীহ কিশোর মিলনকে (১৬) ডাকাত সাজিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ গাড়িতে করে এনে উন্মত্ত জনতার হাতে ছোট্ট এই কিশোরকে ছেড়ে দেয়। সেখানে পুলিশের উপস্থিতিতেই তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পুলিশের গাড়ি থেকে তাকে নামিয়ে দেওয়াসহ পুরো ঘটনাটির ভিডিওচিত্র প্রকাশিত হলে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে প্রশাসনসহ সাধারণ মানুষ।
১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া, মিলনের ছোট ভাইকে পুলিশে চাকরি দেওয়া এবং বাবাকে বৈধভাবে বিদেশে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের কিশোর শামছুদ্দিন মিলন হত্যা মামলা চালানো থেকে তাঁর পরিবারকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়েছে স্থানীয় পুলিশ। তাদের পরামর্শে গত ২৪ ডিসেম্বর মিলনের মা মামলার বাদী কোহিনুর বেগম আদালতে ‘এজাহারনামীয় ও সন্দিগ্ধ ধৃত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নাই; আসামিরা অভিযোগের দায় হইতে মুক্তি পাইতে ও চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে কোনো আপত্তি নাই ও থাকিবে না’ মর্মে আবেদন করেন। এরপর মিলনের বাবাকে দেওয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা। তারপর দ্রুতই মামলা ‘গুছিয়ে ফেলে’ পুলিশ।
কেন এমন আবেদন করলেন জানতে চাইলে মিলনের মা কোহিনুর বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাড়ে তিন বছর ধরে বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় ঘুরেছি। ডিবি পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা বলে কোর্ট থেকে ডিবি পুলিশ ৫২ বার সময় নিয়েও তা দেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আদালত আর ডিবি পুলিশের কাছে যাতায়াত করতে করতে আরও নিঃস্ব হয়েছি। তাঁরা (পুলিশ) এবং অন্য লোকজনও মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য সব সময় চাপ দিয়ে আসছে।’
কোহিনুর বেগম বলেন, মিলনের বাবা বিদেশ থেকে চলে আসায় সংসারে আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় মিলনের ছোট ভাই সালাউদ্দিনকে পুলিশে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেন বর্তমানে কোম্পানীগঞ্জ থানায় কর্মরত এসআই মো. রবিউল। এসব কারণে তিনি মামলা নিষ্পত্তিতে রাজি হন। তবে আদালতে দাখিল করা আবেদনটিও পুলিশের লোকজন ঠিক করে দিয়েছেন।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে মামলটি নিষ্পত্তির আগে হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে সন্দেহভাজন কোম্পানীগঞ্জ থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আকরাম উদ্দিন শেখ পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন মিলনের বাবাকে। প্রায় তিন মাস আগে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ওরফে বাদলের মাধ্যমে ওই টাকা দেওয়া হয়। টাকা দেওয়ার সময় কোম্পানীগঞ্জ থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সাজেদুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমানে বাগেরহাটের ফকিরহাট থানায় কর্মরত এসআই আকরাম উদ্দিন শেখ মামলা নিষ্পত্তির জন্য উপজেলা চেয়ারম্যানের মাধ্যমে মিলনের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন প্রথম আলোর কাছে। তিনি বলেন, ‘একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, এখন আর কী করা।’
মিলন হত্যার মতো একটি চাঞ্চল্যকর মামলা টাকার বিনিময়ে নিষ্পত্তি করা হলো কেন—জানতে চাইলে চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিলনের বাবার পাগলামির জন্যই এটি হয়েছে। বাড়িতে ঘর করতে তিনি মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে টাকা নিয়ে দিতে বারবার আমার কাছে আসেন। একপর্যায়ে এসআই আকরামকে বললে তিনি রাজি হন।’
তবে মিলনের বাবা গিয়াস উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এসআই আকরাম শেখ তাঁকে দফায় দফায় ফোন করে ‘বেয়াই’ সম্বোধন করেন। তাঁকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার এবং বৈধভাবে আবার বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেন। এসআই আকরামই তাঁকে প্রায় দেড় বছর আগে সৌদি আরব থেকে দেশে আনেন বলে জানান তিনি।
মিলনের বাবা এ-ও বলেন, দেশে আসার পর সংসারে আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি বাড়িতে অন্যের জায়গায় যে বসতঘর ছিল, তারাও তা সরিয়ে নিতে চাপ দিতে থাকে। এ অবস্থায় তিনিও টাকা নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে মামলা নিষ্পত্তিতে রাজি হন।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৩৭:১৮ ২৯৬ বার পঠিত
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]