শনিবার, ৪ জুলাই ২০১৫
প্রতিকূলতার মধ্যেও শক্ত অবস্থানে গ্রামীণ ব্যাংক
Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » প্রতিকূলতার মধ্যেও শক্ত অবস্থানে গ্রামীণ ব্যাংকবঙ্গনিউজ ডটকমঃ এক বছরে নিট সম্পত্তি বেড়েছে ২ হাজার ২০৩ কোটি টাকার আমানত বেড়েছে ২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৭৩০ কোটি টাকা আদায়ের হার ৯৮ শতাংশ
বিভিন্ন মহলের চাপ, শঙ্কা, ব্যাংকের অধ্যাদেশ বিলুপ্ত, চেয়ারম্যানের পদত্যাগ, পর্ষদ না থাকা ও কর্মীদের আন্দোলনসহ নানা কর্মকা-ের পরও শক্ত অবস্থানে রয়েছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক। যদিও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাষায় ভয়াবহ পরিস্থিতির (হরিবল সিচুয়েশন) মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ব্যাংকের নিট সম্পদ, আমানত, ঋণ বিতরণ ও আদায়ের পরিসংখ্যান বলছে, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ভালো চলছে গ্রামীণ ব্যাংক।
জানতে চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএম মহিউদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, সার্বিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক ভালো চলছে। প্রধান কার্যালয় থেকে শুরু করে শাখা পর্যায়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে বোর্ড গঠন না হওয়ায় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। আগের চেয়ে ব্যাংকের আমানত, ঋণ বিতরণ ও আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আদায়ের হার ৯৮ শতাংশ। সদস্য সংখ্যা প্রতিমাসেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান তিনি।
গ্রামীণ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ব্যাংকটির ৮৬ লাখ ৪০ হাজার সদস্যের মধ্যে ব্যাংকের বিতরণকৃত মোট ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৯ হাজার ২৮৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। একই সময়ে ঋণ আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪৬৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। আদায়ের হার ৯৮ শতাংশ। দেশের ৬৪টি জেলার ৪৭২টি উপজেলার ৮১ হাজার ৩৯০টি গ্রামে ২ হাজার ৫৬৮টি শাখার মাধ্যমে এই ঋণ বিতরণ হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের মোট সদস্যের ৯৬ দশমিক ২৬ শতাংশই নারী।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গ্রামীণ ব্যাংকের ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক সরকার। বাকি ৭৫ শতাংশের মালিক গ্রামীণ ব্যাংকের সাধারণ সদস্যরা। গ্রামীণ ব্যাংকের পর্ষদের পরিচালক নির্বাচনের জন্য সরকার গত বছরের জুলাইয়ে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্বাচন অনুষ্ঠানটি করে দেয়ার দায়িত্ব দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে রাজি হয়নি। পরে বিধি সংশোধন করে বলা হয়, অবসরপ্রাপ্ত একজন জেলা জজ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হবেন। চেষ্টা করেও কোনো জেলা জজকে পাচ্ছে না সরকার।
গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, একটি ম্যানেজমেন্ট হয়তো বিভিন্ন কর্মী দিয়ে ব্যাংকটি চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে ব্যাংকটিকে স্থিতিশীল এবং টেকসই পথে নিয়ে যাওয়া, নতুন পণ্য, সার্ভিস বৃদ্ধি করা, বহুমুখী করা ইত্যাদির ক্ষেত্রে উপরের বা পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া হয় না। পরিষদই এসব সিদ্ধান্ত দেবে। পরিষদ না থাকলে ব্যাংকটির ওপর ভবিষ্যতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যত দ্রুত সম্ভব গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ করে দেয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি।
জানা গেছে, ২০১১ সালের পর থেকে বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) পদটি খালি রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে চালানো হচ্ছে ব্যাংকটি। চাকরির বয়স পার হয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এমডি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ওই পদ থেকে অব্যাহতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সদস্যদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পরিচালনা পর্ষদের ৯ নারী সদস্যের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আইনি জটিলতায় সেই ৯ নতুন পরিচালক নির্বাচন করা যায়নি। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ৯টি পদ শূন্য হলেও এই পদগুলোয় পরিচালক নির্বাচন করতে পারছে না সরকার। যদিও সরকারের অংশের জন্য সরকার ৩ জন সদস্যকে নিয়োগ দিয়েছে।
বর্তমান সরকার গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার জন্য যে তিন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছে, তাদের মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হক। তিনিও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রীর কাছে। নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেয়ার পর তার এই পদত্যাগপত্র কার্যকর হবে। এখন পর্যন্ত নতুন চেয়ারম্যান পাওয়া যায়নি বিধায় তিনি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এছাড়াও গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম এবং আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার। বোর্ডের চতুর্থ সদস্য হলেন ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম মহিউদ্দিন।
বেড়েছে নিট সম্পদ : এরপরও বাড়ছে ব্যাংকটির নিট সম্পদের পরিমাণ। পাঁচ বছরে ব্যাংকের নিট সম্পদ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের নিট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। এর আগের বছরে এ সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে নিট সম্পদ বেড়েছে ২ হাজার ২০৩ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৩১ শতাংশ।
আমানত : ব্যাংকটিতে পাঁচ বছরের ব্যবধানে আমানতের পরিমাণ ৬১ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০১০ সালে যেখানে আমানতের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছর আমানত ছিল ১৪ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে আমানত বেড়েছে ২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা, অর্থাৎ ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
ঋণ বিতরণ : বেড়েছে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণের পরিমাণও। পাঁচ বছরে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। এক বছরে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৭৩০ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
এদিকে, গ্রামীণ ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গঠন করেছে সরকার। যদিও গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে এর কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন গ্রামীণ ব্যাংক যেখানে ক্ষুদ্রঋণের ওপর গুরুত্ব দেয়, সেখানে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ওপর গুরুত্ব দেবে। গ্রামীণ ব্যাংক ঋণগ্রহীতা শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয় না, বিশেষায়িত এ ব্যাংক তা দেবে। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সরকার থেকে বলা হয়েছে, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের আওতাধীন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ শীর্ষক প্রকল্পভুক্ত দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিসহ নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। এছাড়া গ্রাম সংগঠন সৃজন, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, তহবিলের জোগান ও ঋণদানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনেও এটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। আর এ কার্যক্রমের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, তাদের সঞ্চয়, অর্জিত লেনদেন, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঋণ অগ্রিম প্রদান ও বিনিয়োগের জন্য বিশেষায়িত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা গ্রামীণ ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করিয়েছে সরকার। তবে এটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:১৭:১৯ ৩৪৪ বার পঠিত