শনিবার, ২০ জুন ২০১৫

আর দেখা যাবে না মিঠুনকে!

Home Page » বিনোদন » আর দেখা যাবে না মিঠুনকে!
শনিবার, ২০ জুন ২০১৫



143476913904.jpgবঙ্গনিউজ ডটকমঃ এক বছরেরও বেশি কোনও পার্টি, জনসভা এমনকী নিজের ছবির প্রচারেও যাননি তিনি। সেই ‘মৃগয়া’ রিলিজের সময় থেকে চার দশকেরও বেশি পাবলিক লাইফে কাটানো সুপারস্টার আচমকা স্বআরোপিত নির্বাসনে। পরিবার বাদ দিয়ে কেউ তাঁকে দেখতে পান না। প্রায় কেউ তার গলা শোনে না। কী হল মিঠুন চক্রবর্তী-র?

খরচ করতে রাজি থাকলে উটিতে এর চেয়ে ভাল হোটেল অন্তত চার-পাঁচটা রয়েছে। এটা তিন-তারা। ঠাটবাটে আগের সেই জৌলুসও যেন অন্তর্হিত।

কিন্তু উটি লেক-কে ডান দিকে রেখে পাহাড়ি রাস্তাটা ওই যে পাকদণ্ডীর মতো উঠে যাওয়া আর জায়গায় জায়গায় রোড সাইন দেখানো ‘দ্য মনার্ক’। ওখান থেকেই একটা রোমাঞ্চ তৈরি হতে বাধ্য। পুরনো অতিথি কারও মনে পড়তেই পারে এখানেই তো দলবলসহ এক মাসের ওপর থেকে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-এর শ্যুটিং করেছিলেন শাহরুখ খান। একই সময়ে চলছিল হোটেল মালিকের নিজস্ব হিন্দি ছবির শ্যুটিং।

সেই সময়কার জৌলুস-চেকনাই-ঘরের জন্য তীব্র আকুতি কোথায় এই ২০১৫-র মধ্যজুনের ভরপুর ট্যুরিস্ট সিজনে! এক ঝলকে বরং কৌতূহল হবে হোটেল কর্মীর সংখ্যা বেশি না বোর্ডারদের? অথচ এই শৈলশহরের বড় সব হোটেলের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা জুড়ে মনার্ক। যার রয়েছে নিজস্ব হেলিপ্যাডও। সময় মাহাত্ম্যে এটা আজ হয়তো তিন তারা কিন্তু উটির সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত হোটেল সংলগ্ন ওই এলাকাটার মধ্যে একটা নীরব স্পর্ধিত ঘোষণা রয়েছে।

সবাইকে ছাড়িয়ে আজ আমি সবার ওপরে। বিস্তৃত সাম্রাজ্য নিয়ে একা। অঘোষিত মনার্ক!

এই প্রতিজ্ঞার নামও ঐতিহাসিক ভাবে মিঠুন চক্রবর্তী।

মাতুঙ্গা জিমখানার যে মাঠ থেকে দিলীপ বেঙ্গসরকরের উত্থান, তার ঠিক পেছনেই একটা রংচটা আবাসিক হোস্টেল ছিল। একবার ছেলে নকুলকে নিজের ভিত্তিভূমি দেখাতে নিয়ে গিয়ে শোনা যায় পেছনের হোস্টেলটাও দেখিয়েছিলেন বেঙ্গসরকর। বলেছিলেন, ‘‘এটা আরও ভাল করে দেখো। এখানেই স্ট্রাগলিং পিরিয়ড কাটিয়েছে মিঠুন। আমরা নেট করতে এসে ওর গল্প শুনতাম। রোজ ভোর সাড়ে চারটেয় এই বাড়িটার পাঁচিল টপকে ও নেমে যেত জীবন সংগ্রামে। ভোরে ওঠা ছাড়া উপায় ছিল না কারণ এখানে ও বেআইনি থাকত অন্যের ঘরে।”

বহু আন্তর্জাতিক ম্যাচে বেঙ্গসরকরের ব্যাটিং পার্টনার শ্রীকান্ত হিন্দি ছবি দেখেন বলে শুনিনি। কিন্তু কলকাতায় মিঠুনেরই ডাকে চ্যারিটি ম্যাচ খেলতে এসে বলেছিলেন, ‘‘শুধু এই লোকটার জন্য এলাম। একটা লোক বিয়েবাড়িতে নেচে দৈনিক খাবারের টাকা জোগাড় করতে করতে কী করে সুপারস্টার হয়ে গেল, ওর কাছে জানতে চাইব।”

কাহিনির উপপাদ্য: মিঠুন চক্রবর্তীর দারিদ্র জয় করে উচ্চাকাঙ্ক্ষার মসনদে সুলতানি আর সব পেশার মানুষেরও বারবার কেস স্টাডি হয়েছে।

কিন্তু সেই মিঠুনের খোঁজ আধুনিক সময়ে কোথায়? মনার্ক রিসেপশনের কর্মী নিস্তেজ গলায় জানালেন স্যর পাঁচ-ছ’মাস বাদে বাদে আসেন। আচ্ছা এর মধ্যে কি আসবেন? কেউ জানে না।

নতুন মিঠুনকে ধরারও কোনও উপায় নেই। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার। করিমপুর থেকে ঝালদা ঠেসে প্রচারের পর হঠাৎই মিঠুন নিপাত্তা। এই সময় থেকেই সারদা কেলেঙ্কারিতে আর পাঁচটা নামের সঙ্গে মিঠুন প্রসঙ্গও উপস্থিত হতে থাকে। কাগজে বেরোতে থাকে ইডি-র লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।

এর পর থেকেই তিনি এক রকম স্বেচ্ছা বনবাসে। অভিমানে একা। রাজ্যসভা যান না। কোনও পার্টিতে না। কোনও রিলিজে না। নিজের বিশাল বাজেটের ছবি এর মধ্যে দেব-কোয়েল সহ মুক্তি পেয়েছে। প্রমোশন করেননি। রান্নার শো করছিলেন সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে। তারা বারবার বলার পরেও প্রমোশনে যাননি। প্রচণ্ড বিরক্ত তারা আর চুক্তি নবীকরণ করেননি। মিঠুন- তিনি তাতেও অনুতাপের কারণ দেখেননি।

নইলে গত মঙ্গলবার তার জন্মদিনে ‘নকশাল’ ছবির ফার্স্ট স্ক্রিনিংয়ে আসবেন না কেন? ওটা তো মুম্বইতেই হয়েছিল। মাড আইল্যান্ডে মিঠুনের বাংলো থেকে দশ কিলোমিটারের ভেতর। পরিচালক প্রায় কেঁদে ফেলতে বাকি রাখার পরেও মিঠুন সেখানে যাননি। বলেছেন প্যানক্রিয়াটাইটিসের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছেন। স্ক্রিনিং বা প্রচারে যাওয়ার অবস্থা নেই।

এটা সত্যি যে মাঝে প্যানক্রিয়াসজনিত সমস্যায় নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন মিঠুন। এতটাই নাকি ব্যথা ওঠে যে দূরে নেওয়া যায়নি। বাড়ির সবচেয়ে কাছের মধ্যবিত্ত নার্সিংহোমে দিন চারেক ভর্তি ছিলেন। কিন্তু সে তো অসুস্থতা। মধ্যবয়স্ক মানুষের হতেই পারে। তা বলে জনজীবন থেকে এ ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন কেন? মোবাইলে আজ পরিচিতদেরও তাকে ধরার উপায় নেই। এই জন্য নয় যে নাম্বার বদলেছেন। তিনি এককালের মহাগুরু, মোবাইল ব্যবহার করাই ছেড়ে দিয়েছেন।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের জগতে সক্রিয় কর্মজীবনে থাকতে থাকতে কেউ এমন বনবাসে গিয়েছেন বলে মনে করতে পারি না। এমন তীব্র প্রচারের যুগে লোকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অবস্থাতেও টুইট করে। ফেসবুক পোস্ট করে। ভিডিয়ো ব্লগে ইন্টারভিউ দেয়। মিঠুন সেটা করতে পারেন না?

তার ঘনিষ্ঠ মহলের একাংশের ব্যাখ্যা, জাগতিক এই সব কিছু থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন তীব্র বিতৃষ্ণায়। গভীর অভিমানেও।

মিঠুনের কাছের লোকেদের মতে এই সময়টায় তাকে নিয়ে যা বলা বা লেখা হয়েছে তার অনেকটাই অতিরঞ্জিত। মিঠুন পেশাদার শিল্পী। তিনি আর পাঁচজনের মতো অনুষ্ঠান করেছেন, টাকা পেয়েছেন। ইডি চাওয়ামাত্র তার পুরো রসিদ দেখিয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তা হলে কেন আর পাঁচ জন নেতার সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে যারা সারদা থেকে বিশেষ সুবিধে নিয়েছেন? কেন মদন মিত্রর সঙ্গে একই সেনটেন্সে তাকে রেখে প্রতিবেদন বেরোবে?

মিঠুনের বরাবরের অহঙ্কার থেকেছে তার সততা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা। একটা সময় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘ কয়েক বছর সবচেয়ে বেশি আয়কর দিয়েছেন। অগণিত জনহিতকর কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন। উটি ছাড়াও তাঁর হোটেল রয়েছে মসনাগুড়ি আর মাইসোরে। সেই বীরাপ্পান অধ্যুষিত সময়ে যখন তামিলনাড়ু চেকপোস্টে প্রত্যেক গাড়ি চিরুনি তল্লাশির পর তবে ঢোকার অনুমতি মিলেছে তখন মনার্ক হোটেলের বোর্ডার শুনলে রক্ষী এককথায় ছেড়ে দিয়েছে- ওহ্ দাদা! ওকে।

নীলগিরি পাহাড়ের কাছে ওই সব অঞ্চলে আজও দাদা মানে মিঠুন!

কিন্তু সাম্প্রতিক বিতর্কে এত বছরের সেই বিশ্বাসযোগ্যতার ব্র্যান্ডিং-ই তো আক্রান্ত।

মিঠুন নাকি সবচেয়ে হতাশ এবং দুঃখিত হয়ে পড়েছেন দেখে যে রাজ্যের মানুষের জন্য তিনি এত বছর করেছেন তাদের থেকে একজনও আওয়াজ তোলেনি তার পক্ষে। রক্ষণশীল গণনায় অন্তত বারো থেকে পনেরো কোটি টাকা পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দান করেছেন মিঠুন। একদিন চোখের সামনে দেখা। এবিপি লাইব্রেরির কর্মী শৈলেন বলে একটি ছেলে দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত ছিল। তাকে তুলে দিলেন তিরিশ হাজার। সেটা হাতে তুলে দিতে না দিতেই মধ্য কলকাতায় তার হোটেল ঘরে ঢুকে পড়ল আর এক ব্যক্তি। দাদা আমারটা? মিঠুন তাকে দিলেন কুড়ি হাজার। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কলকাতা পুলিশের বড়কর্তার চিঠি নিয়ে হাজির থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত এক যুবক। পঞ্চাশ হাজার টাকা এককথায় তুলে দিলেন। আগের রাতের জলসা থেকে পাওয়া এক লাখ টাকা দশ মিনিটে শেষ।

এ রকম ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেছে। কেউ হয়তো এসে বলেছে মালদাতে অমুক ক্লাব চোখ অপারেশনের জন্য পঁচিশ হাজার টাকা দেবে বলছে। শুধু আপনাকে যেতে হবে। চলে গেছেন। কেউ বলেছে তার স্বপ্ন বেঙ্গল ফুটবল অ্যাকাডেমিতে দশ হাজার টাকা দেবে। কিন্তু মিঠুনকে সেটা নিতে হবে। এর পর প্রত্যন্ত বেহালায় মিঠুন পৌঁছে গিয়েছেন তার ফুটবলার বন্ধুদের জন্য টাকাটা নিতে। মিঠুন-শিবির অভিমানে আজ হয়তো ঠিকই বলছে এত দিনে একজন ফুটবলারও এগিয়ে এসে বলতে পারল না এই লোকটা আমাদের জন্য কী কী করেছে!

মিঠুনকে তখন ঘনিষ্ঠরা কেউ রসিকতা করে ডাকতেন ‘ফাদার মিঠুন’। কেউ বলতেন ‘প্রয়াগের মেলায় হর্ষবর্ধন’। আর হুঁশিয়ারি দিতেন দান খয়রাতি বন্ধ করুন। এটা শুরুর কথা একমাত্র ভাবতে পারেন রাজনীতিতে গেলে। ওখানে অনেক ফান্ডের ব্যবস্থা থাকে। মিঠুন শুনে বলতেন, রাজনীতি বড় নোংরা জায়গা। ওখানে আমি ঢুকব না। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সুভাষ চক্রবর্তীকে এক রাজনৈতিক মঞ্চে নিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় মগ্ন মিঠুন। দু’জনের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছেন। কিন্তু জীবনে যে আর কখনও সিরিয়াস প্রেম করবেন না এবং রাজনীতিতে কিছুতেই নামবেন না, বারবার বলতেন।

কে জানত, সেই রাজনীতির ছোবলই তাকে চিরহাসিমুখ, চিরসাতাশ ডিস্কো ডান্সার থেকে এক অভিমানী, বিষাদগ্রস্ত সিক্সটি সামথিংয়ে নামিয়ে আনবে? যেখানে পেশার ক্ষতি করে, আর্থিক দিকটাকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি এমন একটা রোলে, যা চলচ্চিত্রে করে থাকতে পারেন। বাস্তবে এমন বনবাসী মিঠুনকে কেউ দেখেনি। স্বপ্নেও ভাবেনি।

পদ্ম সম্মান এত উচ্চাকাঙ্ক্ষার ছিল তার জীবনে। বোধহয় নিজের তিনটে জাতীয় পুরস্কার দিয়ে দিতে রাজি ছিলেন একটা পদ্মশ্রীর বিনিময়ে। এটা এক অদ্ভুত মানসিকতা, একটা সময় নকশালি ছেলের রাষ্ট্রের গুঁতো খেয়ে শহরত্যাগের কাঁটাটাই বোধহয় একই মননে সেই রাষ্ট্র থেকে স্বীকৃতির পালক চায়- পদ্মশ্রী।

চোখের সামনে প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি রক্তাক্ত হতে দেখেছেন নিজের হৃদয়কে। দেখেছেন বলিউডের আতিপাঁতি সবাইকে সরকার সম্মান দিচ্ছে। কৃষ্ণসার মেরে কার্যত দণ্ডিত সইফ। অনেক পরে আসা আমির। এমনকী সেদিনের বিদ্যা বালনও। অভিনয় এবং সমাজসেবা মিলিয়ে তাঁর অসামান্য প্রতিনিধিত্ব নাকি বারবার বিবেচনা হয়েও নাকচ হয়ে যায়। ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গের জন্য এত করেও এই শহরে থাকার কোনও জমি দেওয়া হয়নি তাকে। বামফ্রন্ট সরকার তার দরখাস্ত নিয়ে মোটামুটি উইপোকায় খাইয়ে দিয়েছে। মিঠুন সেই অভিজ্ঞতার পর নতুন জমানায় আর আবেদনই করেননি।

জীবন, পারিপার্শ্বিক এবং সময় থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন এই মিঠুন মাড আইল্যান্ডে সমুদ্রের ধারের বাংলোতে এখন সময় কাটান। কেউ জানে না কবে আবার পাবলিক লাইফে ফেরত আসবেন। উদভ্রান্ত, অভিমানী তার মনন। সারদার টাকা ফেরত দেওয়াটাও সেই অভিমানী বনবাসেরই এক দিকনিরীক্ষণ। যে পেশাদার হিসেবে রাখতেই পারতাম টাকাগুলো। কিন্তু আমার কাছে অগ্রাধিকার হল নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা ফেরত পাওয়া। যা কোটি টাকার চেয়েও অনেক দামি।

ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকের মনে হচ্ছে বড় বেশি স্পর্শকাতর হয়ে পড়লেন মিঠুন। নিন্দামন্দ পাবলিক লাইফে থাকেই। তার জন্য এত সেন্টিমেন্টাল হলে চলে নাকি? বচ্চনকেও তো বোফর্সের সময় কত কিছু শুনতে হয়েছে। মিঠুন- যার জীবনটাই লড়াইয়ের জ্বলন্ত মশাল হিসেবে এত মানুষের দৃষ্টান্ত, তিনি কেন ফুঁপিয়ে থাকা অভিমান নিয়ে নিজেকে এ ভাবে বন্দি করে রাখবেন?

নাকি এটা বিরতি? তার অনেক সুপারহিট ছবির মতো আক্রান্ত, অবসন্ন হিরো নক আউট ঘোষণার ঠিক আগে উঠে দাঁড়াবে, যেমনটা সে জীবনে দাঁড়িয়েছিল! লোকে হ্যাপি এন্ডিং দেখে খুশিমনে বেরোবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪:৪৩:৩০   ৪৪৮ বার পঠিত