শনিবার, ৬ জুন ২০১৫
ধাক্কা দিতে হবে
Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » ধাক্কা দিতে হবেবঙ্গনিউজ ডটকমঃ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও মনে করেন, রাজস্ব সংগ্রহের দিক থেকে প্রস্তাবিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট উচ্চাভিলাষী হয়েছে। তবে তিনি এ-ও বলেন, এই উচ্চাভিলাষ পূরণ হওয়া খুবই সম্ভব। এ জন্য একটা ধাক্কা দিতে হবে।
সে ধাক্কার জন্যই অর্থমন্ত্রীর ভরসা হচ্ছে নতুন করদাতা। যাঁদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায় করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আর কর আদায়ে এনবিআরের সক্ষমতার প্রতি আস্থাও রয়েছে তাঁর।
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। অর্থমন্ত্রীর যুক্তি হচ্ছে, ‘আমাদের উদাহরণ রয়েছে এক বছরে ২৩ শতাংশ বাড়তি কর আদায়ের। আগামী অর্থবছরে ৩০ শতাংশ বাড়তি কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এখনকার এনবিআর এ জন্য প্রস্তুত। কারণ, সংস্থাটির জনবল বাড়ানো হয়েছে এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।’
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে পাশে নিয়ে প্রশ্নোত্তরনির্ভর সংবাদ সম্মেলনটি করেন অর্থমন্ত্রী। সঙ্গে রাখেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান, অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন আহমেদ ও পরিকল্পনাসচিব শফিকুল আজমকে।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারাই “উচ্চাভিলাষী” শব্দটি ব্যবহার করেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী হয়েছে। তবে এটাও তো ঠিক, রাজস্ব সংগ্রহে একটা বড় ধরনের ধাক্কা দেওয়ার সময় এসেছে।’
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশে উন্নীত করতে চাইলে রাজস্ব সংগ্রহের যে অতিরিক্ত উদ্যোগের দরকার, সরকার এরই মধ্যে তা নিয়েছে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী। জরিপ করে নতুন করদাতার সন্ধান পাওয়া গেছে। অবশ্য হতাশার সুরও শোনা যায় মুহিতের কণ্ঠে। তিনি জানান, ‘করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধির গতিটা খুবই শ্লথ। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৭ লাখ, এখনো ১১ লাখ।’
সাংবাদিকদের কাছ থেকে একেক দফায় চার-পাঁচটি করে প্রশ্ন নিয়ে কখনো জবাব দেন অর্থমন্ত্রী, কখনোবা অন্য মন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং সচিবদের জবাব দেওয়ার সুযোগ দেন তিনি। প্রায় দুই ঘণ্টার এই সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী অনেক প্রশ্ন পাশ কাটিয়েও যান।
বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কালোটাকা বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে কোনো কিছু না থাকার কারণ ব্যাখ্যা করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আয়কর আইনে জরিমানা নিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দেওয়া আছে। তাই এটা নিয়ে বিশেষ কোনো বক্তব্য রাখার দরকার ছিল বলে মনে করিনি।’
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও দেশীয় বাজারে এখনো কমানো হয়নি কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে মুহিত বলেন, ‘এটা এখনো সমন্বয় করা হয়নি। আসলে জ্বালানি খাতে গত ৩০-৪০ বছরে আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর অর্থায়নটা স্বচ্ছ নয়। চিন্তা করছি কীভাবে যৌক্তিক করা যায়।’ তবে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে আমাদের বাজারের একটা মাত্রা বজায় রাখা হবে বলে জানান তিনি।
ইন্টারনেট ব্যবহারসহ মোবাইলে যেকোনো ব্যবহারের ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানোর যৌক্তিকতা জানতে চাইলে মুহিত বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা আছে। ব্যবহারকারীরা তা দিতে পারবেন বলেই তাঁর বিশ্বাস।
ভর্তুকির পরিমাণ গোপন রাখা হয় কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে শুভংকরের ফাঁক রয়েছে বলে সরল স্বীকারোক্তি দেন। অবশ্য তিনি ভর্তুকির পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, ‘বিদ্যুতে যে আমরা ভর্তুকি দিই, না দিলে তো বিদ্যুৎ দিতেই পারব না। কল্যাণরাষ্ট্রের পক্ষেই এ ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব। এটা শুধুই ভর্তুকি নয়, এটাকে বলা যায় প্রণোদনা। বিনিয়োগও বলা যায়।’
২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমার আওতায় শুধু প্রতিবন্ধী, বিধবা ও বয়স্ক কিছু মানুষ থাকবেন-এমন মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এই শ্রেণিটা সব দেশেই থাকে। যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে। এটা থাকবেই।’
খেপলেন অর্থমন্ত্রী: চিনির ওপর শুল্ক বাড়ানোবিষয়ক এক প্রশ্নের অর্ধেক শুনেই খেপে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কোত্থেকে পেয়েছেন? আমার বাজেট বক্তৃতার কোথাও আমি এ কথা বলিনি।’
কিছুক্ষণ পর আরেকজন সাংবাদিক বাজেট বক্তৃতার ১২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় চিনির শুল্ক বাড়ানোর বিষয়টি তুলে ধরলে অর্থমন্ত্রী তখন ওই পৃষ্ঠায় চিনিসংক্রান্ত অংশটি পড়েন এবং হেসে বলেন, ‘আপনি এটা ধরিয়ে দিয়েছেন, সে জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’
অর্থমন্ত্রী এরপরই এনবিআর চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, ‘এটা কীভাবে হলো?’ জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘স্যার, রাজনৈতিক নির্দেশনা অনুযায়ী আপনার বক্তৃতায় এটা রাখা হয়নি। তবে ছকে রয়ে গেছে। আমরা একটা সংশোধনী দেব। সংশোধনীতে ছক থেকে চিনির অংশ বাদ দেওয়া হবে।’
অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে বাজেটে প্রতি টনে দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে চার হাজার এবং পরিশোধিত চিনিতে প্রতি টনে ৪ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে আট হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়।
শেষ পর্যন্ত চিনির শুল্ক থাকছে কি না-আবারও জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, ‘এটা অর্থবিলে থাকবে না।’
ন্যূনতম আয়কর সিটি করপোরেশনে তিন হাজার, পৌরসভায় দুই হাজার ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এক হাজার টাকা থেকে এক লাফে সবার জন্য চার হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে কোন বিবেচনায়-জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে সংশোধনী আনবেন বলে জানান। তিনি বলেন, শুধু সিটি করপোরেশনে এক রকম হার হবে, আর বাকি দুটিতে হবে এক রকম।
অর্থমন্ত্রী নিরুত্তর: বাজেটের আগের দিন প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাজেট বক্তব্যে প্রতিরক্ষা খাত নিয়ে যে তেমন কিছু বলা থাকে না, এটা একধরনের পাকিস্তানি প্রথা (ট্র্যাডিশন)। এ প্রথা ভাঙার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না জানতে চাইলে কোনো জবাব দেননি অর্থমন্ত্রী।
এ ছাড়া এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকেরা আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন কাঠামোতে বেতন পাবেন কি না, আমাদের মাথাপিছু ঋণ কত, এতগুলো ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও সমৃদ্ধির সোপান ব্যাংক নামে আরেকটি ব্যাংক করার দরকার আছে কি না-এসব প্রশ্নের জবাব দেননি অর্থমন্ত্রী।
কৃষি বরাদ্দ: প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ কমানোবিষয়ক প্রশ্নের জবাব কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকেই দিতে বলেন অর্থমন্ত্রী।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, কৃষককে মহাজোট সরকার যা দিয়েছে, এর আগে কখনোই কৃষক তা পাননি। কয়েক দিনের খবরের কাগজের শিরোনামই কৃষি খাতের প্রকৃত চিত্র নয়, প্রকৃত চিত্র হবে সারা বছরের চিত্র।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘কেউ কি চিন্তা করেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে একদিন খাদ্য রপ্তানি হবে? এখন সবজি রপ্তানি হচ্ছে, চালও রপ্তানি হচ্ছে। খবরের কাগজে দেখেছেন, আমও এখন রপ্তানিপণ্য।’
কৃষকেরা এখন পণ্যের দাম পাচ্ছেন দাবি করে মতিয়া চৌধুরী সাংবাদিকদের গ্রামে গিয়ে কৃষকদের চেহারা দেখে আসার আহ্বান জানান।
তিন মন্ত্রীর বক্তব্য: শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, একটা জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য উচ্চাভিলাষ থাকাটা খারাপ না। যাঁরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, তাঁরাই এ বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘ছয় বছর আগে ভারত-চীনের প্রবৃদ্ধি হতো ১৪ শতাংশ হারে। সেটা কমে এসেছে। একবার ওপরে উঠে গিয়ে আবার ফিরে আসব, এটা আমরা চাই না। সে কারণে আমরা ধীরে এগোচ্ছি।’
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রস্তাবিত বাজেট ‘গোল্ডেন জিপিএ-৫’ এবং রাজনৈতিক ঘাটতি মোকাবিলার সক্ষমতা ‘জিপিএ-৫’ পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, দেশে এখন কোনো গণতান্ত্রিক ঘাটতি নেই। তবে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ঘাটতি আছে। এই ঘাটতিও দূর হয়ে যাবে।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ দিকে প্রতিরক্ষা খাত ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নতুন কাঠামোতে বেতন পাওয়ার বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে অর্থমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘সব প্রশ্নের উত্তর সব সময় দেওয়া যায় না।’
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৪৭:৩১ ৩৮১ বার পঠিত