মঙ্গলবার, ২৬ মে ২০১৫
পাতানো দরপত্রে নোয়াখালী ও সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ
Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » পাতানো দরপত্রে নোয়াখালী ও সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজবঙ্গনিউজ ডটকমঃ মেডিকেল শিক্ষার্থীদের একটি পাঠ্যবইয়ের সিরিজ ‘ওয়ান স্টপ ডক’, যার একটি খণ্ডের নাম মেটাবলিজম অ্যান্ড নিউট্রিশন। যুক্তরাষ্ট্রের সিআরসি প্রেস প্রকাশিত ১২৮ পৃষ্ঠার এ বইটি দেশের বাজারে এক-দেড় হাজার টাকায় পাওয়া যায়। অনলাইনে কেনাকাটার ওয়েবসাইট অামাজনে দাম চার ডলার (প্রায় ৩২০ টাকা)। নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ একই বই কিনেছে ৮৮ হাজার ৫০০ টাকায়!
পাতানো দরপত্রের মাধ্যমে পছন্দের ব্যক্তিকে কাজ দিয়ে এমনই কয়েক গুণ বেশি দামে বই কিনেছে নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ। যেসব বই কেনা যেত দেড় কোটি টাকায়, সেসব বই কিনতে কলেজ কর্তৃপক্ষ খরচ করেছে ছয় কোটি টাকা। তিনটি সরকারি দপ্তরের প্রতিবেদনে নোয়াখালী মেডিকেলে বই কেনায় অনিয়ম এবং সরকারি ক্রয়বিধি লঙ্ঘনের এ ঘটনা প্রমাণিত হলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বই ও আসবাব কেনায় অনিয়ম হয়েছে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজেও। নোয়াখালী মেডিকেল যে ব্যক্তির কাছ থেকে চড়া দামে বই কিনেছে, সেই একই ব্যক্তির কাছ থেকে চড়া দামে ১০ কোটি টাকার বই ও আসবাব কিনেছে সাতক্ষীরা মেডিকেল।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয় এবং সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) প্রতিবেদন এবং দেশে মেডিকেলের বই সরবরাহকারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে এ অনিয়ম-দুর্নীতির খোঁজ পাওয়া গেছে।
দুই মেডিকেল কলেজে বই কেনায় অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি স্বাস্থ্যসচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ১১ মে তিনি নিজ কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়ে জানি। অনিয়ম দূর করার চেষ্টা করছি।’
দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ এখন ২৯টি। এর মধ্যে ২০০৮ সালে নোয়াখালীতে আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ এবং ২০১১ সালে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। নোয়াখালী মেডিকেলে পাঁচটি ব্যাচে ২৫০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন। আর সাতক্ষীরা মেডিকেলে চারটি ব্যাচে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২০০।
এক ব্যক্তির পাঁচ প্রতিষ্ঠান: দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে বই সরবরাহের ব্যবসা করেন মো. মাহবুবুল ইসলাম। তিনি সৌরভ পাবলিশার্স ও ডিস্ট্রিবিউটরসের মালিক। তাঁর স্ত্রী আফসানা ইসলামের রয়েছে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান-অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল ও নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ। মাহবুবুলের শ্যালক হাসান পারভেজ আরও দুটি প্রতিষ্ঠান-সৌরভ বুক সেন্টার ও রেনু এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী। পারিবারিক এ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে বই সরবরাহের দরপত্রে অংশ নেন এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে কার্যাদেশ পান। তবে এর মধ্যে নোয়াখালী ও সাতক্ষীরা মেডিকেলে দুর্নীতির খোঁজ পেয়েছে প্রথম আলো।
মাহবুবুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁর শ্যালক পৃথকভাবে ব্যবসা করেন। আর যোগ্য প্রতিষ্ঠান বলেই তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন অরবিটাল কাজ পায়। তবে সিপিটিইউ ও নিরীক্ষা কার্যালয় বলেছে, নামে আলাদা হলেও তাঁরা সবাই একসঙ্গে বসে দরপত্রের মূল্য নির্ধারণ করে জমা দেন। কয়েক গুণ বেশি দাম রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, সব বই প্রকাশকের মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে, দাম বেশি রাখা হয়নি।
দুই থেকে ১৫০ গুণ দামে বই: গত বছরের ৫ আগস্ট বই ও সাময়িকী সরবরাহের জন্য দরপত্র ডাকেন নোয়াখালী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আবদুস ছালাম। মাহবুবুলের স্ত্রীর অরবিটাল ও নির্ঝরা এবং শ্যালকের সৌরভ বুকসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ হওয়ার পরও কলেজ অধ্যক্ষ সরকারি ক্রয়বিধি (পিপিআর) লঙ্ঘন করে নিজেকে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রধান হিসেবে রাখেন। মূল্যায়ন কমিটি অরবিটাল ও সৌরভকে যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে, সর্বনিম্ন দরদাতা হয় অরবিটাল। ২৩ সেপ্টেম্বর ছয় কোটি টাকার বই ও সাময়িকী সরবরাহের জন্য অরবিটালকে চারটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়। মাত্র চার দিনের মাথায় ২৭ সেপ্টেম্বর চারটি চালানের মাধ্যমে এসব বই সরবরাহ করে অরবিটাল।
অরবিটালের কার্যাদেশগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৩ হাজার ৭৪৫ ধরনের (আইটেম) বইয়ের দর প্রচলিত বাজারমূল্য থেকে সর্বনিম্ন দ্বিগুণ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ গুণ বেশি রাখা হয়েছে। যেমন এলসেভিয়ার প্রকাশিত মাসল বায়োপসি: অ্যা প্র্যাকটিকাল অ্যাপ্রোচ বইয়ের চতুর্থ সংস্করণের দাম দেশের বাজারে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা হলেও অরবিটাল রেখেছে ৭৯ হাজার ৫০০ টাকা। একই প্রকাশনা সংস্থার প্র্যাকটিক্যাল ইকোকার্ডিওগ্রাফি অব কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ বইয়ের দাম ২ হাজার ২০০ টাকা হলেও অরবিটাল রেখেছে ৩৫ হাজার ৭০০ টাকা।
অরবিটালের সরবরাহ করা বেশির ভাগ বিদেশি বই অ্যামাজন ডট কমে পাওয়া যায়। ওয়ান স্টপ ডক সিরিজের আরেকটি বই গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল সিস্টেম ভারতে ৪৬৬ রুপিতে (৫৬৫ টাকা) বিক্রি করছে অ্যামাজন। এই বইটিও অরবিটাল বিক্রি করেছে সাড়ে ৮৮ হাজার টাকায়। এ ছাড়া ১৫ হাজার টাকার বই প্রায় ৯৯ হাজার টাকায়, সাড়ে ৬ হাজার টাকার বই সাড়ে ৯২ হাজার টাকায়, ৬ হাজার টাকার বই সাড়ে ৮৫ হাজার টাকায় কিনেছে নোয়াখালী মেডিকেল। দরপত্রে সব ধরনের বই এক কপি করে কেনার কথা বলা হলেও কমপক্ষে ৩০ ধরনের বই শতাধিক কপির ওপর কিনেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
নোয়াখালী মেডিকেলে আরেক দরদাতা পরমা পাবলিশার্সের দরপত্র মূল্যায়ন করে দেখা যায়, যে বই কেনার জন্য অরবিটাল প্রায় ছয় কোটি টাকা নিয়েছে, একই সংখ্যক বইয়ের জন্য পরমার দর ছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা।
জানতে চাইলে অধ্যক্ষ আবদুস ছালাম প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্রের শর্ত পূরণ করতে না পারায় পরমা পাবলিশার্স অযোগ্য প্রতিষ্ঠান বিবেচিত হয়। যোগ্য প্রতিষ্ঠান দুটি একই ব্যক্তির কি না, সেটা কলেজের দেখার বিষয় নয়।
তবে সিপিটিইউ ও নিরীক্ষা কার্যালয় বলছে, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য দরপত্রে অদ্ভুত কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি শর্ত ছিল যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে তিন বছরে দুই কোটি টাকার মেডিকেলের বই সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এটি পূরণ করতে না পারায় পরমাকে অযোগ্য প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করা হয়। অথচ দরপত্রে শুধু ‘বই ও সাময়িকী’ সরবরাহের জন্য ডাকা হয়েছিল, আর শর্তের জায়গায় ‘মেডিকেল বই’ কথাটি জুড়ে দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কলেজ কর্তৃপক্ষের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রথমে সিপিটিইউয়ে আপিল করে পরমা পাবলিশার্স। গত বছরের ২১ অক্টোবর সিপিটিইউয়ের রিভিউ প্যানেলের রায়ে বলা হয়, নোয়াখালী মেডিকেলের পুরো দরপত্র কার্যক্রম বেআইনি। তারা এ দরপত্র বাতিল করে আবার দরপত্র ডাকার সুপারিশ করে। সিপিটিইউয়ের এই রায় মানেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ।
এরপর পরমা পাবলিশার্স সিএজি কার্যালয়ে অভিযোগ করলে স্থানীয় ও রাজস্ব নিরীক্ষা অধিদপ্তর বিষয়টি যাচাই করে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর দেওয়া নিরীক্ষা অধিদপ্তরের যাচাই প্রতিবেদনে নোয়াখালী মেডিকেলে বই কেনায় পুরো দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, অরবিটাল ও সৌরভ একসঙ্গে বসে যোগসাজশে বইয়ের দর নির্ধারণ করেছে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি পক্ষপাতিত্ব করেছে এবং বইপত্র গ্রহণ কমিটি বইয়ের প্যাকেট না খুলেই প্রত্যয়ন করেছে যে সব বই ঠিকভাবে পাওয়া গেছে। অথচ নিরীক্ষা বিভাগ গত বছরের ডিসেম্বরে নোয়াখালী মেডিকেলে গিয়ে দেখে, এসব বই এখনো প্যাকেটবন্দী অবস্থায় চারটি কক্ষে পড়ে আছে।
তবে সিপিটিইউ ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে একমত নন অধ্যক্ষ আবদুস ছালাম। তিনি দাবি করেন, সরকারি কেনাকাটার সব ধরনের আইন ও বিধি মেনে দরপত্র কার্যক্রম চালানো হয়েছে।
পরমা পাবলিশার্সের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এরপর নোয়াখালীতে বই কেনায় দুর্নীতি তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি এই কমিটি প্রতিবেদন দেয়। এ প্রতিবেদন অনুসারে, নোয়াখালী মেডিকেলে বই কেনায় কমপক্ষে ছয়বার ক্রয়বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। এ ছাড়া বইয়ের বাজারদর যাচাই ঠিক হয়নি। অথচ এ প্রতিবেদনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়নি।
প্রতিযোগিতাই হয়নি সাতক্ষীরায়: গত ৩১ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য জনসংখ্য ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন প্রকল্পের (এইচপিএনএসডিপি) ২০১৩-১৪ অর্থবছরের নিরীক্ষা শেষ করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে সিএজির বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ফাপাড)। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, অর্থবছরের বিভিন্ন সময়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে বই ও আসবাব সরবরাহের দরপত্রে মাহবুবুল ইসলামের চারটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আরও কেউ অংশ নেয়নি। পৃথক পৃথক দরপত্রে অরবিটাল ও সৌরভ মিলে প্রায় ১০ কোটি টাকার বই ও আসবাব সরবরাহ করে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার নামে এখানে প্রতিষ্ঠানগুলো যোগসাজশ করে দরপত্র দিয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ চাইলে এ দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র ডাকতে পারত। কিন্তু তারা ক্রয়বিধি লঙ্ঘন করে চড়া দাম দিয়ে বই ও আসবাব কিনেছে। এর মধ্যে অনেক আসবাব অপ্রয়োজনে কেনা হয়েছে।
এই কেনাকাটার সময় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক এস জেড আতিক। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি অবসর-পূর্ব প্রস্তুতি ছুটিতে যান। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরপত্রে অংশ নেওয়া চারটি প্রতিষ্ঠান যে একই ব্যক্তির, তা আমরা বুঝতে পারিনি। এটা ভুল হয়ে গেছে।’ তবে আসবাব অপ্রয়োজনে কেনা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কলেজের বিভিন্ন আবাসিক ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এগুলো সেসব ভবনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তবে নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলছে, প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা খরচ করে ৫০টি ইলেকট্রিক কেয়ার বেড কেনা হয়েছে। অথচ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নির্মাণই শুরু হয়নি। মেডিকেল কলেজের নিজস্ব ভবন নেই, অথচ প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা খরচ করে কলেজের জন্য বিপুলসংখ্যক আসবাব কেনা অর্থহীন। ২০০ শিক্ষার্থী আর প্রায় ৩০ শিক্ষক-কর্মকর্তার এই মেডিকেল কলেজের জন্য ১০টি সোফা সেট, ৬০টি স্টিলের আলমারি, ৫০টি স্টিলের ফাইল ক্যাবিনেট, ১০০টি স্টিলের র্যাক, ২১৯টি চেয়ার, ১৯১টি টুল কেনা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:১০:৩৪ ৪০৩ বার পঠিত