মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ ২০১৫

সওয়াব হবে তাই খুন করেছি

Home Page » প্রথমপাতা » সওয়াব হবে তাই খুন করেছি
মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ ২০১৫



3.jpgবঙ্গনিউজ ডটকমঃ দুপুর তখন ১টা, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা হাজতের ভেতর পায়চারি করছিল দুই যুবক। গায়ে গেঞ্জি, পরনে জিন্সের প্যান্ট। দুজনের মুখেই দাড়ি। একজনের নাম জিকরুল্লাহ, আরেকজন আরিফুল ইসলাম। সকালে (গতকাল সোমবার) এরাই তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ী এলাকায় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। স্থানীয় লোকজন ধরে তাদের পুলিশে দিয়েছে। পুলিশ এনে রেখেছে থানা-হাজতে।

হাজতের বাইরে থেকে খুনের কারণ জানতে চাইলে দুজনই বলল, ‘ওকে (ওয়াশিকুর) খুন করেছি, কারণ সওয়াব হবে, বেহেশত নিশ্চিত। ও নাস্তিক, ফেসবুক-ব্লগে আল্লাহ ও রাসুল নিয়ে কটূক্তি করেছে। ফেসবুকে ওর লেখা প্রথমে আমাদের বড় ভাই মাসুমের চোখে পড়ে। তিনি ওই লেখা আমাদেরও দেখান। এরপর হুজুরের (মাসুম) নির্দেশে ওকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিই। তাকে হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন করতেই খুন করেছি।’ কথাগুলো বলার সময় কারো চেহারাতেই ভয় বা আতঙ্কের কোনো ছাপ ছিল না।

দুজনের কথা শুনে পাশে থাকা একজন পুলিশ সদস্য মন্তব্য করেন, ‘দেখছেন, কে বলবে কিছুক্ষণ আগে এরা সমবয়সী এক যুবককে নৃশংসভাবে খুন করেছে। সকালে প্রকাশ্যে ব্যস্ত একটি গলিতে ঢুকে কোনো ধরনের বাছবিচার ছাড়াই গলা থেকে পুরো মুখমণ্ডল কুপিয়ে ফালা ফালা করে ফেলেছে। কোনো কিছু তোয়াক্কা করেনি তারা। এমনকি দৌড়ে পুলিশের সামনে দিয়ে পালানোর সময়ও ভয় পায়নি তারা। রফিক হোসেন নামের স্থানীয় এক যুবক ধর ধর বলে চিৎকার করে তাদের পিছু নিয়ে দৌড়াতে থাকে। এ সময় জিকরুল্লাহ, আরিফুল ও তাদের আরেক সঙ্গী তাহেরও লোকজনকে ধোঁকা দিতে ডাকাত, ডাকাত বলে চিৎকার করতে থাকে। একপর্যায়ে তাহের পালিয়ে গেলেও জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে ধরে ফেলে দুই হিজড়া। ততক্ষণে রফিকসহ স্থানীয় আরো লোকজন সেখানে পৌঁছে যায়। কিছুক্ষণ পর পুলিশ গিয়ে দুজনকে আটক করে থানায় আনে। জিকরুল্লাহ ও আরিফুল আরো জানায়, বড় ভাই মাসুমের নির্দেশে হত্যার জন্য আগে থেকেই তারা ওয়াশিকুরকে অনুসরণ করছিল। গত শনি ও রবিবারও তারা দক্ষিণ বেগুনবাড়ীতে ওয়াশিকুরের বাসার সামনে গিয়ে তাঁকে হত্যার জন্য অপেক্ষা করে। তবে সুযোগ না পেয়ে তারা চলে যায়। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা থেকেই তারা ওই বাসার আশপাশের গলিতে অপেক্ষায় ছিল। সাড়ে ৯টার দিকে ওয়াশিকুর বাসা থেকে বের হয়ে সামনের দিকে এগোনোর সময় প্রথমে কোপ দেয় জিকরুল্লাহ। এরপর তাহের বেপরোয়াভাবে মাথা ও মুখমণ্ডলে কোপাতে থাকে। ওয়াশিকুরকে হত্যার আগে তাদের দলনেতা মাসুমের সঙ্গে তাদের ঢাকায় কয়েকদফা বৈঠক হয়। ‘প্রটেক্ট’ নামে একটি আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলে ফেসবুকে তারা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করত।

‘মাসুম’ কে- এমন প্রশ্নের জবাবে দুজনই জানায়, তাকে শুধু চেহারায় চিনি। বিস্তারিত পরিচয় কিছু জানি না।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল দাবি করেছে, তারা একে অন্যকে আগে থেকে চিনত না। মাসুম (হুজুর) নামের একজনের কথা শুনে তারা এ হত্যা মিশনে নামে। ওয়াশিকুরকে হত্যার পরিকল্পনা করতে তাহেরসহ তারা চারজন প্রথমবারের মতো গত রবিবার বিকেলে হাতিরঝিলে মিলিত হয়। পরিকল্পনা শেষে মাসুম সবাইকে ওয়াশিকুরের ছবি দিয়ে তাঁর বাসা চিনিয়ে দেয়। হত্যাকাণ্ডের মূল মিশনে অংশ নেয় তাহের। তাকে সহযোগিতার জন্য সঙ্গে যায় জিকরুল্লাহ ও আরিফুল।

গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, সিআইডি ঘটনাস্থল ও থানায় গিয়ে ওই দুই যুবক সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে। পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া প্রত্যেকের কাছেই একটি করে চাপাতি ছিল। এর মধ্যে দুটি চাপাতি তারা হত্যার সময় ব্যবহার করে।

তেজগাঁও থানার ওসি সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে যে ইসলাম ধর্ম নিয়ে ব্লগসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘অপপ্রচারের দায়ে’ তারা ওয়াশিকুরকে কুপিয়ে হত্যা করেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে লেখালেখির কারণে বিরোধ থেকে ওয়াশিকুরকে হত্যার কথা গ্রেপ্তার দুজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। তারা কোনো সংগঠন বা দলের কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আবু তাহের নামের আরেকজনও হত্যার ঘটনায় অংশ নেয়। সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। তাকে আটকের চেষ্টা চলছে।’

গতকাল বিকেল ৩টার দিকে আটক দুজনকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য : স্থানীয় রফিক হোসেন দাবি করেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তিনি স্থানীয় চান মিয়ার দোকানে বসে নাশতা খাচ্ছিলেন। এর মধ্যে জোমেলা নামের স্থানীয় এক নারী চিৎকার দিয়ে বলতে থাকেন, ‘পোলাডারে মাইরা ফালাইলো, ওরে বাঁচাও।’ রফিক বলেন, ‘খাওয়া ফেলে আমি হোটেল থেকে বের হয়েই দেখতে পাই এক যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। গলি দিয়ে তিনজনকে দৌড়াতে দেখি। দোকানে বসা অন্যদের যুবকটিকে দেখতে বলে ওই তিনজনকে ধরতে দৌড় দিই। আর চিৎকার করে বলতে থাকি, ওদের ধরো, ওরা ডাকাত, খুন করে পালাচ্ছে। দৌড়ানোর সময় রাস্তার পাশে একটি পুলিশের গাড়ি দেখি। কিন্তু তারা প্রথমে আমার চিৎকারে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। আমি দৌড়ানোর সময় পুলিশকে বলি, ওদের ধরেন, ওরা একজনকে খুন করে পালাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত উত্তরা মোটর্সের সামনে গিয়ে বিপরীত দিক দিয়ে আসা দুজন (হিজড়া) আমার চিৎকার শুনে ওদের জাপটে ধরে। এ সময় রাস্তায় জ্যাম ছিল, এই ফাঁকে তিনজনের মধ্যে একজন রাস্তা পার হয়ে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে পুলিশের গাড়িও চলে আসে। ওই দুজনকে ধরে গাড়িতে ওঠায়। দুই যুবকের মধ্যে একজনের ব্যাগে তখনো চাপাতি ছিল। সে আমাকে হুমকি দিয়ে বলে- তোর খবর আছে, তোরে বাঁচতে দেবে না আমাদের লোক।’

স্থানীয়রা দাবি করে, আহত অবস্থায় প্রায় এক ঘণ্টা ঘটনাস্থলেই পড়ে ছিলেন ওয়াশিকুর। এরপর পুলিশের গাড়ি আসে। কিন্তু তখনো তাঁকে গাড়িতে তুলতে গড়িমসি করে পুলিশ। একপর্যায়ে স্থানীয়রা নিথর অবস্থায় ওয়াশিকুরকে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে।

পুলিশ আসতে দেরি করলেও স্থানীয়রা কেন ওয়াশিকুরকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেল না- এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীরা জানায়, ঘটনার পরপরই আতঙ্কে লোকজন দোকানপাট বন্ধ করে ছোটাছুটি করতে থাকে। রাস্তায় পড়ে থাকলেও ভয়ে কেউ ওয়াশিকুরের কাছে যায়নি। এ হত্যাকাণ্ডের পর দক্ষিণ বেগুনবাড়ী এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:০১:১৭   ৩৭৯ বার পঠিত