রবিবার, ২৯ মার্চ ২০১৫
ইয়েমেনে অতল গহ্বরে সৌদি আরব
Home Page » বিশ্ব » ইয়েমেনে অতল গহ্বরে সৌদি আরববঙ্গনিউজ ডটকম: সৌদি আরব অতল গহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ইয়েমেনের ওপর তাদের বিমান হামলা চালানোর ঘটনাটি ঐতিহাসিক। তবে একই সঙ্গে এ পদক্ষেপ সৌদি রাজপরিবারের জন্য ভয়ের কারণ হয়েও দেখা দিতে পারে।
কে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আরব বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে এই যুদ্ধ হতে হবে? সৌদি আরবের বাদশাহ, যাকে নিয়ে কানাঘুষা আছে যে তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ। নাকি সৌদি প্রিন্সরা? যারা এই নিয়ে ভীত যে, নিজেদের নিরাপত্তা বাহিনী রাজবংশের সমর্থন করবে না!
ইয়েমেনের গল্প বেশ সরল। সৌদি আরবের দাবি, ইরানের সহায়তায় শিয়া মুসলমান হুথি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করেছে। দেশটির বৈধ প্রেসিডেন্ট আবদ রাব্বু মনসুর আল হাদি তার শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত প্রাচীন রাজধানী এডেন থেকে সৌদির রাজধানী রিয়াদে পালিয়ে গেছেন।
সৌদি আরব কখনোই চায় না তাদের সীমান্ত ঘেঁষে ইরানের মতাদর্শী একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠুক। তবে এ ক্ষেত্রে তারা সব সময়ই ভুলে যায়, ২০০৩ সালে ইঙ্গ-মার্কিন বদান্যতায় এরই মধ্যে তাদের সীমান্তঘেঁষা ইরানের মতাদর্শী একটি রাষ্ট্র হয়েছে-যার নাম ইরাক।
মূল গল্পটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো বা সৌদি সেনাবাহিনীর অর্ধেক সেনাই ইয়েমেনের বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী থেকে এসেছেন। পারিবারিকভাবে সৌদি সেনারা খুবই ঘনিষ্ঠভাবে ইয়েমেনের সঙ্গে যুক্ত এবং ইয়েমেনের বিপ্লব সৌদি রাজপরিবারের জন্য বড় একটি আঘাত।
সৌদি বাদশাহ সালমানকে দেশ চালাতে হলে অবশ্যই এই সংকটের অবসান ঘটাতে হবে।
কিন্তু সানায় সৌদি বোমা হামলা কি শিয়া মুসলমানদের বিপ্লব বন্ধ রুখতে পারবে?
রিয়াদের কাছে ব্যাপারটি কেমন তা আপনারাই বুঝতে পারবেন। উত্তরে শিয়া-নেতৃত্বাধীন ইরাকি সরকারকে সহায়তা করছে শিয়া মুসলিম ইরানিয়ান রেভ্যুলশনারি গার্ড, যেখানে প্রতিপক্ষ সুন্নি মুসলমান সংগঠন আইএস। উত্তর-পশ্চিমে আলাউইত (পড়ুন শিয়া) প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদকে সহায়তা করছে ইরানিয়ান রেভ্যুলশনারি গার্ড, যেখানে প্রতিপক্ষ আইসিস, আল-নুসরা আর ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ নামে বাকি সবাই।
আসাদের বাহিনীর পাশে আরো আছে লেবাননের শিয়া হিজবুল্লাহ। এ ছাড়া আফগানিস্তান থেকে আসা শিয়া মুসলমানরাও সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর পোশাকে যুদ্ধ করছে। সৌদি আরবের দাবি, ইয়েমেনের হুথিদের সহায়তা করছে ইরান। যদি তা ঠিক না হয়েও থাকে, তারপরও ইরানের অস্ত্র আছে ইয়েমেনে।
এরই মধ্যে ইয়েমেনের যুদ্ধ আরব দেশগুলোকে বিভক্ত করেছে। লেবাননের সাবেক সুন্নি প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি সৌদি আরবের হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এটি বাদশাহ সালমানের সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত। হারিরি শুধুমাত্র সুন্নিই নন, তিনি একই সঙ্গে সৌদি আরবের নাগরিক।
কিন্তু ইয়েমেনে সৌদি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছে লেবাননের শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহ। তাদের মতে, এটি সৌদি আরবের ‘বেহিসেবি অভিযান’। সৌদি আরবের সমালোচনায় তারা বেশ সতর্কতার সঙ্গেই শব্দ বেছে নিয়েছে। ঠিক এই শব্দগুলোই ২০০৬ সালে সৌদি আরব হিজবুল্লাহর প্রতি ব্যবহার করেছিল।
ওই সময় হিজবুল্লাহ তিন ইসরাইলি সেনাকে আটক করে। এর জবাবে ওই বছরের শেষদিকে লেবাননে বোমা হামলা চালায় ইসরাইল।
যুক্তরাষ্ট্র জানে না পরবর্তীকালে কী করতে হবে। সৌদি আরবকে তারা সরাসরি সামরিক সহায়তা দিতে পারে না। একই সঙ্গে ইরানের সঙ্গে পরমাণু আলোচনাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাদশাহ সালমানকে যুক্তরাষ্ট্রের মৌখিক সমর্থনের মানে হলো, তাদের সুন্নি সহযোগী রাষ্ট্রগুলোকে শান্ত রাখা আর একই সঙ্গে ইরানের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাকের মধ্যে চুক্তির যতই সম্ভাবনা দেখা দেবে, ততই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সহযোগীরা এটি নস্যাতে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করবে। তাই বলা চলে, ইয়েমেনের সৌদি আরবের অন্যরকম অভিযান আসলে এডেনের হুথিদের বিরুদ্ধে নয় বরং এর লক্ষ্যবস্তু যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যেকার লওসেন সমঝোতা চুক্তি।
হিজবুল্লাহ সৌদি হামলাকে ‘সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র ষড়যন্ত্র’ বলতে পারে-কিছুটা সময় চিন্তা করলে মনে হতে পারে এর কিছুটা অন্তত সত্য। কিন্তু বিষয়টি আরবদের কাছে দৃশ্যমান হবে এভাবে- যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সৌদিরা উত্তরের মহাশত্রুকে (ইসরাইল) বাদ দিয়ে আরেক আরব জাতির ওপর হামলে পড়েছে। সৌদি হামলা শুনলেই অনেকের মনে হতে পারে, এটি হয়তো ইসরাইলের ওপর হামলা।
ইতিহাস হয়তো বলবে, ইয়েমেনের ওপর হামলা মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি ও শিয়াদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। আরবরা বিশ্বাস করে নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ হলে, তা পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরাইলকে সন্তুষ্ট করবে। তবে এটিও সত্য যে, এই অঞ্চলের নিজেদের শক্তিশালী সামরিক শক্তি প্রমাণ করায় সৌদিদের এটিই শেষ সুযোগ।
১৯৯০ সালে সাদ্দামের কুয়েত আক্রমণের সময় তারা বিধর্মী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিজেদের রক্ষায় সহায়তা চেয়েছিল (যা ছিল ওসামা বিন লাদেনের রাগের কারণ)। তারা ওহাবি জাতি- কার্যকরভাবেই তালিবান ও আইসিসের মতাদর্শে তারাও বিশ্বাসী।
৯/১১ হামলার ১৫ থেকে ১৯ জনই ছিল সৌদি নাগরিক। ভুললে চলবে না তারা দিয়েছে বিন লাদেন, যিনি ছিলেন ইয়েমেনি উপজাতি গোষ্ঠীর।
১৯৯০ সালে কুয়েতে সাদ্দামের আগ্রাসনকে সমর্থন দিয়েছিল ইয়েমেন। অকৃতজ্ঞতার জবাবে ১০ হাজার ইয়েমেনিকে দেশ থেকে বের করে দেয় সৌদি আরব। এখন কি সৌদি আরব আশা করে, ইয়েমেনিরা তাদের সমর্থনে র্যা লি করবে?
সর্বশেষ ইয়েমেনে সৌদিরা যুদ্ধ করেছে মিশরের জামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। যুদ্ধটি ছিল বিপর্যয়কর। এই মহূর্তে মিশরকে পাশে পেয়েছে সৌদিরা।
এমনকি ইয়েমেনে সেনা মোতায়েনেও মিশরকে অনুরোধ করেছে তারা। কিন্তু কী প্রয়োজনে? ইয়েমেনকে আজ্ঞাবহ সুন্নিরাষ্ট্র হিসেবে রাখতে? এতে কি সিনাইয়ের সুন্নি বিদ্রোহীদের কার্যক্রম বন্ধ রাখবে বলে নিশ্চয়তা পেতে পারে মিশর?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইয়েমেনে হামলা কি সৌদি রাজপরিবারে আসন্ন সংঘাত সমাধান করতে পারবে?-যেখানে অনেক প্রিন্স মনে করেন, ইয়েমেন সৌদি শক্তির ভিত্তিপ্রস্তর নয় এবং একই সঙ্গে যারা ওহাবিজমকে স্থায়ী বিশ্বাস বলে মনে করে না। ইয়েমেনের সংকট থেকে কে লাভবান হবে? অবশ্যই তেল উৎপাদকরা, এর মানে হলো সৌদি আরব ও ইরান।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৪০:৫০ ৪০৮ বার পঠিত