সোমবার, ২৩ মার্চ ২০১৫
চোখের সামনে দেখেছি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিতে
Home Page » সারাদেশ » চোখের সামনে দেখেছি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিতেবঙ্গনিউজ ডটকমঃভালো উপার্জনের আশায় ভাগ্যান্বেষী সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত দরিদ্র মানুষ ও কর্মহীন তরুণরা সমুদ্রপথে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়াতে।
পথিমধ্যে দালাল ও আর ওইসব এলাকার ‘প্রশাসনের আনুকূল্য’ ঠিকঠাক থাকলে ১৫দিনের মধ্যেই পৌছানো যায় মালয়েশিয়াতে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলেই মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। ছোট রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয়।
তাছাড়া যখন তখন এসব মানুষকে বেঁধে রেখে চালানো হয় নানা অত্যাচার। প্রতিবাদ করতে গেলে হারাতে হয় প্রাণ। অনেকেই পাচারকারীদের হাতে খুনও হয়েছেন প্রকাশ্যে। কাউকে কাউকে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। ঠিকমত খাবার না পেয়ে অনেকেই আত্মহত্যার মত পথ বেছে নেয়।
তবুও প্রত্যাশা, মালয়েশিয়াতে গিয়ে ভালো উপার্জন করে ঋণ শোধ করে পরিবারের লোকজনদের মুখে হাসি ফোটানো যাবে।
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে সুবাং এলাকার সুবাং-সুরিয়া এলাকাতে একটি ঘরে বসবাস করেন ১৮ জন বাংলাদেশি। এদের মধ্যে ৪জন এসেছিল সমুদ্রপথে।
ওই চারজন হলেন, যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার শার্শা এলাকার ইমরান খান, একই থানার কুসুমপুর গ্রামের জসিমউদ্দিন, কাশীপুর গ্রামের ফারুক ও তার চাচা বেলাল মিয়া।
৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় যখন তাদের রুমে গিয়ে হাজির হলাম তখন সবাই ছিল রাতের রান্না নিয়ে ব্যস্ত। রুমে থাকা অন্য ১৪ জনের তুলনায় এ চারজনের দৈহিক গঠন খুবই নড়বড়ে আর রোগরোগা। চেহারাতেও ছিল ভাঙাচোরা ভাব। প্রশ্ন করতেই এ চারজনের ‘চাচা’ হিসেবে পরিচিত বেলাল মিয়া বলেন, ‘ভাইরে বেঁচে আছি এটাই যথেষ্ট। ৭ মাসেও শরীর আগের মত হয়নি।’
পরে চারজনের সঙ্গে আলোচনা হয় মালয়েশিয়া আসার পেছনের কাহিনী নিয়ে। তাদের চোখের কোণে চিকচিক করছে কষ্টের নোনা জল। একেকজন বলতে থাকেন তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ও তিক্ত অভিজ্ঞতা আর অমানবিকতার বাস্তবিক গল্প।
বেলাল মিয়ার বয়স ৪৫। যশোরের ঝিকরগাছা থানার কাশীরপুর গ্রামে ফলের দোকান ছিল। একই এলাকার একজন দালাল তাকে মালয়েশিয়া আসার প্রলোভন দেখায়। বলে, ‘সেখানে বেতন পাওয়া যাবে লাখ টাকার উপরে।’
ফলবিক্রেতা বেলাল সেই আশাতেই ঘুম হারাম করে মালয়েশিয়া যাবার স্বপ্ন বুনতে থাকে। বিক্রি কয়ে দেয় নিজের পৈতৃক সম্পত্তি। স্ত্রীর কাছে দিয়ে রাখে দালালের সঙ্গে চুক্তি করা ২লাখ ২৫ হাজার টাকা। সঠিক তারিখ বলতে না পারলেও জানান, ৭-৮মাস আগে তিনি সহ তাদের থানার আরো ৭জন মিলে দালালের সঙ্গে বাসে চেপে চলে যান চট্রগ্রাম। সেখান থেকে আবারো বসে করে কক্সবাজার। সেখানে তাদেরকে একটি ট্রলারে ওঠানো হয়। রাত পার হয়ে সকালে ট্রলারটি গভীর সমুদ্রে একটি জাহাজের সামনে গিয়ে ভেড়ে।ওই জাহাজে ট্রলার থেকে সব লোকজনকে উঠিয়ে দেয়। একে একে আরো কয়েক ঘণ্টায় তিনটি ট্রলার আসে। প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে গাদাগাদি করে জাহাজে ওঠানো হয়। জাহাজটিতে তখন আর কোনো বাংলাদেশি ছিল না। সবাই ছিল বার্মা ও থাইল্যান্ডের লোকজন। তাদের ভাষা বোঝা যেত না। দুদিন জাহাজটি সমুদ্রে থাকার পর তৃতীয় দিন ছেড়ে যায়। আরো তিনরাত চলার পর জাহাজটি থাইল্যান্ডের একটি জঙ্গলের পাশের তীরে গিয়ে নোঙ্গর করে। কিন্তু এরই মধ্যে দালালরা নানা অজুহাতে জাহাজে থাকা লোকজনদের উপর চালায় অমানবিক নির্যাতন।
জাহাজের নির্যাতন প্রসঙ্গে বেলাল বলেন, ‘জাহাজে আমরা কেউ ঘুমাতে পারি নাই। পুরোটা সময় শুধু বসে থাকতে হয়েছে। একটা মানুষের পক্ষে ৬-৭দিন বসে থাকাটা কী করে সম্ভব? সে যে কী কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। কেউ দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেই তার উপর শুরু হতো বেধড়ক মারধর।’
বেলালের সঙ্গে থাকা তার ভাতিজা ফারুক বলেন, ‘সকাল আর দুপুরে যে খাবার দেওয়া হতো সেটা খাওয়া যেত না। প্রতিবাদ করলে প্লাস্টিকের বড় রাবার দিয়ে এমন পেটানো হতো যে একটি আঘাতেই মনে হতে মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। তবুও সেসব কষ্ট সহ্য করেছি।’
হঠাৎ করেই ফারুকের চোখ ভিজে ওঠে কান্নায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার সামনে একজন যুবককে মারধর করে সমুদ্র ফেলে দেওয়া হয়। সে-দৃশ্য মনে হলে ভয়ে আতঙ্কে এখনো আমি আঁতকে উঠি। সেই দৃশ্য দেখার পর আমরা কেউ আর কোনো কথা বলতাম না। নীরবে সব সহ্য করেছি।’
জঙ্গলের পাশে জাহাজ নোঙ্গর করার পর সেখানেই তিনদিন আটকে রাখা হলো। ৫০ ফুটের মত ব্যাসার্ধের ওই স্থানে চারদিক ছিল জাল দিয়ে বেষ্টিত। কেউ এর বাইরে যাওয়া যেত না। সেইখানে চলতো বাথরুমের কাজ। দুপুরে এক প্লেট ভাত আর ছোট এক টুকরো ঢেড়স দেওয়া হতো। পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামা ছড়া ও নালার পানি পান করতে হতো।
চারজনের মধ্যে একজন ইমরান খান দেশে থাকতে এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করতো। আলোচনার মধ্যে হঠাৎই সে বলে উঠলো, এসব খাবার না পেয়ে আমি প্রতিবাদ করতেই কোমরে জোরে লাঠি দিয়ে পেটানো হয় আমাকে। জানালেন, এখনো সে কারণে ঠিকমত কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না সে।
চারজনের সঙ্গে থাকা জসিমউদ্দিন জানান, জঙ্গলে টানা ১২দিন থাকার পর খাবার শেষ হয়ে যায়। পরে শুধু আমাদের চাল কুমড়া সিদ্ধ করে দেওয়া হতো। জঙ্গলে আমাদের সঙ্গে ছিল ৮০ জনের মত। ট্রলারে থাকা বাকিদের নেওয়া হয় অন্য জঙ্গলে।
হঠাৎ একদিন ভোরে পুলিশ জঙ্গলে রেড দেওয়ায় জসিম, বেলাল, ফারুক ও ইমরান সহ তাদের ৮০জনের দলকে নেওয়া হয় অন্য পাহাড়ে। সেখানেও দুইদিন আটকে রাখা হয়। চালানো হয় নির্যাতন। পরে টানা তিনদিন তাদেরকে হাঁটিয়ে নেওয়া হয় আরো এক জঙ্গলে। হাঁটতে হাঁটতে একেকজনের পায়ে ফোসকা পড়ে গেলেও দালালরা সেদিকে খেয়াল করেনি। বরং কেউ একটু আস্তে হাটলেই তারে পিঠে দেওয়া প্রচণ্ড লাঠির বাড়ি। ৬দিন পর একটি প্রাইভেট কারে ওঠানো হয় ১৫জনকে।
‘কতো আসনের প্রাইভেটকার?’– প্রশ্ন করতেই ফারুক বললেন, ‘প্রাইভেটকারের পেছনের ডালার ভেতরে আমাদের লাথি মেরে ৫জনকে ঢুকানো হলো। পেছনের দুই সিটে বসলাম ৪জন করে। সামনে ড্রাইভারের সিটের পাশে আমি আর আমার উপর বসলো আরো একজন। ৫-৬ঘণ্টা গাড়ি চলার পর নামিয়ে দেওয়া হয় মালয়েশিয়ার ‘আলোরসেটার’ নামের একটি জায়গাতে। সেখানে একটি রুমে আটকে রাখার পর টাকার জন্য বাড়িতে ফোনকল দিতে বলে দালালচক্র। বাংলাদেশে এসব দাললের যেসব এজেন্ট রয়েছে পরিবারের লোকেরা এই এজেন্টের হাতে টাকা পৌঁছে দেবার পরেই ছেড়ে দেওয়া হয় সমুদ্রপথে আসা লোকজনকে।’
বাংলাদেশ সময়: ১১:৫৫:০১ ২৬৪ বার পঠিত