রবিবার, ২২ মার্চ ২০১৫

রপ্তানিতে নতুন আশা সাইকেল

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » রপ্তানিতে নতুন আশা সাইকেল
রবিবার, ২২ মার্চ ২০১৫



mmmm.jpgবঙ্গনিউজ ডটকমঃএক দশক আগেও চাহিদা মেটাতে আমদানি করতে হলেও সেই চিত্র বদলে এখন ইউরোপের বাজারে সাইকেল রপ্তানিতে শীর্ষ পাঁচটি দেশের একটি বাংলাদেশ।

পরিবেশবান্ধব বলে ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে সাইকেল জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় দুই চাকার এই বাহন রপ্তানি আশা দেখাচ্ছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের।

অর্থনৈতিক মন্দা পুরোপুরি কেটে গেলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের সাইকেল রপ্তানি আরও বাড়বে বলে আশায় আছেন তারা।

চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা (১২ কোটি ১৫ লাখ ডলার) আসবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার।

এর মধ্যে আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৮ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের (প্রায় ৭০০ কোটি টাকা) সাইকেল, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে বাইসাইকেল রপ্তানি শুরু হয়। প্রথম দিকে এ খাত থেকে তেমন আয় না হলেও ২০০৮ সাল থেকে বাড়তে শুরু করে রপ্তানি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশীষ বসু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের রপ্তানি পণ্য যে বহুমুখীকরণ হচ্ছে, বাইসাইকেল রপ্তানি বৃদ্ধি তারই প্রমাণ।”

রপ্তানিকারকরা বলছেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তৈরি পোশাকের মতো গোটা ইউরোপের বাজারও দখল করে নেবে বাংলাদেশের সাইকেল।

ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের আয় হয়েছে দুই হাজার ৩১ কোটি (২০ দশমিক ৩১ বিলিয়ন) ডলার, যার ৮১ শতাংশ এনেছে তৈরি পোশাক।

বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া বাইসাইকেলের ৮০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। বাকিটা যায় ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে।llllllllll2.jpg

 

সাইকেল জনপ্রিয় হচ্ছে ঢাকায়ও

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লুসিনটেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাইসাইকেলের বৈশ্বিক বাজারের আকার ৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলার হতে পারে।

এই বাজার দখলের একটি সুযোগ বাংলাদেশের সামনে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এখানে শ্রমের মজুরি কম। আমরা যে দামে সাইকেল রপ্তানি করতে পারব, তা কেউ পারবে না। মানের দিকটি মাথায় রেখে এই সুযোগটিই আমাদের কাজে লাগাতে হবে।”

সাইকেল রপ্তানি বাড়লেও তার গতি এখনও ধীর বলে মনে করেন ফরাসউদ্দিন। গতি বাড়াতে সরকার এবং উদ্যোক্তাদের এখনই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

শুরু থেকে এখন

প্রায় কুড়ি বছর আগে ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তাইওয়ানের কোম্পানি আলিতা বাংলাদেশ লিমিটেড স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রপ্তানি শুরু করে। পরে এই ধারায় যুক্ত হয় মেঘনা গ্রুপ। বর্তমানে দেশের মোট বাইসাইকেল রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই রপ্তানি করছে এই প্রতিষ্ঠানটি।

মেঘনা গ্রুপ ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিতা ও নর্থবেঙ্গল নামের প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে তাদের কারখানা থেকে উৎপাদিত সাইকেল বিদেশে রপ্তানি করছে।

রপ্তানিকারকরা জানান, বর্তমানে ফ্রিস্টাইল, মাউন্টেন ট্র্যাকিং, ফ্লোডিং, চপার, রোড রেসিং, টেন্ডমেড (দুজনে চালাতে হয়) ধরনের বাইসাইকেল রপ্তানি হচ্ছে।

এসব সাইকেল তৈরির জন্য কিছু যন্ত্রাংশ বাংলাদেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হলেও বেশির ভাগ যন্ত্রাংশই দেশে তৈরি হচ্ছে। বিশেষত চাকা, টিউব, হুইল, প্যাডেল, হাতল, বিয়ারিং, আসন তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

১৯৯৬ সালে তেজগাঁওয়ে সরকারি বাইসাইকেল তৈরির প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেয় মেঘনা গ্রুপ। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে রপ্তানি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে রেড, ফেরাল ও ইনিগো- এই তিন ব্র্যান্ডের মাধ্যমে ইউরোপ ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার কঙ্গো, গ্যাবন ও আইভরি কোস্টে সাইকেল রপ্তানি করছে তারা।

প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০১৫ সালে মেঘনা গ্রুপের বাইসাইকেল রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ছয় লাখটি।

১০০ থেকে শুরু করে ৫০০ ডলার মূল্যের সাইকেল রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি। এর বিভিন্ন বিভাগে সাত হাজারের মতো কর্মী কাজ করে।

মেঘনা গ্রুপের মার্কেটিং ম্যানেজার (সাইকেল লাইফ এক্সক্লুসিভ) মঈনুল ইসলাম রাহাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকার কাছে গাজীপুরে ছয়টি কারখানায় মেঘনা সাইকেল তৈরি করা হয়।

“এ সব কারখানায় উৎপাদিত সাইকেল রপ্তানি করা হয়। মাঝে কিছু দিন স্থানীয় বাজারে বাজারজাত বন্ধ রাখা হলেও এখন আবার তা পুরোদমে চালু করা হয়েছে।”

বানানো শেষ, বসানো হচ্ছে স্টিকার

সাইকেলের রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারকে সামনে রেখে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বড় বিনিয়োগ করেছে প্রাণ-আরএফএলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ থানায় হবিগঞ্জ ইন্ড্রাস্টিয়াল পার্কে অবস্থিত এই কারখানাটিতে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বছরে ৫ লাখ উৎপাদন ক্ষমতার এই কারখানায় উৎপাদিত ‘দুরন্ত’ বাইসাইকেল দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

আগামী এপ্রিল মাস থেকেই ইউরোপের বাজারে প্রাণ-আরএফএফের সাইকেল রপ্তানি শুরু হবে বলে জানিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগের প্রধান কামরুজ্জামান কামাল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ইউরোপের বাজার নানান দিক দিয়ে সার্ভে করে দেখেছি সেখানে বাইসাইকেলের বিরাট বাজার আছে।সেই সুযোগটিই আমরা কাজে লাগাতে চাই।”

২০১৫ সালে ১ লাখ সাইকেল রপ্তানির লক্ষ্য ঠিক করেছে প্রাণ-আরএফএল। রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজে প্রায় হাজার খানেক কর্মী দুরন্ত ব্র্যান্ডের আট ধরনের বাইসাইকেল তৈরি করছে।lllllllllll.jpg

ইউরোপের বাজার

ইউরোস্ট্যাটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯ সালে যেখানে ইউরোপের বাজারে বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নবম, সেখানে ২০১০ সালে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে উঠে আসে।

ইউরোপের আমস্টারডামের পথে চোখে পড়বে হাজারো সাইকেল

ইউরোপের আমস্টারডামের পথে চোখে পড়বে হাজারো সাইকেল

২০১৪ সালেও সেই পঞ্চম স্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

২০০৮ ও ২০০৯ সালে বাংলাদেশ যথাক্রমে তিন লাখ ৭১ হাজার ও চার লাখ ১৯ হাজারটি বাইসাইকেল রপ্তানি করে। ২০০৭ সালে যে সংখ্যাটি ছিল ৩ লাখ ৫৫ হাজার।

২০১০ সালে রপ্তানি বেড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ২০১১ ও ২০১২ দুই বছরেই সাড়ে পাঁচ লাখের মতো সাইকেল রপ্তানি হয় ইউরোপের দেশগুলোতে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে রপ্তানি ছাড়িয়ে যায় ছয় লাখ।

ইউরোপের বাজারে রপ্তানির শীর্ষে আছে তাইওয়ান। ২০১৩ সালে দেশটি ৩৫ লাখ বাইসাইকেল রপ্তানি করে। এর পরের অবস্থানে আছে যথাক্রমে থাইল্যান্ড (প্রায় ১৪ লাখ); শ্রীলঙ্কা (১৩ লাখ) ও ইন্দোনেশিয়া (সাড়ে ছয় লাখ)।

থেমে নেই আমদানি

রপ্তানি করলেও দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে থেমে নেই সাইকেল আমদানি। এখনও দেশের চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ করে বিদেশি সাইকেল। এজন্য আগের প্রবণতাকে দায়ী করেছেন উৎপাদকরা।

মেঘনা গ্রুপের মার্কেটিং ম্যানেজার রাহাত বলেন, “আমদানি করা সাইকেলের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় সেগুলোর চাহিদা বেশি। এছাড়া আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আমদানি করা সাইকেল বিক্রি করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।”

বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ও রাস্তাঘাটের কথা বিবেচনা করে রপ্তানির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারের জন্যও মেঘনা গ্রুপ সাইকেল তৈরি করছে বলে জানান তিনি।

ঢাকায় মেঘনা সাইকেলের বিক্রয় কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা যায়, সাড়ে ১৩ হাজার থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা দামের সাইকেল বিক্রি হচ্ছে।

ধানমণ্ডি সাত মসজিদ রোডে মেঘনা গ্রুপের সাইকেল লাইফ এক্সক্লুসিভ বিক্রয় কেন্দ্রের মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ শেখ মঈন উদ্দিন বলেন, “আমাদের শোরুমে মেঘনার ভেলোস ব্যান্ডের ছয় ধরনের সাইকেল বিক্রি হয়। এগুলোর দাম ১৩ হাজার ৫০০ থেকে ২৪ হাজার ৫০০ টাকা।”

লায়ন গ্রুপ স্থানীয় বাজারের জন্য সাইকেল তৈরি করে। এখন পর্য‌ন্ত তারা কোনো সাইকেল রপ্তানি করেনি।

ধানমন্ডি লায়ন সাইকেল স্টোরের বিক্রয় প্রতিনিধি আসিফ হোসেন বলেন, “আমাদের সাইকেলের দাম সাড়ে ১১ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা।”

কারখানায় সাইকেল তৈরিতে কর্মীরা

প্রাণ আরএফএল গ্রুপের আট ধরনের সাইকেল বাজারে রয়েছে। এগুলো হল- এক্সটিম, গ্লাডিয়েটর, ডেইজি, ক্যামেলিয়া, নাইট, রায়ান, এক্সপ্রেস এবং অ্যাভেঞ্জার। দাম ৪ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৭ হাজার ৪০০টাকা।

মূলত পুরান ঢাকার বংশালের ব্যবসায়ীরা দেশের বাইরের থেকে বাইসাইকেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানি করে তা সংযোজন বিক্রি করেন।

মূলত পুরান ঢাকার বংশাল থেকেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আমদানি করা সাইকেল।

কেন আমদানি করেন সাইকেল- এ প্রশ্নের উত্তরে বংশালে সাইফুল সাইকেল স্টোরের বিক্রয় প্রতিনিধি হাজী মোবারক হোসেন বলেন, “আমদানি করা সাইকেলের দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় সেগুলোই বেশি বিক্রি হয়।চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা আমদানি করি।”

বর্তমানে মূলত চীন ও ভারত থেকেই সাইকেল আমদানি হয়ে থাকে।

“আমাদের রাস্তাঘাট, আবহাওয়া ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর লক্ষ রেখে আমরা সাইকেল আমদানি করি,” বলেন মোবারক।

দেশের বাজারের কথা চিন্তা করে উদ্যোক্তারা যদি কম মূল্যের টেকসই সাইকেল তৈরি করেন তাহলে আমদানির প্রয়োজন হবে না বলে মনে করেন মোবারক হোসেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬:২৩:০২   ৮২৯ বার পঠিত