মঙ্গলবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০১৫

হরতাল-অবরোধে পোয়াবারো যশোর পুলিশের!

Home Page » জাতীয় » হরতাল-অবরোধে পোয়াবারো যশোর পুলিশের!
মঙ্গলবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০১৫



500x350_20773457a18a16cca82ae6d84c9974ba_po_1421021828.jpgবঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ গত ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে চলমান সহিংসতা নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠায় রয়েছে মানুষ। তবে এর আড়ালে চলছে অন্যরকম এক ‘অত্যাচার’। আর এ অত্যাচারের জন্য অভিযোগের তীর উঠেছে খোদ যশোর পুলিশের দিকেই।

বিশেষ করে যশোরের যেসব এলাকায় হরতাল-অবরোধে বাস-ট্রাক ভাংচুর বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেশি ঘটছে সেখানেই পোয়াবারো পুলিশের। তারা নাশকতার মামলা দেওয়া, ক্রসফায়ারে হত্যা বা পেট্রোল বোমাসহ চালান করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নিরীহ মানুষের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ সরকারি দলের নেতারাই!

ভুক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, গত এক মাসে যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া, মেঘলা, জয়কৃষ্ণপুর, বসুন্দিয়া, নরেন্দ্রপুর, শংকরপুর ও নাজির শংকরপুর এলাকার প্রায় ২৩টি বাড়িতে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় পুলিশ। এ সময় নগদ টাকাসহ সোনার গহনাও হাতিয়ে নেয় তারা।

পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ‘টাইগার ওয়ান’ নামে একটি টিম গঠন করেছে যশোর পুলিশ। কোতোয়ালি থানার ওসি ইনামুল হকের নেতৃত্বে এ টিমে কোতোয়ালি থানার দুইজন এবং ডিবি ও ডিএসবি শাখার দুইজন সাব-ইন্সপেক্টর রয়েছেন। টিমটি মূলত বিভিন্ন ‘অ্যাকশনে’ নিয়োজিত।

৬ জানুয়ারি রাতে শহরের বারান্দীপাড়ায় পার্ক করে রাখা একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। পরদিন খাজুরা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দু’টি বাস, ১২ জানুয়ারি যশোর-বেনাপোল সড়কের ধোপাখোলায় একটি পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাক, ১৭ জানুয়ারি যশোর-খুলনা মহাসড়কের পদ্মবিলায় বালুবাহী ট্রাক, ১৮ জানুয়ারি শহরের কোল্ডস্টোরেজ এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাস, ২৮ জানুয়ারি শহরতলীর কিসমত নওয়াপাড়ায় একটি বাস, ৩১ জানুয়ারি যশোর-বেনাপোল সড়কের নতুনহাটে একটি ট্রাক ও একটি প্রাইভেট কার এবং ২ ফেব্রুয়ারি রাতে মণিরামপুরে মাছবাহী একটি পিকআপ ভ্যান আক্রান্ত হয়। এসব যানবাহনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা।

পুলিশের জন্য ‘শাপে বর’ হয়ে দেখা দেয় দুর্বৃত্তদের এমন সহিংসতা। অভিযোগ উঠেছে, এসব এলাকায় আসামি ধরার নামে অভিযান চালিয়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় পুলিশ। ৩১ জানুয়ারি গভীর রাতে পুলিশ চড়াও হয় গাজীর দরগাহ সিঁড়িরমুখ এলাকার বিএনপি নেতা খোরশেদ আলমের ধানের চাতালে। একই রাতে অভিযান চালানো হয় বড় মেঘলা ও ছোট মেঘলা এলাকার সাতটি বাড়িতে। এসব বাড়ির লোকজনকে মারপিট করা ছাড়াও ঘরের আসবাবপত্রের ওপর চলে ধ্বংসযজ্ঞ। লেপ-তোষক ও পরনের কাপড়ও বাদ যায়নি। লুটপাট করা হয় নগদ টাকাসহ সোনার গহনাও।

জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের সিফায়েত হোসেন নামে আরেক ব্যক্তির বাড়িতে হামলা করে পুলিশ। সিফায়েতের পরিবারের অভিযোগ, ওই পুলিশ সদস্যরা আসবাবপত্র ভাঙচুরসহ ঘরের বাসিন্দাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। এমনকি দুর্ব্যবহারের শিকার হয় ওই বাড়ির অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়েটাও।

চাঁচড়া ইউনিয়নের বিএনপি নেতা মনিরুজ্জামানের পুত্রবধূ জোহরা অভিযোগ করেন, গভীর রাতে তাদের একটি মোটরসাইকেল ভাংচুর করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয় পুলিশ। যাওয়ার সময় তারা নগদ ৫০ হাজার টাকা ও ৩ ভরি সোনার অলঙ্কার নিয়ে যায়।

বড় মেঘলা গ্রামের সাহেব আলীর স্ত্রী রুনা লায়লা অভিযোগ করেন, তাদের ঘর থেকে ধান বিক্রির নগদ এক লাখ টাকা লুট করে দুর্বৃত্তরা। সাহেব আলী ও তার ভাই আল মামুনের বাড়ি থেকে সাত ভরি সোনার অলঙ্কার লুট করা হয়। ভাঙচুর করা হয় ঘরের টিভি, ভিসিডি, ল্যাপটপ, ফ্রিজ, চেয়ার, ডাইনিং টেবিল। ঘর থেকে লেপ-তোষকসহ কাপড়চোপড় বাইরে এনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে এবং নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েসহ তাদেরও পুড়িয়ে মারার হুমকি দেওয়া হয়। এ সময় ওই দুর্বৃত্তদের সঙ্গে পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজনও ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

ঝুমঝুমপুর বিসিক শিল্প এলাকার জনতা প্রেস। গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবু ইসহাক বাবুকে চোখ বেঁধে উঠিয়ে নতুনহাট এলাকায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর তার পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে থানায় সঙ্গে রফা করেন পরিবারের সদস্যরা।

শুধু আবু ইসহাক বাবুই নয়। গত এক মাসে একইভাবে আরও কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের তুলে এনে চাঁদা দাবি করার অভিযোগ রয়েছে যশোর পুলিশের বিরুদ্ধে। মূলত ক্রসফায়ারে হত্যা বা পেট্রোল বোমাসহ চালান করে দেওয়াই তাদের নিয়মিত হুমকি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের কয়েকজন সাব-ইন্সপেক্টর বলেন, বর্তমান ওসি ইনামুল বেশ দাম্ভিক। তিনি প্রকাশ্যে বলেন, ‘সাতক্ষীরা সাইজ করে এসেছি, আর এটাতো যশোর!’

তারা জানান, টাইগার ওয়ান টিমে কয়েকজন সাব-ইন্সপেক্টর আছেন, যাদের মধ্যে মানবিকতা বলে কোনো শব্দ নেই। তারা মানুষকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে এমনকি তাদের সন্তানদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

এমন ঘটনার কথা কিছু কিছু শুনেছেন বলে জানিয়েছেন যশোর জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ইকবাল কবীর জাহিদ। সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান তিনি।

যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ বলেন, ‘বর্তমান ওসি ইনামুল হকের সঙ্গে তো কথাই বলা যায় না। তিনি কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আর দালাল পুষছেন। নাশকতার মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে ওরাই লোকজনের কাছ থেকে টাকা আদায় করছেন। এদের বিষয়ে কথা বলে বা পত্রিকার লেখালেখি করেও লাভ হচ্ছে না’।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে যশোরের পুলিশ সুপার (এসপি) আনিসুর রহমান বলেন, ‘আদিকাল থেকেই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে। এসব অভিযোগ কখনও বন্ধ হবে না। এর মধ্য দিয়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাবো’।

তবে যশোরের সবাই এখন যেভাবে পুলিশ আতঙ্কে অস্থির, এমনকি সরকারি দলের নেতারাও যেভাবে অভিযোগ জানালেন, তাতে ওই পুলিশ সদস্যরা ঠিক কার জন্য কীসের ‘দায়িত্ব’ পালন করছেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় বলে মন্তব্য করেছেন ভুক্তভোগীরা।

বাংলাদেশ সময়: ১২:৪৪:৫১   ৪৩৯ বার পঠিত