রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০১৪

ধর্ষণ ও সাক্ষ্য আইনের দুর্বলতা

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » ধর্ষণ ও সাক্ষ্য আইনের দুর্বলতা
রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০১৪



images3.jpgবঙ্গ-নিউজঃ পবাংলাদেশ লিগাল এইড সার্ভিসের সঙ্গে ২০১১ সাল থেকে ধর্ষণ মামলার সামাজিক বাস্তবতা বিষয়ে গবেষক হিসেবে আমি কাজ করছি। কাজের সূত্রে ব্লাস্টের গবেষক হিসেবে ধর্ষণ মামলায় কেন ভিকটিমের ‘চরিত্র’ বিষয়টি এত প্রাসঙ্গিক, এ নিয়ে একটি নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণাকাজ শুরু করি। বছর খানেক আগে গবেষণার উদ্দেশ্যে জেলখানায় ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত একজনের সঙ্গে আলাপ করছিলাম। তাঁর বিরুদ্ধে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তিনি প্রায় তিন বছর ধরে জেলখানাতেই অভিযুক্ত হিসেবে কারাবন্দী। আলাপ চলাকালে আমি তাঁকে যতবার ধর্ষণ মামলা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, বারবারই তিনি আমাকে এক কথাই বলতে লাগলেন, ‘সে ভাড়াইট্টা, ভাড়াইট্টা নষ্ট হয় কেমনে?’
গবেষণাকাজে প্রথমবারের মতো যখন আমি রাজধানীর বাইরে একটি জেলার আদালতকক্ষ পর্যবেক্ষণ করতে যাই, তখন আমার ভয়ংকর রকমের ধাক্কা লেগেছিল। আদালতকক্ষে অসংখ্য মানুষ। তারা সবাই একসঙ্গে কথা বলতে থাকে। এর মধ্যেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে করা মামলাগুলোর শুনানি চলতে থাকে। ধর্ষণের অভিযোগকারী নারী আদালতকক্ষে অসংখ্য মানুষের সামনে ধর্ষণ অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করেন, বিবাদীপক্ষের উকিলের জেরার উত্তর দিতে গেলে ভিকটিমের আশপাশে নানা রকম হাসি-তামাশা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ শুরু হয়ে যায়। কখনো স্বয়ং বিচারক বলতে পারেন, ‘আপনি প্রশ্ন করতে দেন না, দেখেন না কী বের হয়!’
তার মানে কি থলের থেকে বিড়াল বেরোনো নারীর, ‘ভাড়াইট্টা নারীর’, ‘নষ্টা নারীর’ ধর্ষণ হয় না?
২. চরভদ্রাসনের ১৩ বছর বয়সের মেয়েশিশু মেহেরুন্নেছা (ছদ্মনাম) গণধর্ষণের শিকার হয়ে অপহরণের এক মাস পর বাড়ির কাছের পাটখেত থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার হয়। তার বাবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৩) ধারা মোতাবেক অপহরণ ও গণধর্ষণ মামলা করেন। ঘটনার ৪০ দিন পর মেডিকেল সনদ এই মর্মে প্রত্যয়ন করে যে, ভিকটিমের বয়স ১৭ বছর, তার শরীরে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গমের চিহ্ন নেই, ভিকটিম যৌনসঙ্গমে অভ্যস্ত। এই সনদের ভিত্তিতে সাতজনের মধ্যে পাঁচ অভিযুক্ত ব্যক্তি বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। বাকি দুজন অভিযুক্ত ব্যক্তির একজনের সঙ্গে ওই শিশুর পূর্বপরিচয় থাকায় আদালত পুনরায় তদন্ত কর্মকর্তাকে ‘ভিকটিমের ভালোবাসার সূত্রগুলো ভালোভাবে দেখিতে হইবে’-এই মর্মে তদন্ত চালানোর নির্দেশ জারি করেন। দুই অভিযুক্ত ব্যক্তির একজন সাক্ষ্য আইনের মাধ্যমে ভালোবাসার সম্পর্ক এবং শিশুটির সঙ্গে তার অপর বন্ধুর শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে, সে ‘খারাপ চরিত্রের’-এই সাক্ষ্যপ্রমাণের মধ্য দিয়ে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা থেকে খালাস পেয়ে যায়।
তার মানে কি অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলে, অভিযুক্ত চেনা হলে ধর্ষণ হয় না?
৩. মির্জাপুর অঞ্চলের শিমুল (ছদ্মনাম) আড়তদার পরিবারের বউ হয়ে এলেন। তাঁর প্রবাসী স্বামী বিয়ের পর ছয় মাস সংসার করে দেশ ছেড়ে গেলেন এবং সে সময় শিমুল সন্তানসম্ভবা। শ্বশুরবাড়িতে তাঁর অজ্ঞাতে মেঝেতে ফেলে রাখা তেলে আছাড় খেয়ে পড়ে তিনি ভ্রূণ হারালেন। বিয়ের ১৬ মাসের মাথায় মেজো দেবর নজরুল (ছদ্মনাম) হাতে অ্যাসিডসমেত যৌনকাজের প্রস্তাব দিলে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে বাল্বে রাখা অ্যাসিড শিমুলের শরীর পুড়িয়ে দেয়। চিৎকাররত অবস্থায় শাশুড়ি, দুই ননাস এবং মেজো দেবর মিলে সেই অ্যাসিডদগ্ধ শিমুলের শরীরে মোমবাতি দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। নারী সংগঠনের কর্মীর মারফত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) আসার পর টানা তিন বছর মামলা চলতে থাকে। শেষমেশ ২০১০ সালে স্বামী জামান শিমুলের ডিভোর্সের পরবর্তী সময়ে ধর্ষণের হুমকি এবং অ্যাসিড-সন্ত্রাসের মামলায় শিমুলের বিরুদ্ধে ‘স্বামী প্রবাসে থাকা অবস্থায় একাধিক দেবর ও বহিরাগতকে যৌনকাজের প্রস্তাব দিয়েছেন’ এবং নজরুল ভাবির প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় ‘অর্থের লোভে শিমুল নিজের শরীরে মোমবাতি দিয়ে আগুন লাগিয়ে মিথ্যা মামলা সাজিয়েছেন, শিমুল একটা বেশ্যা’-এই মোতাবেক সাক্ষ্য দেওয়ায় নারী নির্যাতন মামলা খারিজ হয়ে যায়।
তার মানে কি এই যে বিবাহিত নারীর ধর্ষণ হয় না?
৪. ধর্ষণ মামলার প্রমাণ আসলে ‘সামাজিক প্রমাণ’। আইনি ভাষায় ব্যবহৃত ‘দুশ্চরিত্রা’ শব্দের কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন খোদ আইনেই নেই। আইনে সুনির্দিষ্ট নেই যে একজন নারী কী কী করলে তাঁকে দুশ্চরিত্রা বলা যায়। তথাপি বিচারালয়ে সবাই এই ‘দুশ্চরিত্রা’ শব্দটিকে আইনের বাইরে বিরাজমান নারীর যৌনতা ও শরীরকেন্দ্রিক যে ‘ভালো-মন্দের’ সামাজিক ধারণা রয়েছে, তার ভিত্তিতেই বুঝতে শেখে। সামাজিক ধারণায় মনে করা হয়, রাতের অন্ধকারে, অচেনা মানুষ, অস্ত্রের মুখে, অপহরণ করে তুলে নিয়ে গেলে ধর্ষণ হতে পারে। নারী হিসেবে আপনি যদি ধর্ষণের পর মরে যান, নিদেনপক্ষে আত্মহত্যা করে ফেলেন, তবেই হয়তো সমাজের মনে হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে যে আপনি মরে গিয়ে প্রমাণ করলেন আদতে আপনি ‘চরিত্রবান সতী’। সতীত্ব শেষ হওয়ায় আপনার জীবনেরও সমাপ্তি ঘটল, তাই কেবল আপনারই ধর্ষণ হতে পারে।
তার মানে কি কেবল সাংস্কৃতিকভাবে চিহ্নিত ‘সতী’রই ধর্ষণ হতে পারে? ‘কুমারী’ নারীরই কি কেবল ধর্ষণ হয়?
৫. বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর অধীনে ‘নারী একটি বিশেষ যৌনক্রিয়ায় একটি বিশেষ পুরুষের সাথে যৌনতায় সম্মত ছিলেন, কি ছিলেন না’-ধর্ষণের এই সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন থাকা সত্ত্বেও ভিকটিমকে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার কারণেই ধর্ষণ মামলা দায়ের করতে গেলে ‘নৈতিক চরিত্রের’ পরীক্ষা দিতে হয়। নৈতিক চরিত্রের পরীক্ষা শেষে নারীটি আদৌ মামলা করার জন্য উপযুক্ত কি না, এই বোঝাপড়া বিচারালয়ে প্রমাণিত হয়। আইনিভাবে ধর্ষণ কী, সেটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণ মামলায় যখন ভিকটিমের অতীত ‘চরিত্র’, আগেকার যৌন সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়, তখন এটি নারীবিদ্বেষী, সর্বোপরি সংবিধানবিরোধী একটি দ্বৈত আইনব্যবস্থা কায়েম করে।
পাঠক, তাহলে কি প্রশ্ন করা যায় না ধর্ষণ মামলার বিচারে আসলে কে থাকে? অভিযুক্ত, নাকি অভিযোগকারী? কেন ধর্ষণের অভিযুক্ত কোনো আসামির ‘চরিত্র’সংক্রান্ত বিষয় জানার ক্ষেত্রে আইনের ৫৪ ধারায় নিষেধাজ্ঞা জারি আছে?
৬. ধর্ষণ যতটা না নারীর প্রতি সহিংসতা, যতটা না নারীর শরীরের প্রতি সহিংসতা, যতটা না নারীর প্রতি কৃত অপরাধ, তার চেয়ে বেশি ধর্ষণকে নৈতিকতা, পবিত্রতা, সম্মান, সম্ভ্রম, সতীত্বের কাঠামোর মধ্যে দেখা হয়। এই বাস্তবতায় ধর্ষণ মামলাগুলো প্রায়ই ভিকটিমের ‘চরিত্রহরণের’ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ হলো, অপরাপর আর কোনো মামলার ধরনেই সাক্ষ্য এত জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে না, যতটা একজন সাক্ষী সাক্ষ্য আইনের মারফত ধর্ষণ মামলার ভিকটিমের চরিত্র-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রভাব ফেলতে পারে। ভিকটিমের বিগত যৌন ইতিহাস নিয়ে কথোপকথন ও জিজ্ঞাসাবাদের সংস্কৃতি চালু থাকার দরুন শতকরা ৯০ ভাগ মেয়েশিশু ও নারী ধর্ষণ মামলার অভিযোগ আনতে ভয় পান। কেউ কেউ মামলা মাঝপথে বন্ধ করে দেন। অনেক সময় আসামিপক্ষের উকিলের জেরায় ভিকটিম নারী মানসিক, সামাজিক ও শারীরিকভাবে ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েন, এমনকি আত্মহননের পথ বেছে নেন। মোট ফলাফলে ধর্ষণের অভিযোগ বিচারের বাইরে রয়ে যায়।
মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক প্রতিকূল প্রেক্ষাপট দমনে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা সম্পূর্ণ বাতিলকরণ অতি জরুরি। ২০০০ সালে বিচারপতি বি.পি. জীবন রেড্ডির নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনের সুপারিশক্রমে ভারত সরকার ২০০৩ সালে এই ধারা বাতিল করেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:১১:০৭   ৩৫৬ বার পঠিত