সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০১৪
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিবঙ্গনিউজ:শনিবারে সারা দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকেরা। তৈরী পোশাক খাতের প্রতিনিধিরা বলছেন, তাদের ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন তাদের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে সামগ্রিক ক্ষতি কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। সরকার গঠিত আট সদস্যের তদন্ত কমিটি দিয়ে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ হবে না বলেও সংশয় প্রকাশ করেছেন তারা। এ জন্য তারা নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন।
পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমত উল্লাহ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, শনিবারের সারা দেশের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে আট সদস্যের যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের দিয়ে ক্ষতির সঠিক পরিমাণ বের হবে না। এ কারণে তিনি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ বের করার দাবি জানান।
বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে তিন ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতি, অর্থাৎ যন্ত্রাংশের ক্ষতি, দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং তৃতীয়ত, মানুষের দুর্ভোগজনিত ক্ষতি। প্রত্যক্ষ ক্ষতি বলতে তিনি বুঝিয়েছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশের ক্ষতি। কেননা, বিদ্যুৎকেন্দ্র হলো একটি স্পর্শকাতর খাত। এখানে সামান্য ত্রুটির কারণে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রেই কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে প্রকৃত ক্ষতি কী পরিমাণ হয়েছে তা এ মুহূর্তে বলা যাবে না। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে প্রকৃত ক্ষতি নির্ণয় করা যাবে। তবে এটুকু বলা যেতে পারে সারা দেশে একযোগে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে কয়েক হাজার কোটি টাকার যন্ত্রাংশের ক্ষতি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক ক্ষতি। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে সারা দেশের সব ধরনের শিল্পের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এমনও কারখানা আছে যেখানে চালু অবস্থায় বিদ্যুৎ গেলে এবং বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকলে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়াই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শনিবারের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে এমন ক্ষতি হয়েছে বেশি। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে কলকারখানার সাথে গাড়ির চাকাও বন্ধ হয়ে যায়। বলা চলে বিদ্যুৎ নির্ভর সব ধরনের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এখানেও কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের দিয়ে ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ নির্ণয় হবে না।
তৃতীয়ত, মানুষের দুর্ভোগ। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে দেশবাসীর দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে। সময়মতো পানির অভাবে রান্না করা যায়নি। ফ্রিজে রাখা মাছ তরিতরকারি নষ্ট হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারেনি। তিনি বলেন, মানুষের দুর্ভোগের জন্যও কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জ্বালানি সেক্টরের এ বিশেষজ্ঞের মতে, সরকার আট সদস্যের যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তাদের মাধ্যমে প্রকৃত ক্ষতি নির্ণয় সম্ভব হবে না বলে তিনি আশঙ্কা করেছেন। তিনি বলেন, একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে এ কমিটি গঠিত হয়েছে। যিনি কোনো টেকনিক্যাল পারসন নন। এ ছাড়া আমলারা সব সময়ই সরকারের স্বার্থ সংরক্ষণ করে, সরকারের প্রেসকিপশন অনুযায়ী চলে। এখানে সরকার সমালোচিত হোক এমন প্রকৃত ঘটনা তিনি বের করবেন না। এ কারণে তার কাছে বিদ্যুৎ খাতের প্রকৌশলীরাও প্রকৃত তথ্য দিতে সাহস পাবে না। এ কারণেই তার এ আশঙ্কা। তিনি বলেন, এ জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করলেই ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ বের হবে বলে তিনি মনে করেন।
এ নিয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস মালিক সমিতির সংগঠন বিটিএমএ সাবেক সভাপতি আব্দুল হাই সরকার বলেন, প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা বলা মুশকিল। যার ক্ষতি হয়েছে তিনিই বলতে পারবেন। তবে টেক্সটাইল খাতে বিশেষ করে ছোট কারখানাগুলোতে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সাথে এসব কারখানাগুলোরও বিপর্যয় বয়ে এনেছে। তিনি বলেন, যাদের নিজস্ব ক্যাপটিভ পাওয়ার নেই এসব কারখানাগুলোর ডাইং ও নিটিংয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি। কেননা উৎপাদন ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়াই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি জানান, বর্তমানে দেশে পাঁচ হাজারেরও বেশি টেক্সটাইল কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশেরই নিজস্ব বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ২০ শতাংশের নিজস্ব ক্যাপটিভ পাওয়ার নেই। এ কারণে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। তিনি ধারণা করেন, সামগ্রিকভাবে টেক্সটাইল খাতে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এ নিয়ে বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী গতকাল জানিয়েছেন, ১০/১২ ঘণ্টার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে সার্বিকভাবে রফতানিমুখী শিল্পের ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে। তিনি বলেন, হঠাৎ বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে সব উৎপাদনমুখী শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হয়। আগাম কোনো সতর্কতা ছাড়াই বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় কেউ বুঝতে পারেননি ঠিক কতক্ষণ পরে বিদ্যুৎ আসবে। অন্যান্য দিনের মতো বিকল্পভাবে জেনারেটর চালিয়ে কারখানার উৎপাদন চালু রাখা হয়। স্বাভাবিকভাবেই ঘণ্টা দুই পরেই জেনারেটরের তেল ফুরিয়ে যায়। একপর্যায়ে জেনারেটর বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে উৎপাদনও বন্ধ হযে যায়। এ পর্যায়ে অনেকেই পাম্পে তেল আনতে যান। কিন্তু বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে পাম্পেও তেল সরবরাহ বন্ধ থাকে। ফলে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি জানান, সামগ্রিক ক্ষতি তো বলা মুশকিল। তবে শুধু রফতানিমুখী শিল্প খাতেই ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, শনিবার সাড়ে ১১টা থেকে সারা দেশে একযোগে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। রাত ৯টার পর থেকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। তবে কী কারণে এ বিপর্যয় তার সঠিক কারণ গতকাল পর্যন্তও জানা যায়নি। তবে বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন ও স্থানীয় সঞ্চালন লাইনের সংযোগ স্থলে ত্রুটির কারণেই সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছে। এ জন্য একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে আট সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। আগামীকাল শেষ হবে রিপোর্ট দাখিলের সময়সীমা।
বাংলাদেশ সময়: ৭:০০:০০ ৩৮৫ বার পঠিত