সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০১৪

সরকারি আইন লংঘন করে চলছে ক্যামব্রিয়ান স্কুল ও কলেজ।

Home Page » জাতীয় » সরকারি আইন লংঘন করে চলছে ক্যামব্রিয়ান স্কুল ও কলেজ।
সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০১৪



 im444444ages.jpg

সরকারি আইন ও বিধিবিধান লংঘন করে চলছে ক্যামব্রিয়ান স্কুল ও কলেজ। কলেজ স্থাপনসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস ও শাখা খোলা, পরিচালনা, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, হিসাব ব্যবস্থাপনা সব ক্ষেত্রেই কায়েম করা হয়েছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এমকে বাশার। তিনি মন্ত্রণালয়ের নিয়ম-কানুন কিছুই মানেন না। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই ক্যামব্রিয়ানের সব শাখা পরিচালনা করেন। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের বিধিবিধান থাকলেও সেদিকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। বরং এসবের মাধ্যমে তিনি শিক্ষাকে বাণিজ্যে পরিণত করেছেন। তার লাগামহীন ও বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে শিক্ষা বোর্ডের নেক নজর হারিয়েছেন অনেক আগেই। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার শর্ত অনুযায়ী ক্যামব্রিয়ানের স্বীকৃতি বাতিল হওয়ার কথা থাকলেও এখনও তা বহাল রয়েছে।
ক্যামব্রিয়ানের অবৈধ কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান রোববার যুগান্তরকে বলেন, ক্যামব্রিয়ানের অবৈধ ক্যাম্পাস অপসারণে প্রয়োজনে পুলিশের সহযোগিতা নেয়া হবে। তবে যেসব কার্যক্রমে জনগণ প্রতারিত হয় এবং অবৈধ কার্যক্রম হিসেবে যা বিবেচিত, তা দমনের দায়িত্ব পুলিশের। এ বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে অনুরোধ জানানোর কথা বলেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘ক্যামব্রিয়ানের শাখা ও ক্যাম্পাস কিছুই বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে করা হয়নি। নিয়ম হচ্ছে, প্রতি ৬০ জনের জন্য একটি শাখা হবে। নতুন ৬০ জনের বিপরীতে কেউ একটি শাখা খুলতে চাইলে তার জন্য মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু ক্যামব্রিয়ান স্থান সংকুলান না হওয়ার কথা বলে একই এলাকায় একাধিক ক্যাম্পাস ভাড়া নিয়েছে। অথচ এর জন্য অনুমোদন নেয়া হয়নি। আর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যে ক্যাম্পাস খোলা হয়েছে তারও কোনো অনুমোদন নেই।’ তিনি বলেন, ‘এসবই অবৈধ। ক্যামব্রিয়ানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার কথা বলেন বোর্ড চেয়ারম্যান।’
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, ক্যামব্রিয়ানের ঢাকা ও চট্টগ্রামের মূল দুটি ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে এর প্রায় সব শাখা ও ক্যাম্পাসই অবৈধ। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এই কলেজটি স্বীকৃতি পাওয়ার ৫ বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা। কিন্তু ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্যামব্রিয়ান স্থায়ী ক্যাম্পাস ও নিজস্ব ভবনে যেতে পারেনি। বরং একের পর এক অবৈধ ক্যাম্পাস ও শাখা খুলে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এমকে বাশারের এসব লাগামহীন অবৈধ কার্যক্রম রক্ষা ও পরিচালনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গড়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট। তার বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড জায়েজ করতে প্রতি মাসে তাদের দেয়া হয় মোটা অংকের বখরা। প্রতিটি দফতরে রয়েছে এই শিক্ষা ব্যবসায়ীর এজেন্ট। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের প্রতিষ্ঠানটিতে পড়ানো হয়। এর বাইরে নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামেও অর্থ বিলানো হয়। মন্ত্রণালয়ের ১৮ তলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় কর্মচারী সমিতির প্রকাশিত এমনই একটি ক্যালেন্ডার রোববারও দেখা গেছে, যা প্রকাশের অর্থ দিয়েছে এই ক্যামব্রিয়ান। এভাবে নানা প্রক্রিয়ায় দেয়া হয় বখরা। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ক্যামব্রিয়ানের প্রথম স্বীকৃতির শর্ত অনুযায়ী এতদিনে এটি অবৈধ হয়ে গেছে। ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট ঢাকা বোর্ডের দেয়া প্রথম অস্থায়ী স্বীকৃতির চিঠিতে বলা হয়, ৫ বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে না গেলে এবং এর আয়-ব্যয় সরকারি আর্থিক বিধিমালা অনুযায়ী পরিচালনা না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এর স্বীকৃতি বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এরপরও বছরের পর বছর ধরে প্রতারণামূলকভাবে টিকে আছে প্রতিষ্ঠানটি। উপরন্তু শিক্ষা-বাণিজ্য গোটা ঢাকা শহরে বিস্তৃতির পর ঢাকার বাইরেও এর ডানা মেলেছে। ইতিমধ্যে ক্যামব্রিয়ান নামে চট্টগ্রামেও একটি কলেজ খুলে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে চট্টগ্রাম বোর্ডের কোনো অনুমোদন বা অনুমতি নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক সুমন বড়ুয়া। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ শাখার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও কোনো অনুমোদন নেই। ফলে সেখানে ভর্তি করা দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন এক প্রকার ধ্বংসের মুখে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির প্রথম অস্থায়ী স্বীকৃতির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১১ সালের ৩০ জুন। এরপর এ প্রতিষ্ঠানটির স্বীকৃতি পুনরায় নবায়ন করা হয়। অথচ এ ব্যাপারে ঢাকা বোর্ড প্রাথমিক স্বীকৃতির শর্ত পূরণ হয়েছে কিনা সে বিষয়ে কোনো খোঁজখবর নেয়নি। দ্বিতীয় দফায় যখন স্বীকৃতি নবায়ন করা হয় তখন কলেজ পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা বোর্ডের বর্তমান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ। এ ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিধিমালার শর্ত অনুযায়ী ক্যামব্রিয়ানের স্বীকৃতি থাকে না। কিন্তু ঢাকা শহরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিষয়টিকে আমরা উদারভাবে দেখেছি। কেননা, বিধিমালার শর্ত অনুযায়ী ঢাকায় জমি পাওয়া কঠিন। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ভালো করছে। সময় দিলে তারা স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাবে।’
এখানেই শেষ নয়, এই প্রতিষ্ঠানটি টাকা কামানো আর শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারী নির্যাতনের সেলে পরিণত হয়েছে। ভর্তি থেকে শুরু করে হোস্টেলে বসবাস পর্যন্ত প্রতিটি খাতে মোটা অংকের অর্থ আদায় করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, সুযোগ-সুবিধা দেয়ার নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চহারে এই অর্থ আদায় করা হলেও প্রতিশ্র”ত সেই সুবিধা দেয়া হয় না। পাঠদান করা হয় কোচিং সেন্টার স্টাইলে। ফলে শিক্ষার্থীরা পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করতে পারছে না। হোস্টেলে দেয়া হয় নিুমানের খাবার। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে- প্রতিষ্ঠানটির হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের ওপর চলে নিষ্ঠুর নির্যাতন। নির্যাতনের চিত্র এতই ভয়াবহ যে, ১৭ অক্টোবর হোস্টেলে একজন ছাত্রকে বেধড়ক পেটানো হয়। এ ঘটনার পরদিন সকালে ছাত্রটির লাশ পাওয়া যায়। পরিবার এ ঘটনাকে ‘খুন’ হিসেবে অভিযোগ করেছে। খুনিদের বিচারের দাবিতে ২০ অক্টোবর কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন সমাবেশ করেন। ২২ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ রাষ্ট্রীয় কাজে কক্সবাজারে সফরে গেলে স্থানীয় ছাত্রনেতা এবং রায়হানের পরিবারের সদস্যরা তার (মন্ত্রী) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ছাত্র হত্যার বিচার দাবি করেন। মন্ত্রী তখন এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। সরেজমিন দেখা গেছে, ১৭ অক্টোবরে পিটিয়ে ছাত্রকে নির্যাতন ও ঝুলন্ত লাশ পাওয়ার পরদিন শিক্ষার্থীরা হোস্টেল ত্যাগ করে। সূত্র জানিয়েছে, এভাবে চরম নির্যাতনের কারণে শিক্ষার্থীদের হোস্টেল ত্যাগ আর আত্মহত্যা অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মূলত শিক্ষা বাণিজ্যকে উপজীব্য করে চলছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এই বাণিজ্য নির্বিঘ্ন এবং পোয়াবারো করার লক্ষ্যে পাশাপাশি আরও তিনটি কলেজ খুলে বসেছে এর উদ্যোক্তা গোষ্ঠী। বাকি তিনটি কলেজ হচ্ছে- মেট্রোপলিটন কলেজ, কিংস কলেজ এবং উইনসাম কলেজ। অভিযোগ রয়েছে, ক্যামব্রিয়ান কলেজের নামে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ক্লাসও করানো হয় সেখানে। কিন্তু পরে এদের অনেককেই আবার অন্য কলেজগুলোর নামে পরীক্ষা দেয়ানো হয়। অথচ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ক্যামব্রিয়ানের খরচই আদায় করা হয়। অন্য কলেজ থেকে পরীক্ষার ব্যাপারে কেউ আপত্তি করলে তাদের টিসি (বদলি সনদ) দিয়ে কলেজ থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এ ঘটনাকে অভিভাবকরা প্রতারণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
২৯ সেপ্টেম্বর কলেজটিতে সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, রাসেল সবুর নামে এক অভিভাবক এমনই একটি বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের সঙ্গে দেন-দরবার করে ফিরছেন। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্যামব্রিয়ান কলেজ থেকে তার ছেলের ২০১৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা। কিন্তু কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় খারাপ করেছে এই ধুয়া তুলে এখন তাকে একই মালিকের ভিন্ন নামের কলেজ থেকে পরীক্ষা দিতে বলা হচ্ছে। এতে রাজি না হওয়ায় টিসি ধরিয়ে দিতে চায়। এ অভিভাবক অভিযোগ করেন, অসুস্থতার কারণেও যদি কোনো শিক্ষার্থী স্কুল বা কলেজে যেতে না পারে তাহলে তাকে মোটা অংকের জরিমানা করা হয়। এভাবে নানা খাত তৈরি করে টাকা কামানোর মেশিনে রূপান্তরিত করা হয়েছে ক্যামব্রিয়ান নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে।
অবৈধ শাখা আর ক্যাম্পাসের মিছিল : প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ঠিকানা ছিল গুলশান ২ নম্বরে। পরে প্রগতি সরণির ঠিকানায় ক্যাম্পাস স্থানান্তর করা হয়। এ ঠিকানায় স্থানান্তরের অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা বোর্ড দুটি শর্ত দিয়েছিল। এগুলো হচ্ছে- বোর্ডের পূর্বানুমতি ছাড়া বর্তমান ভবন পরিবর্তন এবং ভিন্ন কোনো ক্যাম্পাসে কলেজের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। সরকার/বোর্ডের বিধিবিধান অনুসরণ করে কলেজ পরিচালনা করতে হবে। এর ব্যর্থতায় অনুমতি প্রত্যাহারের ক্ষমতা বোর্ড সংরক্ষণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮-এর ২৪ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় কলেজের সঙ্গে স্কুল শাখায় নবম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেয়। একই বছর ৮ মে ঢাকা বোর্ড থেকে নবম শ্রেণীতে ভর্তির অনুমতি নেয় তারা। এই অনুমতিপত্রে স্কুল ও কলেজকে অভিন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বলেছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। সেই হিসেবে অনুমোদিত ঠিকানার বাইরে স্কুল শাখাও করা যাবে না। কিন্তু সরকার ও বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া শুধু গুলশান-বারিধারা এলাকায়ই ১৩টি ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া উত্তরা, মিরপুর, কেরানীগঞ্জ, লালমাটিয়া, যাত্রাবাড়ীতেও ক্যাম্পাস খুলে বসেছে, যেখানে ভর্তিসহ একাডেমিক কার্যক্রম চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা বোর্ডের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারী এসব অন্যায় ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের পেছনে মদতদাতা হিসেবে রয়েছেন। বিষয়টির প্রমাণ মেলে ঢাকা বোর্ডে সরেজমিন পরিদর্শনকালে। ক্যামব্রিয়ানের ফাইলের ব্যাপারে কলেজ পরিদর্শক, উপপরিদর্শক, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (সাবেক কলেজ পরিদর্শক) ও শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে অন্তত ১৫ দিন সাক্ষাৎ করা হয়। এদের মধ্যে কলেজ পরিদর্শক নতুন যোগদান করেছেন। উপপরিদর্শক অদ্বৈত কুমার রায় এক বছরেরও বেশিদিন কর্মরত আছেন। তিনি তথ্য দেয়ার কথা বলে অন্তত ৩ সপ্তাহ ঘুরিয়েছেন এ প্রতিনিধিকে। পরে জানিয়ে দেন যে, শাখায় ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে তথ্য জানতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সাবেক কলেজ পরিদর্শক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দের কাছেও অন্তত ১৫ দিন সাক্ষাৎ করা হয়। কলেজের অনুমোদন ছাড়া ঢাকাজুড়ে অবৈধ শাখা ও অবৈধ ক্যাম্পাস খোলাসহ অন্যান্য বিষয়ে তথ্য চাওয়া হলে তিনি কলেজটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। তবু হাল ছাড়ে না যুগান্তর অনুসন্ধান টিম। বেশ কয়েকবার ধরনা দেয়ার পর ২০ অক্টোবর বরফ গলে। এরপর তিনি কিছুটা খোলাসা করে বলেন, ‘কলেজের শাখা খোলা, ভর্তির আসন বৃদ্ধি ইত্যাদি ব্যাপারে আমরা খোঁজখবর নিই না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভর্তির সময়ে তড়িঘড়ি আসন বরাদ্দ করা হয়। সময় স্বল্পতার কারণে তা আর সম্ভব হয় না। যে কারণে চাইলেই আমরা আসন বরাদ্দ দিয়ে থাকি। এর ফলে আসন বাড়িয়ে নিয়ে ভর্তি করা শিক্ষার্থীদের বৈধ না অবৈধ ক্যাম্পাসে পড়ানো হবে তা যাচাই-বাছাই করার সময় পাওয়া যায় না।’ মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যেসব অভিভাবক সেখানে যাচ্ছেন তারা জেনেশুনেই সন্তান ভর্তি করছেন। বাশার সাহেব এখানে প্রতারণা করছেন না। তবে ঘোষণার বাইরে অর্থ নিলে আমরা তখন তাকে ধরতে পারতাম। তাছাড়া অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে অভিযোগ নেই।’
এদিকে এই কর্মকর্তার প্রসঙ্গে একই দফতরের অপর এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘আরে ভাই উনি তো বাশারের পক্ষে কথা বলবেনই। কারণ তার সঙ্গে বাশার সাহেবের বিশেষ সখ্য রয়েছে।’
অবৈধ শাখা অনুমোদনের উদ্যোগ : অবৈধ এসব শাখার মধ্যে মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও কেরানীগঞ্জের তিনটি শাখা বৈধ করার জন্য গত বছরের ১১ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক ডাকা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী এর নেপথ্যে ছিলেন বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর দামি গিফট উপহার, বার্ষিক পিকনিকের খরচ, ছেলে-মেয়েকে ক্যামব্রিয়ানে ভর্তি করিয়ে বিনা পয়সায় পড়ানোসহ নানাবিধ অবৈধ ও অন্যায় সুযোগ নেয়া মন্ত্রণালয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা কর্মকর্তারা লেজ গুটিয়ে নেন।
অবৈধ ভর্তি নতুন নয় : চট্টগ্রামের ক্যামব্রিয়ানের নামে অবৈধ ও আগাম ভর্তি এবারই নতুন নয়। এর আগে ২০০৮ সালেও স্কুল শাখা অনুমোদনের আগেই নবম শ্রেণীতেও শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এরপর শিক্ষার্থীদের জীবনের দোহাই দিয়ে তাদের রেজিস্ট্রেশন ও স্কুলের অনুমোদন চাওয়া হয়। নানা মহল থেকে দেন-দরবার এবং তৎকালীন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৮ মে তৎকালীন কলেজ পরিদর্শক শাখা অনুমোদনের চিঠি দেন। তাতে ১৫ জুনের মধ্যে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্নের নির্দেশ দেয়া হয়।
প্রাথমিক অনুমোদনের শর্তও লংঘন : ২০০৫ সালের ২২ জুন ঢাকা বোর্ড এ কলেজের পরিচালনার প্রাথমিক অনুমতি দেয়। প্রাথমিক অনুমোদনের ঠিকানা ছিল গুলশান ২ নম্বরে। পরের বছর ৩ জুলাই ঠিকানা পরিবর্তন করে নেয়া হয় ২৩, প্রগতি সরণি। প্রাথমিক অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী কলেজ ভবনে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। কিন্তু কলেজে ভর্তির সার্বিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয় আগের ঠিকানায়। সেখানে বিদেশে লোক পাঠানোর অফিস ও বাংলাদেশে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পরিচালনার দফতরও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এটা করা হয়েছে মূলত শিক্ষার্থীদের মাঝে এমকে বাশারের অন্য সব প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা বাড়িয়ে বাড়তি পয়সা আয়ের পথ সুগম করার জন্য। রহস্যজনক কারণে এসব ব্যাপারেও বোর্ড বা মন্ত্রণালয়ের কোনো নজরদারি নেই।
পারিবারিক কলেজ : প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই স্বামী-স্ত্রী ও দুই ভাই মিলে চালাচ্ছেন কলেজটি। ২০০৫ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রথম কমিটির সভাপতি ছিলেন বাশার। তার দুই ভাই ও স্ত্রীসহ মোট ৭ সদস্য ছিলেন। প্রথম এ কমিটিতে থাকা বাশারের বন্ধু প্রকৌশলী রাশেদ বিন সাত্তার ঘুরেফিরেই পরবর্তী বিভিন্ন কমিটির সদস্যপদ দখল করেন। বাকি দুটি সদস্যপদ নিজের বিশ্বস্ত লোকদের বসানো হতো। এভাবেই কলেজটিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে।
২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পটপরিবর্তনের পর সভাপতির পদ হারাতে হয়েছিল এমকে বাশারকে। তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (এলএ) সভাপতি করে বোর্ড কর্তৃপক্ষ কলেজের নির্বাহী কমিটি গঠন করে। তবে আগের কমিটির ৪ সদস্য ঠিকই থেকে যায়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সভাপতিকে ডেকে নিয়মিত বৈঠক করা হতো না। মূলত কলেজের আয়-ব্যয়ের হিসাব যাতে ফাঁস না হয়, সেজন্যই এই কাণ্ড ঘটানো হয় বলে জানিয়েছেন কলেজের সেই সময়কার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বশির আহমেদ ভূঁইয়া।
বাশার যা বললেন : এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ও বিএসবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লায়ন এমকে বাশার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের শাখা ও ক্যাম্পাস অনেকগুলো। কোনটার কথা বলব? শাখা বলেন আর স্থায়ী ক্যাম্পাস বলেন- সবই বৈধ। প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা অনুমোদন নেয়া হয়েছে। এরপরই তা পরিচালনা করা হচ্ছে। আর স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা থাকলেও আমরা যেতে পারিনি, এটা সত্য। তবে ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ চলছে।’

বাংলাদেশ সময়: ২৩:১৮:২৪   ৪৬৮ বার পঠিত