রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০১৪
সুখকাঁটা-আল রিআন
Home Page » সাহিত্য » সুখকাঁটা-আল রিআনপঞ্চদশ পর্ব শুরু………….মানিক পরীর শোকে এক পর্যায়ে নাওয়া খাওয়া ছাড়িয়া দিয়াছে। কাজ কর্মেও কোন মন নেই। ইচ্ছা মত ঘুরে ফিরে বেড়ায়, মাঠের সবুজ ঘাসের উপড় শুয়ে থাকে দিন রাত্রি। বাড়ী ফেরার কোন টান নাই। নাই কারো প্রতি কোন দায়িত্ব কর্তব্য। নাই কোন কিছুর শখ। নদীর পাড়েই সময় কাটে মানিকের। সে অর্ধ হাটু গাঙ্গের জলের মধ্যে ডুবিয়ে বাকী অর্ধেক শরীর গাঙ্গের কাদার উপড়ে হেলিয়ে দিয়ে বিরহের গান গায় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে “এই আকাশ, তুমি একলা ক্যান তোমার সঙ্গি কই ? নাকি আমার পরীর মত বৈদেশি পাইয়া তোমারে ভুইল্লা গেছে।”
মানিকের বাল্য বন্ধু নূরা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে মানিক কে বলল
“দোস্ত তুই এই খানে, আর আমি তোরে সারা দ্যাশ খুইজা মরতাছি। চাচী আম্মার অবস্থা ম্যালা খারাপ। তুই আমার লগে এক্ষণ বাড়ী ল।”
“কি কইলি মায়ের অবস্থা খারাপ ?”
মানিক তার মাকে খুব ভালবাসে। তাই মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে আর অপেক্ষা করতে পারে নাই। নূরার সাথে এক দৌড়ে বাড়ী এসে দেখে তার বাড়ীতে অনেক মানুষের ভীড়। ভীড় ঠেলিয়া এসে দেখতে পেল তার গর্ভধারিণী মায়ের লাশটি পড়ে আছে ঘরের মধ্যখানে। মা বলে লাশটিকে জড়িয়ে ধরে দু গালে চুমা খেয়ে বলল “মা তোর কি হইছে। ও মা তুই কতা কওনা ক্যান। মা, মা ও মা তোর পায়ে ধরি, তোর হাতে ধরি একবার আমার লগে কতা ক। আমি আর তোর অবাধ্য হমুনা। তুই যা কইবি, আমি তাই করমু। এই ঘরে তুই না থাকলে মা আমি কেমনে থাকমু।”
মানিক কোন অবস্থাতেই মেনে নিতে পারছেনা, তার মা আর এই স্বার্থপর পৃথিবীতে নাই। এই পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর। মানিকের আপন মা, সেও তার সঙ্গ ছেড়ে একা করে পরপারে চলে গেল। মানিকের এই পৃথিবীতে এখন বাঁচা আর মরা দুই সমান কথা। পাড়া প্রতিবেশীরা ও মানিকের ভাবিরা সবাই মিলে মানিককে অনেক রকম শান্তনা দিয়ে সর্মেতবানুর লাশটিকে নাওয়াইতে নিয়ে গেল।
মানিক নিজে নিজে শব্দ হীন ভাবে কেদেই চলেছে। মানিকের সাথে আর কেহ কাদেনা। এমন কি আবুল বাবুলও না।
সর্মেতবানু নানা রকম রোগে শোকে মারা গিয়াছেন। তার সবচেয়ে বড় চিন্তা ছিল মানিককে নিয়ে। তারপরও মানিককে একা রাখিয়া পরপারে পারি জমাতে হল সর্মেতবানুকে। মানিক তার মায়ের লাশটি খাটিতে শুয়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক কান্নকাটি করার পর মাকে কবরে রেখে একে বারে চুপ চাপ হয়ে গেছে। কবর দেবার পর গ্রামের মানুষজন যার যার কাজে চলে গেছে। পরীও সর্মেতবানুর মৃত্যুর খবর শুনে দেখতে এসেছিল। কিছুক্ষণ পরে পরী লাশ দেখে চলে যাবার সময় মর্জিনা তাকে বলে “পরী তুই কি কামডা ভালা করলি ?”
“কোন কামডা রে সই।”
“শ্যষ কালে মানিকের মত একটা পোলারে এই রকমের ঠকাইলি। তোর দিলে কি এ্যকটুকো রহম নাই। হেই দিন বাঁশ বাগানে তোর আর মানিকের সব কতা আমি হুনছি। মানিকের লাইগা তোর কি এ্যকটুও মায়া হয়না।”
“তুই আমার ছেরি বয়সের সই। তোর লগে আমি শ্যষ কালে কাইঝা করতে চাইনা। আমি একটু ভালা থাহি সুখে থাহি এইডা তোরা কেউ চাস্ না। আমারে তোরা হিংসা করোস, আমি জানি।”
“এমন একটা কতা তুই আমারে কইতে পারলি পরী ? তুই কেমন যেন বদলাইয়া গ্যাছোস। তুই আমাগো আগের পরী আর নাই। তয় আমি একটা কতা হলফ কইরা কইতে পারি, মানিকের মত তোরে আর কেউ ভালবাসতে পারবোনা। আর একজনরে দুঃখ দিয়া নিজে কোন দিন সুখী হওন যায়না। তুই কি শহরের মানষের লগে মিল দিয়া চলতে পারবি ? তারা তোরে চাষা ভুষার মাইয়া কইয়া কথায় কথায় খোটা দিব।”
“মর্জিনা, আমি তোর লগে আর কতা কইতে চাই না। তুই এহন যা।”
মর্জিনা এই প্রথম পরীর সাথে রাগ করিয়া পরীর সঙ্গ ছাড়িয়া চলে গেল। তারা দু’জন একে অন্যের অন্তরঙ্গ বান্ধবী ছিল।
পরী তার সিদ্ধান্তে অটল। সে বৈদেশিকেই নিকাহ্ করবে। মানিক তার জীবনে এখন কেবলি কালো অন্ধকরের মত অতীত। সত্ মায়ের সংসারে আদর স্নেহ কিছুই পায়নি পরী। অনাদর আর অবহেলার মধ্য দিয়েই মানুষ হয়েছে পরী। সত্ মায়ের সংসারে বড় হয়ে সে কেবলি স্বার্থপরতাই শিখেছে। ভালাবাসা যে কি তা পরীর জানা ছিল না। জন্মের পরই মাকে হারিয়ে সত্ মায়ের নির্যাতনে তার মধ্যে সত্যিকারের ভালবাসা জন্মাতে পারে নাই। এই জন্যই শেষ কালে একটু সুখের জন্য ভালবাসার গলায় ছুড়ি চালিয়ে পরদেশে পাড়ি জমাতে চায় পরী। এই তো মানুষের জীবন।
মানুষের গড় আয়ু পঞ্চাশ বছর হলে মানিকের অর্ধ বছরে এসেই তার সব আপন জনদের একে একে হারাতে হল। মানিকের যখন সব ছিল তখন ছিলনা কেবল জায়গা জমি আর এখন বিশাল জমি জমা থাকলেও নাই সম্পত্তি ভোগ করিবার মত মানুষ। তবে কি দরকার ছিল এই সয় সম্পত্তির। মানিকের জীবনে প্রথম যে নারীকে মন দিয়েছে সে নারী যতই ছলনা করুক না কেন মানিক তাকে কোন দিনই ভুলতে পারবে না। আর ভুলে যাওয়া সম্ভবও না। মানিকের হয়তো আর কোন দিন সংসার করা হইবেনা এই স্বার্থপর পৃথিবীর কোন মানুষের সাথে। যে সম্পদ মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে সে সম্পদ না থাকাই শ্রেয় বলে মনে করে মানিক। এই পিংড়ী গ্রামের বাতাশ স্বার্থপরতায় ভরে উঠেছে। মানিক তার মাকে হারানোর পর থেকেই এই গ্রামের উপর থেকে তার মন উঠে গেছে। তবুও পরীর নিকা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবে। মানিকের মনের ধারনা শেষ সময়েও যদি পরীর ভুল ভেঙ্গে ফিরে আসে তবে মানিক তাকে অতি সহজেই মানিয়া লইবে। কারণ পরীকে মানিক এখনও ভালবাসে তাই পরীর সকল অপরাধ ক্ষমার যোগ্য।
মানিকের মা মারা গেছে আজ দুদিন হল। মানিক এই দুই দিনের মধ্যে মাত্র এক বেলা আহার করেছে তার ভাইদের বাড়ী। আজ সারাদিনে কোন দানা পানি পরেনি মানিকের পেটে। ঘড়ে চাল ডালও কিছু নাই যে কেহ রান্না করে দিবে। মানিক তার মায়ের কবরের পাশে শুয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ থেমে থেমে মায়ের কবরকে বলে “মা তুমি ক্যামনে পারলা আমারে একলা রাইখা যাইতে। আইজ দুই দিন ধইরা না খাইয়া রইছি। মা আমার প্যাডে ক্ষিদা আর মানতাছে না। তুমি নাই, কেডা আমারে রাইন্দা দিব, কও মা। মা ও মা, তুমি হুনছ আইজ পরীর গায় হলুদ হইতাছে। কত্ত মানু ওগো বাড়ী। গরুর গোস্ত রানতাছে। কত মানষে মিন্দি বাটতাছে। তুমি হুন না মা পরীর বাড়ীতে নিকার গান বাজতাছে। মা তুমিও তো দুই দিন ধইরা দানা পানি কিছুই খাও নাই। তোমার কি খিদা লাগেনাই ? তুমি যদি না খাইয়া থাকতে পারো আমিও পারমু মা।”
মানিক ক্লান্ত শরীরে কথা বলতে বলতে মায়ের কবরের পাশেই ঘুমিয়ে গেছে। দুপুর বেলা পরীদের বাড়ীতে কত না আয়োজন। গান বাজনা আনন্দ ফূর্তির তো কোন অভাব নেই। পরীদের বাড়ীর উঠানে পানি ঢেলে কাদা তৈরী করে গ্রামের মহিলারা মেয়েরা নাচা নাচি করে আর একে অন্যের গায়ে কাদা মেখে উৎসব করে। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের বিবাহে এই রকমের কাদা মেখে গান বাজনা করেই হয়।
আজ পরীর গায়ে হলুদ। কাল বিবাহ হবে। পরী চলে যাবে সেই সুদূর অচিন শহরে। যেখানে তার স্বামী ছাড়া আর কেহ আপন নাই। সুখ দুঃখে একমাত্র সাথী হবে শুভ আহম্মেদ। কদম আলী তার একমাত্র মেয়ের বিবাহ উপলক্ষ্যে গ্রামসুদ্দো মানুষকে দাওয়াত করেছে। শুভর বাবা মায়ের এ বিয়েতে মত আছে কিনা তা না জেনেই পরীর বাবা মা এ বিয়েতে মত দিয়েছে। ছেলে ভাল, লাখে একটাও মিলবে কিনা তাই নিয়ে সন্ধেহ আছে পরীর বাবা মায়ের। দু চার গ্রাম খোঁজ করিলে হয়তো একটা শিক্ষিত ছেলে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার ছেলে পাওয়া যাইবে না। এই রকমের একটা চিন্তা ভাবনা করেই পরীর পিতামাতা সুদূর ঢাকার শহরে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। দুপুরের মধ্যে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হবার পর শুভ আর পরী জীবনের শেষ অবিবাহিত দিনটি উপভোগ করার জন্য নদীর ঘাটে গিয়ে হালকা মৃদু বাতাশে একে অন্যের হাত ধরে বসে আছে। পরীর কাছে কেবলি মনে হচ্ছে আজকের এত মধুর বিকালটি খুব তারাতারি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই সে শুভকে বলছে “আইজ আমাগো আবিয়াত জীবনের শ্যাষ বিয়াল, তাই না বৈদেশি। কাইল বিয়ালের এমন সোমায় আমরা দুই জন দুই জনার কত আপন হইয়া যামু। তুমি হইবা আমার সোয়ামি, আমি হইমু তোমার বউ।”
“আচ্ছা পরী, তুমি কি বিয়ের পরেও আমাকে বৈদেশি বলেই ডাকবে না কি আমার নাম ধরে ডাকবে ?”
জিব্বার মাথায় কামর কেটে পরী বলল “সোয়ামির নাম ধইরা ডাকলে পাপ হয়। আমি তোমারে নিকার পর ওগো হ্যাগো কইয়া ডাকমু। তার পরে যহন আমাগো পোলা পান অইব তহন আমি তোমারে গ্যাদার বাপ কইয়া ডাকমু। ঠিক আছে।”
পরী শুভর সাথে রঙ্গ করে কথা বলে হেসে দিল। তাদের রোমাঞ্চকর রং ঢং, দুষ্ট বৃষ্টির আর সহ্য হলনা। শুভ পরীর ঐ মুহূর্তগুলো শেষ হতে না হতেই গুড়া গুড়া বৃষ্টি আরম্ভ হল। তখন শুভ পরীকে বলে “পরী বৃষ্টি পড়ছে। চল বাড়ীতে যাই।”
“হ তুমি ঠিকই কইছ। দ্যাহো দ্যাহো বৈদেশি আকাশের অবস্থা কি। ম্যাঘে ক্যামন আন্দার হইয়া গ্যাছে। মনে হইতাছে বড় একটা তুফান ছুটব।”
এই বলে বাড়ীর দিকে রওহনা দিতে তারা দু’জন কয়েক কদম হাটা মাত্রই প্রচন্ড বেগে বাতাশ ছুটল। এত জোড়ে বাতাশ বইছে, যেন তাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে কোন এক কাল বৈশাখীর রাজ্যে। বাতাশের জন্য চারিদিকে ঘোলাটে অন্ধকার হয়ে গেছে। ধূলাবালি খড় কূটার অশং বাতাশে মিশে একাকার হয়ে গেছে। ঘর ছাড়া কোথাও দাঁড়ানোর কোন অবস্থা নাই। বহু কষ্টে শুভ আর পরী তাদের বাড়ীতে ফিরল। বাড়ীর আশে পাশের বড় বড় গাছের ডালগুলকে ভেঙে চুড়ে নিয়ে যাচ্ছে কাল বৈশাখী ঝড়। মানিক এতক্ষণ মায়ের কবরের পাশেই ঘুমানো ছিল। প্রবল বাতাশ তাকে জাগিয়ে দিল। মায়ের কবরের পাশ থেকে উঠে বাড়ী আসার পথে অতি ক্ষুদায় ক্লান্ত হয়ে মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গিয়ে একাট একশ বছরের বুড়ো বট গাছের নীচে আশ্রয় নিল। ঝড় বাতাশের দিকে মানিকের কোন খেয়াল নেই। বাতাশের সাথে যখন শিলা বৃষ্টি আরম্ভ হল তখন মানিক বুঝল বৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষুদার যন্ত্রনায় দু হাতের কোষ পেতে, বৃষ্টি পানি জমিয়ে পান করার পর মানিক চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকালো। এভাবেই তিন চার ঘন্টা এক টানা শিলা বৃষ্টি পড়ল। কৃষকের ক্ষেতের সব ধানগুলো শিলার আঘাতে মাটিতে নুয়ে পড়েছে। এত বড় ক্ষতি কৃষকেরা কিভাবে পোষাবে তাই নিয়ে কৃষকদের মহাচিন্তা। রাত বাড়ছে শিলা বৃষ্টিও বাড়ছে। মধ্য রাতে আরম্ভ হল মহা প্লাবন। বাতাশের ঝাপটায় ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে। ছোট ছোট ঘরগুলো ধুমরে মুছরে নিমিষেই শেষ করে দিল কাল বৈশাখী ঝড়ে। বড় বড় গাছগুলোও রক্ষা পায়নি সেই ঝড়ের হাত থেকে। গোড়া থেকে উপড়ে এসে পড়ছে ঘরের চালে। গ্রামের মানুষের চিৎকার আর্তনাতে ভরে গেছে পুর এলাকা। মেঘের গর্জনে মানুষ আতঙ্কিত। বৃষ্টির ঝাপটা ঘরের সব আসবাপত্র ভিজিয়ে নাশ করে দিচ্ছে। কোন কোন ঘরের চাল বেড়া হাত দিয়ে টেনেও রাখতে পারছেনা। হঠাৎ নদীর মধ্য হতে পানি ফুলিয়া উঠে এক প্রান্ত হতে প্রবল একটি ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গেল অন্য আর এক প্রান্তে। পানির সেই প্রবল ধাক্কাটি অন্তত বিশ বাইশ ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ঝড়ের সময়ও যারা একই ঘরে বসে কান্নাকাটি চিৎকার চেচামেচি করেছিল, পানির সেই প্রবল ধাক্কার পরে কেহ কারো খবর জানেনা। কে বাঁচিয়া আছে আর কে মরিয়া গেছে তা সঠিক করে বলা দুস্কর। এত বড় ঝড় বিগত ৪০ বছরেও হয়নি। ঘর বাড়ী ক্ষেত খামার সব এখন পানির নীচে তলানো। নদীর মধ্য থেকে উঠে আসা পানির ঢেউটি, অনেক মানুষকেই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। রাত শেষ না হলেও ঝড়ের তান্ডব কিছুটা কমেছে। বৃষ্টি থাকলেও বাতাশ কমে গেছে একে বারে। চারিদিকে প্রায় শান্ত হয়ে এসেছে। তবে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে আছে পুরো গ্রাম। এত পানি উঠেছে যে কোন ঘরের চাল পর্যন্ত দেখা যায় না। কিছুক্ষণ পর সেই মহা ভয়ংকর রাতের অবসান ঘটে ভোরের আলো ফুটিল।
বেলা হবার পর, কিছু কিছু মানুষ যারা প্রাণে বাঁচিয়া ছিল তার সাতার কাটিয়া গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে উচু টিলার উপড়ে আশ্রয় নিল। উচু টিলার উপরে যে বট বৃক্ষ আছে মানিক সারারাত ওখানেই ছিল। যারা যারা টিলার উপড়ে আশ্রয় নিয়েছে তারা বেঁচেও না বাঁচার মত। আপন জনদের কোন খোঁজ খবর নাই। কারো ছেলে নাই কারো মা নাই কারো নাতি নাই এমনি স্বজন হারানোর আহাজারি সবাই মধ্যে। বহু মানুষ নিখোঁজ এবং পানিতে অনেক মানুষের লাশ ভাসতেছে। অনেকের লাশের মধ্যে পারুলের লাশটি সবার আগে খুঁজে পাওয়া গেল। একে একে করে বলরাম, শিউলি, হামিদ শিকদার, গনেশ সহ অনেকের লাশ খুঁজে পাওয়া গেল। ঝড়ের মধ্যেও কদম আলী ঘরের মধ্যেই ছিল কিন্তু নদীর স্রোতে সময় সে যে কোথায়, স্রোতের সঙ্গে ভেসে গেছে তা বলা মুশকিল। সে বেঁচেও থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। পরী শুভ খুবই আহত হয়েছে। তারাও তার মায়ের সঙ্গে উঁচু টিলার উপরে আশ্রয় নিয়েছে। এক রাতের ঝড়ে কেড়ে নিল এ গ্রামের প্রায় শ খানেক লোকের প্রাণ। বাবুল তার স্ত্রীর লাশ টি পানির মধ্য থেকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে কেদে কেদে বলছে “বউ, বউগো এমন সোমায় মরলি যে তোর কফালে একটুকরা মাডিও জুটলনা। তোর ক্যাননে আমি কয়বোর দিমু।”
জলমিয়া বাবুলের গায়ে হাত দিয়ে বলল “বাই আল্লার মাল আল্লায় নিছে। আমাগো কি করনের আছে কন। কত্ত বড় একটা তুফানের মধ্যেও আমরা বাইচ্চা আছি হেইডা আল্লার দারে ম্যালা শুকুর।”
এই ঝড়ে শেষ হয়ে গেছে কৃষকদের লক্ষ লক্ষ টাকার ফসল। শেষ হয়ে গেছে তাদের গোলার জমানো সব খাদ্য শস্য। কি করে তারা নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখবে, তাদের চোখে যে ঘুম নেই। অনেকে কেদে কেদে বলে “আল্লা আমাগো ক্যান তুমি বাচাইয়া রাখলা। বানের লগে আমাগোও বাসাইয়া নিয়া যাইতা। খাওন নাই পানি নাই এই বাঁচোনের কি দরকার।”
গ্রামের যত গবাদি পালিত পশু ছিল তা একটাও আর বেঁচে নাই। শত শত গরু মহিষ কুকুড় বিড়াল এমনকি পাখিগুলোর মৃতদেহ পানিতে ভাসতেছে। মানিকের মত সবারই এখন না খেয়ে উপোস করতে হবে।
এক দু দিন পরে এই খবর শহরে জানাজানি হলে শহর থেকে সেনা বাহিনীরা সর্বপ্রথম ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে পিংড়ী গ্রামে উপস্থিত হয়। সেনা বাহিনীরা কৃষকদের সহ সাধারণ মানুষদের নানা ভাবে সাহায্য করেছে। ঔষধ, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও অন্যান্য সেবা করে তাদেরকে সর্ব ভাবে সহযোগিতা করে। পাঁচ সাত দিনের মধ্যেই বন্যার পানি টানতে আরম্ভ করে। তবে ঘরের চারপাশে উঠানের মধ্যেও হাটু সমান পানি আছে। মানুষজন ঘরের মধ্যে একটু মাথা গুজিবার ঠাঁই পেয়েছে। এই কাল বৈশাখীর রাক্ষুসে ঝড়ে কেড়ে নিয়েছে অনেক মানুষের প্রাণ। আপনজন হারানোর ব্যথা অনেকেই ভুলতে পারে নাই। দুঃখে তাদের বুকের মধ্য খানে ফেটে যায়। কিন্তু আপনজন হারিয়ে খুব খুশি হয়েছেন কেবলি একজন মনসী। তিনি হলেন এই গল্পের চান্দু হুজুর। ঝড়ের রাতে গুরুতর আহত হয়ে পরের দিন মারা গেল চান্দুর স্ত্রী শিউলি। স্ত্রীকে হারিয়ে সে খুব খুশি। পারলে গ্রামের মানুষকে মিলাদ দিয়ে খাওয়ায়। তার এত দিনের আশা আজ পূর্ণ হতে চলেছে। রাত নিঝুম হতে না হতেই চান্দু হুজুর সেজে গুজে তৈরী হচ্ছে। তার দাড়িতে সরিষার তেল দিয়ে চিরুনি দিয়ে ভাল করে আশ্রিয়ে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন গান গেয়ে নিজের মনের মধ্যে একটা ভাব তুলছে সে। গ্রামের এই অবস্থা। কেহ কারো দিকে কোন খেয়াল রাখেনা। যার চিন্তায় সে ব্যস্ত। এই সুযোগে চান্দু কলা গাছের ভেলা করে কইতুরীদের বাড়ীতে রওহনা দিল। কইতুরীর জন্য তার প্রেম আজ উতালা হয়ে উঠেছে। আধা ভিজা কাপড় নিয়ে কইতুরীদের দরজার সামনে ছোট গলায় কইতুরী বলে কয়েকবার শব্দ করল। কইতুরী জানেনা কে তাকে এমন গোপন গলায় ডাকছে। সন্ধ্যা বেলায় সে ঘরে একা একা বসে আছে। অজানা পুরুষ কন্ঠের ডাক শুনে তার বেশ সন্দেহ হল। সে তার ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে কুপির আলোতে উঁকি দিয়ে দেখল কে তাকে এমন করে কু ভাবে ডাকছে। চান্দু হুজুরের চেহারা দেখা মাত্র সে বুঝতে পারল, তার অনেক সাবধাণ হইতে হইবে। এই আঁধারের রাতে চান্দু কোন বদ মতলব ছাড়া আসে নাই। কে জানে তার মনে কি মতলব রহিয়াছে। কইতুরী দরজা খোলার আগে খেজুর গাছ কাটা ধাঁড়ালো দাঁটি তার কাপড়ের আঁচলের তলে লুকিয়ে নিল। দরজা খোলা মাত্র চান্দু একখানা হাসি দিয়ে বলল “কি গো কইতুরী, ক্যামন আছে ? তোমারে একটা সু-খবর দেওয়ার লাইগা আমি সাত উঠান তের বাড়ী পার হইয়া আইলাম।”
“কি সুখবর। আমার সোয়ামি হাজত দিয়া ছাড়া পাইছে।”
“আরে না কইতুরী। আমার বউ আইজ ব্যানে ফজোরের আগে আগে মইরা গ্যাছে। আমি আবার আবিয়াইত্তা হইয়া গেছি। নয়া একখান নিকা করলে কেউ আমারে কিছুই কইতে পারবনা।”
দু হাত দিয়ে লুঙ্গির মধ্যেখান থেকে টানিয়া নাচিয়া নাচিয়া বলে “আমি বনো ফুল গো আমি বনো ফুল। তোমার কষ্ট আমি আর সইতে পারি নাগো কইতুরী।”
“আমার কষ্ট আফনার মত মানষের সইতে অইবনা। আমার সোয়ামি আছে।”
“তোমার সোয়ামি কোন দিনই জেল হাজত দিয়া ফিইরা আইবনা। আমি তোমার বাজানরে মারাইছি। তোমার ভাতাররে পুলিশ দিয়া ধরাই ছি। খালি একটা কারণে, আমি তোমারে নিকা করতে চাই। এই শখ আমার ম্যালা দিনের। তুমি রাজি হইয়া যাও। তোমারও কেই নাই আমারও কেউ নাই, আমরা দুই জনে মিইল্লা নয়া সংসার পাতি লও।”
“কি কইলা ? আবার কও তো ? আমার বাজানরে তুমি মার্ডার করছ। খালি আমারে পাওনের লাই¹া। আমার সোয়ামিরে হাজতে পাঠাইছো খালি আমারে পাওনের লাই¹া। আমি কাইল ব্যানে গেরামের ব্যবাক মানষেরে কইয়া দিমু। আমার বাজানের খুনী আমার সোয়ামী না, চান্দু।”
“সেই সুযোগ আমি তোমারে আর দিমু না কইতুরী। আইজ রাইতেই আমি …….।”
চান্দু তার পুরো কথা শেষ করার আগেই, কইতুরী তার আঁচলের তলা থেকে গাছ কাটা দাঁ বের করে দু হাত জাগিয়ে চান্দুর গলায় এক কোপ বসিয়ে দিল। চান্দুর শূন্য মাথাটি দেহ থেকে ছিটকে চলে গেল উঠানের মধ্য খানে পানির মধ্যে, আর দেহটিও ঢলে পরে গেল কইতুরীদের দরজার সামনে থেকে পানির মধ্যে। মানুষ খুন করার মত জঘন্য কাজটি করে কইতুরী নিজের ভারসম্য হারিয়ে ফেলল। সে পাগল হয়ে চিৎকার চেচামেচি করছে।
পিংড়ী গ্রামে নতুন করে আবার একটা খুন হবার কথা শুনে গঞ্জ থেকে ট্রলারে পুলিশ এসেছে। সকাল হতে না হতেই চান্দু হুজুরের লাশটি সারা রাত পানিতে থেকে পঁচে একে বারে দূগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। কইতুরী এখন ভারসম্যহীন পাগল। সে নিজের মুখে স্বীকার করেছে, সে নিজের হাতে চান্দু হুজুরকে খুন করেছে। এই অপরাধে পুলিশ তাকে কোমরে রশি বেধে নিয়ে থানা হাজতে নিয়ে গেল। কপালে সুখ না থাকলে কেহ সুখী হতে পারেনা। কইতুরী তার বাস্তব প্রমান। কইতুরী আর কোন দিন সুস্থ হয়ে এই পিংড়ী গ্রামে আসতে পারবে কিনা তা আমাদের কারোরই জানা নাই।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:১১:১৪ ৫৬৬ বার পঠিত