বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০১৪
সুখকাঁটা-আল রিআন
Home Page » সাহিত্য » সুখকাঁটা-আল রিআনত্রয়োদশ পর্ব শুরু…….
আজ পহেলা বৈশাখ।
ফাল্গুন চৈত্র মাসের কোকিলের কন্ঠে মধুর সুর আর শোনা যাবে না। বৈশাখ মাস আসা মাত্রই মানুষ জন কোকিলের সুর ভুলে গিয়ে নানা রকম উৎসবে মাতিয়া উঠেছে। আজ পহেলা বৈশাখে মেলার পাশাপাশি অনেক জাকজমক ভাবে পালন হবে হাল খাতার উৎসব। কেবল দোকানী ব্যাবসায়ীরা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনা না, সুদ ব্যাবসায়ীরাও হাল খাতার অনুষ্ঠান পালন করে। গাঁয়ের মহাজনরা সকাল থেকেই তার নিজের বাড়ীতে বা গদিতে একটি প্লেটে পান সুপাড়ি সাজিয়ে বসে আছেন। পাওনা দাররা অর্থাৎ যারা অতি অভাবে পরে টাকা সুদে কর্য করেছিল তারা যে পারছে মহাজনকে জমা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই মহাজন এক একটি জিলাপির ঠোংগা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। এই হাল খাতার উৎসব গ্রামের একটি পুরানো ঐতিহ্য। বহু কাল ধরে এমন ভাবেই এ উৎসব চলে আসছে। অনেক দরিদ্র কৃষক কূল কিনাড়া না পেয়ে কড়া সুদে টাকা এসে সংসার চালায়। কিন্তু পহেলা বৈশাখে এ টাকা শোধ দিতে না পারলে আর রক্ষে নাই। মহাজনরা দলবল নিয়ে ভিটা বাড়ী, জমি জিরাত তাদের পাওনা টাকানুযায়ী দখল করে। কদম আলী মাতবর এভাবেই গ্রামের অনেক কৃষককে সুদে টাকা দিয়ে আজ অনেক জমাজমির মালিক হয়েছে।
গ্রামের মধ্যে মাঠে অনেক বড় মেলা বসেছে। বাচ্চা বুড়ো সবাই মেলার মধ্যে। বড়রা সবাই তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বিভিন্ন রকমের দোকানে ঘুরে ঘুরে পছন্দে জিনিস কিনছে। বিবাহিত ও অবিবাহিত নারীরা মেলার এক কোনে ভীড় জমিয়েছে। যে কোনে মহিলাদের সাজসজ্জা পাওয়া যায়। গাঁেয়র পুরুষদের কথা আবার আলাদা, তারা মেলার জুয়ার দোকানের সামনে থাকে। মানিক জুয়া খেলায় বেশ পটু। সে ঘোড়ার ছবিতে মাত্র দুই টাকা দিয়ে লটারি ধরে জুয়ার চরকি ঘুড়াতে না ঘুড়াতে ১০ টাকা পেয়েছে। এই অর্থকে পুঁজি করে সে ঘন্টা খানেক জুয়ার আসরে জুয়া খেলায় মত্ত ছিল। আজ তার ভাগ্য এতই ভাল যে এই ঘন্টা খানিক জুয়াখেলার মধ্যে একবারও সে পুঁজি হারায় নি। দুই টাকা দিয়ে শ খানিকের মত অর্থ জমা করে জুয়ার আসর ত্যাগ করল। মানিক সখে নয় ইচ্ছা করে জুয়া খেলেছে। পকেটে তার দুই টাকাই সম্বল ছিল। ওদিকে মানিকের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার কাছে বায়না ধরেছে, মেলার দিনে লাল চুড়ি, ফিতা, আলতা কিনে দিতে হবে। অনেক দিক ভেবে চিন্তে সে জুয়ার আসরে গিয়ে জুয়া খেলেছে। এরপর পরীর জন্য লাল চুড়ি, ফিতা ও আলতা কিনে মেলার মধ্যে পরীকে খুঁজে বেড়াইতেছে। পরী মানিককে মেলার মধ্যে দেখতে পেয়ে মানিকের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। মানিকের সাথে এই মেলার মধ্যে দেখা না হোক তাই চাচ্ছে পরী। কারণ পরীর সাথে আছে ইঞ্জিনিয়ার শুভ আহম্মেদ। শুভ আহম্মেদের সাথে বেড়িয়ে পরী অনেক আনন্দ পাচ্ছে। কারণ পরী না চাইতেই শুভ আহম্মেদ অনেক সাজ সজ্জা কিনে দিয়েছে তাকে। পরী, শুভকে বলে “আফনে কি ম্যালা বড়লোক।”
“কেন পরী ? হঠাৎ এ প্রশ্ন।”
“না। আফনের পকেটে ম্যালাগুন ট্যাকা দ্যাখলাম তো, তাই।”
“কেন ? তোমার কি আর কিছু চাই ? তবে একবার বল আমি গোটা মেলাটি কিনে তোমার ঐ সুন্দর দু খানা পায়ের সামনে লুটিয়ে দেই।”
পরী সুন্দর একটা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল “না গো বৈদেশি আমার আর কিছু লাগবোনা।”
“কিন্তু আমার তো কিছু চাই, পরী ।”
“আমি আফনারে এমন কি দিতে পারমু। আমার দারে এমন দামি কিছু নাই।”
“তোমার কাছে দামি কিছু একটা আছে। যদি তুমি সার্থপর না হও তবে আমাকে তা দিবে।”
“আফনেই কন। আমার দারে এমন দামি কি আছে আমি নিজেও জানি না। তয় কতা দিতাছি থাকলে আমি আফনারে দিমু।”
“পরী। তার আগে আমাকে একটা কথা বলুন তো।”
“কি কতা কন।”
“তুমি কি কাউকে পছন্দ কর। মানে কাউকে তোমার ঐ সুন্দর মনটির ভাগ দিয়েছ।”
কিছুক্ষণ পর মুখ ভার করে পরী মাথা নাড়িয়ে না উত্তর করল।
পরীর মনের মানুষ মানিক থাকলেও সে শুভর সামনে তা প্রকাশ করে তার পক্ষ নষ্ট করতে চায়নি। কেন যে চায়নি তা পরীই ভাল জানে। সে কোন সুবিধার কথা বিবেচনা করে শুভর সামনে মানিকের ব্যপারটি না বলল।
শুভ পরীর দু নয়নের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল “আমি যদি তোমার মনের মানুষ হতে চাই, তুমি কি আমাকে না বলে ফিরিয়ে দিবে।”
“কি কন বৈদেশি ? আফনেরে ভালবাসোনের কেউ নাই। আফনে এহনও নিকা করেন নাই।”
“না। সবে মাত্র লেখাপড়া শেষ করে চাকরীতে জয়েন্ট করলাম। বিয়ে করার সময় কোথায়। আর তাছাড়া শহরের মেয়েগুলো সুন্দর হলেও তোমার মত এত সুন্দরী নয় তো বটেই, তোমার মত এত গুনবতীও নয়। পল্লীর এই রুপের কাছে শহরের সকল সৌর্ন্দয্য হার মানবেই। এই কয়েক দিনের পরিচয়ে তোমাকে আমি আমি যতই দেখি ততই অবাক হয়ে যাই। মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে।”
পরী নিরবে ভাবিয়া দেখিল, মানিকের তুলনায় ইঞ্জিনিয়ার শুভ আহম্মেদ অনেক বেশি ধনী, তাছাড়া দেখতেও অনেক সুন্দর। বলতে গেলে তাকেই সু পুরুষ বলা যায়। তার মত একজন সু দর্শন পুরুষ মানুষের সংসার করিতে পারাও বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। মানিকের মত চাষার সংসার করিলে সে দু পয়সার অর্থহীন ভালবাসা ছাড়া আর কি দিতে পারবে ? শুভ এক ফোটা ভালবাসা না দিলেও, শত টাকার সাজ সজ্জা কিনে সে ভালবাসার ক্ষতি পূরণ দিতে পারবে তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই। নারী হয়ে যখন দুনিয়ায় এসেছি, তখন কোন না কোন পুরুষের সংসার তো করতেই হবে। তবে সেটা কেন এক গরিব কৃষকের। যার নূন আনতে পানতা ফুড়ায়। মানিক এক সৎ, সাহসী যুবক বটে। তার মনে কোন পাপ নাই এটিও সত্য। কিন্তু …….। আমি এখন কি করব ? মানিকের মত একটা সাদা মাঠা ছেলের সাথে প্রতারনা করব। নাকি আমার সুখের কথা ভাবব।
শুভ পরীকে বলল “এত মনযোগ দিয়ে কি ভাবছ তুমি ?”
“না। কিছু না।”
“তুমিই আমার জীবনে প্রথম ভালবাসার নারী। কোন কারণে আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি অনেক কষ্ট পাব।”
“আমারে কইয়া লাভ কি এসব কতা। আফনে আমারে পছন্দ করলে আমার বাপমায়ের দারে গিয়া কন।”
“ঠিক আছে আমি আজই তোমার বাবামাকে আমার মনের কথা জানাব।”
মানিক অনেকক্ষণ খোঁজা খুঁজি করার পর মেলার এক পাশে পরীকে দেখতে পেয়ে আলতো একটা হাসি দিয়ে পরীর পানে ছুটে এসে বলল “তুমি মোনে হয় আকাশের চান অইয়া গ্যাছো। তোমারে খুইজ্জা পাইতে আমার কি যে কষ্ট অইছে তুমি জানোনা। এই লও তোমার পছন্দের আলতা চুড়ি ফিতা। ও আল্লা তুমিও দেহি লাল চুড়ি ফিতা কিনছ।”
“তুমি কি চাও ? যাও এহন। পরে আইও।”
“পরী তোমার কি মন খারাপ। নাইলে তোমার চেহারা এত খারাপ দ্যাখায় ক্যান। আমি তোমার জন্নি রহিম রুপবান যাত্রার টিকিট আনছি। লও আর একটু পরেই যাত্রাপালা আরাম্ভ হইবে। রহিম রুপবানের যাত্রাপালা দ্যখলে তোমার মোন ভালা অইয়া যাইব।”
পরী মানিকের কথায় কেবলি রাগ হচ্ছে। কারণ শুভ তাদের পাশে দাঁড়ানো। কোন কিছু জানতে পারলে সে হয়তো পরীকে আর নিকাই করিবেনা। শুভকে বুঝানোর জন্য পরী মানিক কে ভরা মেলার মধ্যে কষে একটা চড় মারল। মানিক হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। মানিকের দেওয়া আলতা চুড়ি সব নিয়ে পরী সোজা নিজের বাড়ীর দিকে চলে গেল। এরপর শুভও মানিকের গা ঘেষে পরীর পিছন পিছন চলে গেল। মানিকের দুঃখ মানিক কাউকে বলতে পারেনা। তার বুকের মধ্যে অনেক কষ্ট চাপিয়া রেখেছে সে।
সন্ধ্যা হতে আর বেশি বাকী নাই। ইতিমধ্যে মেলার মাঠটি বিভিন্ন গ্রামের মানুষ এসে ভরে গেছে। কারণ সন্ধ্যার পর পরই আরাম্ভ হবে গ্রামবাসীদের প্রিয় যাত্রাপালার অনুষ্ঠান রহিম রুপবান। মানিক অনেক কষ্টের টাকা দিয়ে দুটো টিকিট খড়িদ করে ছিল কেবলি পরীর জন্য। পরী বিনোদনের মধ্যে কেবলি যাত্রাপালা পছন্দ করে। যে যাত্রাপালা পরী দেখবে না সে যাত্রাপালা মানিক কি করে দেখবে। মানিক মন ভার করে নিজের বাড়ী গিয়ে শুয়ে রইল।
সন্ধ্যা হতে মানিকের মত বিশাল আকাশটাও ভার হয়ে আছে। মধ্য রাত হতে না হতেই তুমুল বৃষ্টি নামিল। টিনের চালে সে বৃষ্টির শব্দ অনুমান করা যাইতেছে। অনেক কৃষক তার ঘড়ের কথা না ভাবিয়া তার ক্ষেতের কথা ভাবিয়া ঘুম হতে জাগিয়া উঠিলেন। ধান পাকিতে এখনও মাস খানিক সময় লাগবে বৈ কি। তার আগেই যদি ক্ষেতে পানি উঠিয়া ফসল তলিয়ে যায় তবে তা কৃষকদের জন্য গজব ছাড়া আর কোন সু সংবাদ নয়। গ্রামের বহু কৃষকদের ঘড় গোল পাতা কিংবা ছন দিয়ে তৈরী। বৃষ্টির সময় তাদের আর কষ্টের সীমা থাকেনা। দুই তিন বছর পার হয়ে গেলেও কৃষকেরা তাদের ঘড়ের ছন পরিবর্তন করে না। যার ফলে বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টির পানি ছনের ফাঁকে জমে ছনের চাল পঁচে ফাঁকা হয়ে যায়। জোড়ে বৃষ্টি নামলে উঠানের মত ঘড়ের মধ্যেও বৃষ্টির জল সমান তালে পড়ে ঘড়ের মেঝে ভিজে ফুলিয়া উঠে। গতকাল রাতের বৃষ্টিতে গ্রামের অনেক ঘড়ের ক্ষতি হয়েছে। বাড়ীর মহিলারা সকাল হতেই কাদা মাটির সাথে গোবর মিশেয়ে ঘড়ের মেঝে পিঁড়া লিপছে। আর বাড়ীর পুরুষেরা এবাড়ী ও বাড়ী ছন, গোলপাতা খুঁজিতে বের হইয়া গেছে। তবে কেহ কারো জমানো খড় বা ছন দিতে চায়না। মানিকের ঘড়ের একই অবস্থা। সেও কারো কাছে ছন খড় না পাইয়া ঘড়ের চালের উপর পলিথিন বিছিয়ে দিল। আবুল-বাবুল টিনের তৈরী ঘড়ে থেকেও গত রাতের বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পায়নি। কারণ চালের টিন গুলো ছিল পুরানো ও অনেক ছিদ্র যুক্ত। বৃষ্টির সময় তারা ঘড়ের মেঝেতে হাড়ি পাতিয়া রাখে। যেন বৃষ্টির পানি পরে ঘড়ের মেঝে ভিজে না যায়।
এই বৈশাখ মাসে কেবল বৃষ্টি নয়, মাঝে মধ্য ভয়ংকর ঝড় হয় যা কাল বৈশাখী নামে পরিচিত।
কিছু কিছু দুঃখে, কষ্টে মানুষের মনের মধ্যেও তুমুল ঝড় উঠে যা কাল বৈশাখীর ঝড়কেও হার মানায়। গতকাল বিকাল থেকেই মানিকের মনের মধ্যে এক তুমুল ঝড় বয়ে চলেছে। এমন কি হল যে পরী আমাকে চড় মারলো। আমার কি কোন কাজে ভুল হইছিল। মানিক নিজেকে নিজে অনেক প্রশ্ন করে কোন উত্তর পাচ্ছেনা। হঠাৎ করে পরীর সই মর্জিনা মানিকদের বাড়ীতে এসে খবর জানায় পরী বাঁশ বাগানে মানিকের জন্য অপেক্ষা করছে।
“তুমি হাছা কইতাছো বইন। পরী আমার লাইগা বাঁশ বাগানে আইছে। তুমি যাও। আমি ওক্ষণ আইতাছি।”
মানিক বিন্দুমাত্র আর অপেক্ষা না করে বাঁশ বাগানের দিকে ছুটে গেল। গিয়ে দেখে পরী তার জন্য একটি খেজুর গাছের মরা খন্ডের উপর বসে আছে। ক্ষুদার্থ কোন ব্যাক্তি খাবার পেলে যেমন অস্থির হয়ে খাবার গুলো নিয়ে খেতে আরম্ভ করে ঠিক তেমনি মানিক তার মনের মানুষকে দেখে তার কাছে গিয়ে অনেক কষ্ট নিয়ে বলল “পরী তুমি ক্যামন আছো। তোমার চেহারা দিন দিন খারাপ অইয়া যাইতাছে। নিশ্চই তুমি আমারে নিয়া ম্যালা চিন্তা করছ। বিশ্বাস করো আল্লার কিরা কইরা কইতাছি, এই এই আমি তোমার মাতা ছুইয়া কইতাছি, আমি তোমার লগে এক বিন্দুও রাগ অইনাই। তুমি ইচ্ছা করলে আমারে আরো চড়, থাপ্পর, কিল মারতে পারো। কিন্তু তারপরও তুমি আমার লগে আগের মত হাইসা একটু কতা কও।”
যত দূরে তুমি যে খানে থাকো
তবুও তুমি আছো আমার হৃদয় মাঝে।
আড়াল হতে যাও যত দূরে
পাবে খুঁজে আমায় সেথায়, তোমার সকল কাজে।
যতই কর তুমি ঘৃণা আমায়
আমি থাকব তোমার আত্বার সাথে মিশে
এ জীবন কাটিয়ে দেব
কেবলি তোমায় ভালবেসে ॥
আমি যে তোমার প্রেম পূজারি
তোমার প্রেম হীনা কেমনে বাঁচি
ভাল না বেসে যতই দেবে দূরে ঠেলে
আমি তবুও থাকব তোমার কাছাকাছি
এক জীবনে চাই না আর কিছু
তোমার ভালবাসা ছাড়া
তুমি যে আমার স্বর্গের সুখ
তোমার প্রেম করেছে আমায় সর্বহারা।
“চাষী, তুমি আমারে মাফ কইরা দিও। আমি যা করছি তা না বুইঝা করছি। আমি তোমার জন্নি পাটিশপ্টা পিডা বানাইয়া আনছি এই ন্যও খাও।”
খুব গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বলে, পিঠার বাটিটা মানিকের হাতে দিয়ে পরী আবার চুপ করে বসে রইল। মানিক অতি সহজ সরল বলিয়া সে পরীর বানানো পিঠাগুলো খেতে খেতে বলল “তোমার হাতের পিডা, ইস খাইতে কি মজা! আমাগো নিকার পরে তুমি রং বে রংএর পিডা বানাবা আর আমি ভাত না খাইয়া এই গুলা খামু।”
পরী মানিকের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো বলে “আমি যাই চাষী। কেউ দেইখা ফালাইলে আমার সর্বনাশ আইবো।”
“তাতে কি হইব ? কয়দিন বাদেই তো আমরা ধুমধাম কইরা নিকা করমু।”
“চাষী, গত রাইতে বৈদেশির লগে আমার নিকা পাকা হইয়া গ্যাছে। তুমি আমারে ভুইলা যাইও। আমিই প্রেথম তোমারে প্রেমের কতা কইছি। তোমার হৃদয়ে প্রেম জন্মানোর জননী আমি নিজেই। মা হয়ে সন্তানকে নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করব তাই নিজেরে বড় অপরাধী মনে হইতাছে।”
পরীর মুখের কথাটি শোনা মাত্র মানিকের মুখ থেকে পিঠাটি মাটিতে পরে গেল। সে হা করে কথাগুল শোনার পর বলল “তুমি কি কও পরী। আমি তোমারে ছাড়া বাছমু ক্যামনে ? আমার জীবনের সব সখ আল্লাদের মহারাণী তো তুমিই।”
“বাপমায় কাইল রাইতে বৈদেশির লগে আমার নিকা পাকা করছে। এমনিতেও বাজানে তোমার লগে আমার সম্পর্ক কোন দিন মাইনা লইতনা।”
“ক্যান লইতনা। ক্যান। আমি কি মানুনা। আমার সখ আল্লাদ বলতে কি কিছু নাই। কদম চাচারে আমি গিয়া কমু, এই নিকা ভাইঙ্গা দেন। আমি পরীরে নিকা করতে চাই।”
“না চাষী, তুমি বাজানের দারে যাইওনা।”
“তুমি না কইছিলা পরী, আমরা পালাইয়া তেপান্তরে গিয়া সংসার করমু। লও আইজ রাইতেই আমরা দুজন পালাইয়া যাই।”
“তোমার কি মাতা ঠিক আছে। তুমি না সব সোমায় কও, পলাইয়া নিকা করে কাপুরুষেরা।”
“হ, কইতাম। আমার ভালবাসারে স্বীকৃতি দেওয়ার লাইগা আমি খালি কাপুরুষ ক্যান, তার চেয়েও জঘন্য হইবার পারি।”
“না। আমি আইজ পালাইয়া নিকা করমুনা। আমি বাজানের পছন্দের পোলারে নিকা করমু।”
“তোমার দারে আইজ বৈদেশি খুব ভাল হইয়া গ্যালো।”
“তুমি থামো। বৈদেশি খুব ভালা মানু। তার মন আমি ভাংতে পারমুনা।”
“পরী। তুমি আমার মত একটা সস্তা মানষের মন ভাইঙ্গা বৈদেশির মন জোড়াবা।”
এরপর মানিক আবার পরীর হাত দু খানা ধরে বলে “তুমিই ত আমারে একদিন কইছিলা, আমারে ছাড়া অন্য কারো লগে তোমার নিকা অইলে তুমি বিষ খাইয়া মরবা। আইজ তুমি নিজেই অন্য কারো লগে নিকার জন্নি আমার দূরে ঠেইললা দিতাছো।”
“হ, তহন আমি বুঝবার পারি নাই। তোমার লগে আমার সম্পর্ক করাটাই ভুল হইছে। হাত ছাড়ো চাষী। মানষে দ্যাখলে আমারে কলঙ্ক দিব।”
মানিক আস্তে পরীর হাত দুটো ছাড়িয়া দিয়ে বলল “তুমি আমারে ছাইরা যাইওনা পরী। তোমারে নিয়া আমি ম্যালা স্বপ্ন দেখছি। আমার মত একটা গরিব মানষের আশা তুমি ভাইংগনা।”
পরী আর মানিকের কথা শুনতে চায় না। সে নিজের ইচ্ছে মত মানিকের সঙ্গ ছাড়িয়া হাটা আরাম্ভ করল। ঐ মুহুর্তে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। পাগলের মত অস্থির হয়ে কতক্ষণ ছটফট করে অনেক রাগ নিয়ে শুভর কাছে ছুটে গেল। শুভ নদীর ঘাটে বসে বসে ব্রিজের নকশাঁ আকছে। এই সময় মানিক এসে তাকে বলল “ইঞ্জিনিয়ার সাব আফনে না কইছেন, আফনে মানষের সুখের লাইগা এই ব্রিজ বানান। তয় ক্যান আমার মত একটা গরিব মানষের বাঁইচা থাহনের সুখগুলা কাটার আঘাতে শ্যষ কইরা দিতে চান।”
“কেন তুমি বেকার বেকার চিৎকার চেচামেচি করছ। আমি কারো সুখ শেষ করিনি। তোমার এটা ভুল ধারনা।”
“ইঞ্জিয়ার বাই, আফনের ম্যালা ট্যাকা পয়সা আছে। আফনে ইচ্ছা করলে বস্তায় বস্তায় সুখ ভালবাসা কিনা নিতেন পারেন। আমার ভালবাসা আমারে ফিরাইয়া দ্যান। আমি পরীরে খুব ভালবাসি।”
“কিন্তু পরী কি আপনাকে ভালবাসে ?”
“একশবার বাসে।”
“মোটেও না। সে আমাকে বলেছে আপনি নাকি তাকে বিরক্ত করেন। পরী যদি আমার সামনে বলে সে আপনাকে ভালবাসে তবে আমি কথা দিচ্ছি, আমি পরীর সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক রাখবনা। আপনি পরীকে ডেকে নিয়ে আসুন। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।”
“হ। আফনে খাড়ান আমি পরীরে নিয়া আইতাছি। আমার তিলে তিলে গড়া ভালবাসা এই রকম শ্যাষ অইয়া যাইবনা। সূর্য একদিন আলো দিবার না পারে। মোনের ভুলে একদিন রাইত না হইবার পারে। কিন্তু পরী আমারে ভালবাসে না, এই কতা সে কোনদিন কইবনা।”
মানিক সাদা মনের মানুষ। তাই তার মনে পরীর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। এই বিশ্বাস নিয়ে মানিক পরীর বাড়ীর দিকে জোড় পায়ে হাটিয়া গেল। পরী তখন তার মায়ের সাথে উঠানে বসে যাতা দিয়া কলাই ডাল ভাংতে ভাংতে শুভকে নিয়ে আলোচনা করছে। মানিক কাউকে কিছু না বলে উঠানের মধ্য থেকে পরীর ডান হাতটি চাপিয়া ধরিয়া টানিতে টানিতে নিয়ে এল শুভর কাছে। তারপর মানিক পরীকে বলল “কও পরী। এই ইঞ্জিনিয়ার সাবে কয়, তুমি নাকি আমারে ভালবাস না। এই ডা কি হয় কও ? দুনিয়ার সব মিত্যা হইবার পারে কিন্তু আমার ভালবাসা মিত্যা হইবার পারো না। হালায় একটা পাগল।”
পরী, শুভর অপমান সাইতে না পেরে মানিক কে বলল “বৈদেশি পাগোল না। পাগোল তুমি। বৈদেশির লগে কেমনে তুমি তোমার তুলনা কর। হে একজন শিক্ষিত মানু, তুমি মূর্খ একজন চাষা ভুষা ছাড়া আর কি ? কি নিয়া নিজেরে এত অহংকারী ভাবো। কি আছে তোমার ? সত্ ভাইদের গোলামী আর পুরানো ভাংগা একটি চকি, কি আছে তোমার? আমার লগে কতা কওয়ার সাহস কি করে হয় তোমার, আমার বাবা তোমার মত গরিবকে ক্ষ্যাতের কামলাও রাখবোনা।”
“আমি গরিব হইলেও আমার এক বুক খাঁটি প্রেম আছে। যা ঐ বৈদেশির নাই।”
“এই প্রেম, ভালবাসা খালি তোমার ঐ যাত্রাপালায়ই মানায়, জীবনের মঞ্চে না। হুন চাষী, তুমি আমারে আর জ্বালাইও না। ম্যালা ত্যাক্ত করছ। এবার আমারে মুক্তি দ্যও।” কড়োজোড়ে অনুরোধ করে বলল পরী
“বৈদেশি চাইল্লা আয়েন। এই পাগোলের কতায় কান দেওন না দেওন সমান কতা।” পরীর দ্বারা মানিক এত বড় অপমান হবে তা সে কোন দিন কল্পনাও করতে পারেনাই। মানিকের মনের আকাশ জোড়া বিশ্বাসটি আজ ভেঙ্গে খন্ড খন্ড হয়ে গেল। পরী চলে যাবার পরে সে কড়া রোদের মধ্যে সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। মানিকের সারা শরীর থেকে দর দর করে ঘাম ঝরতে আরাম্ভ করল। কিছুক্ষণ পর মানিক খুব ক্লান্ত ভাব নিয়ে নিজের বাড়ীতে এসে রান্না ঢেঁকিতে বসে তার মাকে বলে ” মা, আমারে এক বাডি জল দিবি। গলাডা আমার ফাইট্টা যাইতাছে।”
সর্মেতবানু ভাত রান্না রাখিয়া ঘড়ের ভিতর থেকে পিতলের একটা বড় বাটিতে পানি এনে মানিক কে বলে “এই নে।”
মানিক পানি পান করিয়া খালি বাটিটা পাশে রাখা মাত্রই সর্মেতবানু প্রশ্ন করল “পরীর লগে তোর কি হইছে ?”
“কই মা ! কিছুই হয়নাই।”
“একটু আগে পরী, তাগো বাড়ীর এক অতিথ নিয়া আইছিল। তোর নামে নালিশ কইরা গ্যলো। তুই নাকি পরীর নিকা ভাইংগা দিতে চাও। পরী ক্যমন যেন বদলাইয়া গ্যাছে। আগের মত আর নাই। তুই ওর লগে আর কতা কইশ না। আমি ম্যালা অসুস্থ।”
” কি কইলা মা। পরী তোমার দারে আমার নামে নালিশ করছে ?”
“হ রে বাপ। আরো ম্যালা নালিশ। থাউক বাদ দে ওসব। আমি তোর লাইগা লাল টুক টুকা রাইজ কইন্না বউ আইন্না দিমু।”
“ঠিকই কইছ মা। আল্লায় জন্মের সোমায় আমাগো হিসব কইরা গরিব বানাইছে। না হইলে আমরা পদে পদে ক্যান ঠই¹া যামু। আল্লায় তো আমাগো ভালা চায় না। চাইলে নিশ্চই আমাগো তিলে তিলে গড়া জিনিস বড় লোকেরা ট্যাকা দিয়া খরিদ করতে পারতো না।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৫০:২৩ ৫৮৯ বার পঠিত