বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০১৪
সুখকাঁটা-আল রিআন
Home Page » সাহিত্য » সুখকাঁটা-আল রিআনদ্বাদশ পর্ব শুরু……….গ্রামের নতুন মেহমান শুভ আহম্মেদ। সে পিংড়ী গ্রামটাকে ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখার জন্য অতি সকালে বের হলেন। গ্রামের পরিবেশটি তাহার খুব ভালই লাগল। ধান সিঁড়ি নদীর তীরে গিয়ে দূরবিন ব্যবহার করে ব্রিজ তৈরী করার প্রাথমিক ধারনা নিচ্ছে। পরী জানে তার বাড়ীতে একজন বিদেশী মেহমান এসেছে কিন্তু তাকে এখনও সে নিজের চোখে দেখে নায়। পরী সকাল বেলা ছাগলছানা কোলে নিয়ে খালি পায়ে মাঠে হাটিতেছে এমন সময় নদীর ধারে শুভকে সে দেখতে পায়। শুভ একটা বড় কাগজে ব্রিজ একে মাপ লিখছে। পরী তাহার পাশে গিয়ে বাক শব্দ করে শুভর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। শুভ একটি মেয়ের কন্ঠ শুনে কাজ রেখে পরীর পানে এক নজর দৃষ্টি দিল। সাজ সকালে পরীর মুখ খানা দেখে সে মুগ্ধ হল। তার জীবনে এত সুন্দর সকাল আর কোন দিন আসেনি।
পরী তাকে বলল “আফনেই কি আমাগো বাড়ীর অতিথ।
“আপনি কোন বাড়ী থাকেন?”
“আমার বাজানের নাম কদম আলী মাতবর।”
“ও আপনি তার মেয়ে।”
“হ।”
“আপনার কোলে এটা কি ?”
“দ্যাখেন না, ছাগল ছাও।”
“আপনার নামটা কি বলবেন ?”
“পরী।”
“সত্যিই আপনি পরীর চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী। আমাদের শহরের সকল সৈর্ন্দয্য আপনার এই মন মুগ্ধকর রুপের কাছে হার মানবেই।”
পরী একটু লজ্জা পেল বটে। কারণ কোন্ নারী তার নিজের রুপের প্রসংশা শুনতে না চায়। তারপরও ঢাকার শহরের এক যুবক তার রুপের প্রসংশা করেছে। এই প্রসংশা কি যার তার কপালে জুটে।
পরী অনেকক্ষণ পরে শুভকে একটা প্রশ্ন করল “আফনে নাকি ঢাকায় থাকেন।”
“হ্যা। আমি ঢাকায় থাকি। আমার নাম শুভ আহম্মেদ। আপনাদের গ্রামে একটি ব্রিজ তৈরী করতে এসেছি।”
“আমি জানি।”
“আমার আর কোন কোন বিষয় আপনে জানেন।”
“ওই যে আফনে একজন ইঞ্জিনিয়ার, গেরামে আইছেন ব্রিজ বানাইতে।”
“আপনাদের গ্রামে আমি তো একে বারে নতুন। যদি আপনি আমার বন্ধু হতেন তবে মাঝে মাঝে আমি আপনার সাথে গল্প করতাম। তাতে আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে।”
কোন উত্তর না পেয়ে শুভ আবার পরীকে বলে “তার মানে আমার বন্ধু হতে আপনার আপত্তি আছে ?”
পরী মাথা নাড়িয়ে না উত্তর করে।
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাকে বন্ধু করার জন্য।
“আমি যাই। আমার কাম আছে।
“ঠিক আছে যান তবে পরের বার কিন্তু অনেকক্ষণ গল্প করতে হবে।”
পরী চলে যাবার পর শুভ ভেবে দেখল, এত সুন্দরী রুপসী কন্যা এই অজপাড়া গাঁয়ে থাকে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস ই করতে পাতাম না। যদি এমন একটা মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পাতাম।
কিছুদিন পরে শুভ ব্রিজের কাজ আরম্ভ করবে। এখন ক্ষেতের ধান গাছে কেবল ধানের শীর্ষ বের হয়েছে। এই সময়ে ব্রিজের কাজ ধরলে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। ধান পেকে আসলেই ব্রিজের ভিত্তি স্থাপন হইবে। কার জমির উপরে ব্রিজে স্থাপিত হইবে তা এখনও সঠিক করে বলা মুশকিল। এই ব্রিজ দিয়ে গ্রামবাসীর মঙ্গল করিতে গিয়ে কার কপাল পুড়িবে তা কে জানে ? কারণ ব্রিজের কলাম বা পিলারগুলো যে যে স্থানে পড়বে সে জমির আসে পাশে কোন ফসল আবাদ হইবেনা। গ্রামবাসীর উপকারের জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করিতে কোন কৃষকই চাইবেনা তার জমির উপড়ে ব্রিজের পিলার স্থাপন হউক। এই জন্য ক্ষেতের ধান পাকিবার আগেই ইঞ্জিনিয়ার শুভ গ্রামের সকল জমি জড়িপ করার জন্য জড়িপ অফিসারদের ডেকেছেন। এই জরিপে কার ভাগে কতটুকো জমি আছে তাও প্রমানিত হইয়া যাইবে। এবং কোথায় কোথায় সরকারী খাস জমি, কার দখলে রয়েছে তাহাও বের হয়ে আসবে। গাঁয়ের মানুষ একথা শুনে সবাই শুভর পিছনে লাইন ধরেছে। কেহ কেহ জমির দলিল সহকারে ফল ফলাদি পুকুড়ের বড় বড় মাছ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারের সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করছে। এই গ্রামের অনেক জমিতেই ভ্যাজাল আছে। জাল দলিল আছে বহু মানুষের। শুভ সকলকেই বলিল “আমি ইঞ্জিনিয়ার। আমি দলিল সম্পর্কে কিছুই বুঝবনা। কাল আপনাদের গ্রামে ভূমি জড়িপ অফিসার আসবেন। তারাই সব জমি মেপে দেখবেন কার নামে কতটুকো জমি আছে। তবে আর একটা কথা বলল যাদের মিথ্যা দলিল দিয়ে অন্যের জমি ভোগ দখল করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারবাদী মামলা হবে। সে সব সরকারী অফিসারদের আবার যেন এই রকম হাঁস মুরগী মাছ না দেন। এসব দিলে তারা আপনাদের অপমান করতে পারে, কারণ তারা সরকারী লোক এরা ঘুস লেনদেন করে না। এমনি এমনি আপনাদের কাজ করে দিবে।”
শুভর কথায় গ্রামের অনেক লোকই নিরাশ হয়ে বাড়ী ফিরলেন। সরকারী জড়িপে কার জমি কমে কে ভিক্ষারী হয়ে যায় এই নিয়ে চিন্তিত অনেক কৃষক। মানিকও বেশ চিন্তিত তবে কোন জমা জমি নিয়ে নয় তার গর্ভধারীনি মাকে নিয়ে। সে আজ কয়েক দিন ধরেই বেশ অসুস্থ। ঘরে রান্নার মত দুটো চালও নাই। মানিক তার ভাইদের কাজ করে যা পেয়েছিল তা সব বিক্রি করে সংসারের অন্যান্য খরচ চালিয়ে ছিল এবং শেষ সময় চাল বিক্রি করে মায়ের জন্য কবিরাজ দেখিয়ে পত্ত কিনেছিল। মানিকের হাতে এখন একটা ফুটো পয়সাও নেই। এই কয়েকটা দিন গেলেই টাকার অভাব আর হইতনা। ইরি ধান পাকিতে যে কয়দিন সময়। তারপর সংসারে আবার সচ্ছলতা আসত। মানিক কার কাছে ভাতের চাল চাইবে। আবুল বাবুলদের গোলায় চাল আছে মণকে মণ, তা তাদের সারা বছরের খোরাকির জন্য জমা আছে। এক সের চাল ধার চাইলে দিতেও পারে আবার না বলিয়া ফিরিয়াও দিতে পারে। মানিকের মত অনেক কৃষক এখন অর্থহীন হয়ে পরেছে। বোরো ধান বিক্রির টাকা অনেক কৃষকের হাতেই জমা নাই। সবাই ইরি ধানের অপেক্ষায় আছে। এই ফলন ভাল না হলে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে না খেয়ে মরিতে হবে। সবার আগে মানিককে মরিতে হইবে। কারণ এখনই তার ঘরের চাল শেষ হইয়া গিয়াছে। মানিক অনেক ভাবিয়া দেখিল আজকের দিনটা পার করতে পারলে কালকে এক বেলা পেট ঠাসিয়া দাওয়াত খেয়ে দু বেলার চাল বাঁচানো যাবে। আগামীকাল বাবুলের ছেলের মাথা কামাইবে। এ উপলক্ষে তারা বিশাল আয়োজন করেছে। মানিক মানুষের মুখে শুনেছে আগামী কাল তার বড় ভাইদের বাড়ীতে মাথা কামাইবার অনুষ্ঠানে ছাগল জবাই হবে। পোলাউও নাকি রান্না হবে। মানিক ক্ষুদা পেটে পোলাউ মাংসের কথা ভাবিয়া জ্বিবে জল এনে বলে “ইস কত দিন হইছে পোলাউ গোস্ত খাইনাই। ছয় সাত বছর বয়সের সোমায় একবার পোলাউ খাইছিলাম। কাইল নিশ্চই আমারে পোলার ছোড চাচা হিসাবে দাওয়াত করবো। আমার ভাইস্তার মাথা কামাইব ঐ বাড়ীতে আমার কত কাম।”
মানিক পোলাউ মাংসের কল্পনা বাদ দিয়ে বলে “ভালা খাওনের কতা ভাবতে ভালাই লাগে তয় প্যাটতো কাইলকের কতা মানবনা। আইজ কার বাড়ীতে গিয়া চাইল চামু। না খাইয়াও তো থাকতে পারমুনা। যাই দেহি কার বাড়ীতে চাইল পাই।”
রোদের মধ্যে বহু ঘুরে ফিরে অবশেষে জলমিয়াকে খুঁজে বের করে বলল “এই জলমিয়া একটা জিনিস চামু না করতে পারবিনা।”
“কি চাইবা মানিক বাই, আমার ধারে কি এমন আছে।”
“আমারে স্যর দুই এ চাউল ধার দিবি ?”
“কি কও মানিক বাই ? তোমরা যদি আমাগো দারে চাউল ধার চাও তয় আমরা কার দারে যামু।”
জলমিয়ার কথায় মানিক লজ্জা পেয়ে একটু চালাকি করে বলল “দূর ব্যাটা তুই মনে করছোস আমার ঘরে চাউল নাই। ম্যালা আছে। তোর কাছ দিয়া চাউল নিয়া আমি একটা মাঝারে দিমু। আমিও দিছি।”
“ও মাঝারের জন্নি চাউল। যাও আমার বাড়ী গিয়া চাও, ফাতু আছে চাইলেই দিবো।”
“না। তোর বউ যদি আমারে চাউল না দেয়। তারচেয়ে তুই আমার লগে তোর বাড়ীতে চল।”
“তুমি দ্যাহনা আমি একজনার খড়ি কাটতাছি। তুমি ফাতুর দারে মাঝারের কতা কইলেই চাউল দিয়া দিবো।”
মানিক লজ্জা শরম সব উপেক্ষা করে জলমিয়ার বাড়ী গিয়ে ফাতেমার কাছে বলল “বউ মা ভাল আছ তুমি ?
ফাতেমা উঠান ঝাড়- দেওয়া রেখে বলল “আরে মানিক দাদা। কেমন আছেন আফনে। চাচি আম্মার অবস্থা কি ?
“মায় আছে কোন রকম। হুন বউ মা, আমি আইছি মাঝারের সিন্নির জন্নি দুই সার চাউল নিতে।”
“দাদা আফনে একটু খাড়ান আমি আনতেছি।”
ফাতেমা ঘরের ভিতর থেকে কিছুক্ষণ পর চাল এনে বলে “এই নেন তিন সার চাউল দিলাম। ব্যাগতো নাই নিবেন ক্যামনে।”
“ব্যাগ লাগবোনা আমার লুঙ্গিতেই নিতে পারমু।”
মানিক তার পরনের লুঙ্গির সামনের অংশে চালগুলো নিয়ে সোজা নিজের বাড়ী চলে গেল। সর্মেতবানু অসুস্থ সে বিছানা থেকে উঠতে পারছেনা। মানিক নিজে নিজে ভাত রান্না করে পাশের একটি বেগুন গাছ থেকে দুটো বেগুন ছিড়ে সিদ্ধ করে ভর্তা করল। সারাদিন অনেক খাটুনি খেটেও মায়ের জন্য প্লেটে করে ভাত মেখে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে।
সর্মেতবানু মানিককে প্রশ্ন করে বলল “চাইল পাইলি কই ?”
“পাইছি। আগে তুমি খাও পরে হুনবা।”
“তুই খাবিনা ?”
“খামু। তয় এহন না। আগে নাইয়া আই।”
“মানিক বাপ, আমার একটা কতা হুন। আমি আইজ আছি কাইল নাই। কহন যে মইরা যাই কেডা জানে। তুই ঠিক মতো থাকিশ। কেউর লগে মারামারি করবিনা। তোর তো কেউ নাই তুই একলা মানু কেউর লগে পারবিনা। আবুল বাবুলের দারে কাছেও পারতেসার্ধে যাবিনা।”
“তুমি থামোতো মা। ভাত খাইয়া ঘুমাও।”
“হ রে বাপ, আমার ঘুমানের সোমায় কাছাইয়া আইছে। তোর নানার কিছু জমি আছিল এই গেরামে। পঞ্চাশ ষাইট বিঘার কোম অইবো না। তোর নানায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্বের সোমায় আমারে আর তোর নানীরে নিয়া পালাইয়া যায় ম্যালা দূরের এক গেরামে। আমি তহন খুব ছোড, ভালা মন্দ কিছুই বুঝিনা। দ্যাশ স্বাধীন অওনের অনেক দিন বাদে আমার বয়স যহন নয় দশ বছর হইব তহন আমরা আবার তোর নানারে নিয়া এই গেরামে ফিরা আই, কিন্তু কোন লাভ অয়নাই। আইসা দেখি আমাগো সব জমি জিরাত ঘর বাড়ী মানষে দখল কইরা নিছে। থাকনের মতো আমাগো কোন জায়গা জমি নাই। তারপর আমরা আবার তোর নানার লগে সেই আগের গেরামে চইল্লা গেলাম।
“কি কইতাছো মা। এই কতা তুমি তো আগে কোন দিন কওনায়। এত্ত গুলা জমি বেদখল হইয়া গেল। নানায় কিছু করে নাই।”
“কি করবো। তোর নানায় একলা মানু। তয় সেই জমি নিয়া মামলা করছিল। তোর নানায় মইরা যাওনের পর মামলা আর কেউ চালায় নায়। কোটের মামলা কোটেই রইছে। আমার দারে এই সব জমির দলিল আছে। গ্রামে নাকি ভূমি জড়িপ বইবো।”
“হ। আমিও হুনছি।”
“এই দলিল থাকলে তুই জানতে পারবি তোর নানার জমি কারা কারা খাইতাছে।”
“এতদিন বাদে তুমি আমারে এই দলিল দিতাছো। আমার নানার এত জমি আছে আগে তো কোন দিন কইলা না।”
“কইলে তুই কি করতে পারতি। আমার মোনে কইতাছে তুই এহন সব জমি ফিরা পাবি।”
মানিক ভাবিয়া দেখিল পঞ্চাশ ষাট বিঘা জমি তাহার দখলে আসে তবে প্রথমই মাকে গঞ্জে নিয়ে বড় ডাক্তার দেখাইবো পরে কদম আলীর কাছে দিয়ে পরীকে নিকা করার জন্য প্রস্তাব পাঠাইবো। পঞ্চাশ ষাট বিঘা জমির মালিককে নিশ্চই কদম আলীর একমাত্র মেয়ে জামাই করতে কোন আপত্তি থাকবেনা। পরীকে নিকার সময় পুরা গ্রাম সুদ্দো মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়াইবো। রাজপুত্র-রাজকন্যার মত ধুমধাম করে নিকা হবে আমাদের। আস্ত একটা গরু জবাই করে বিশাল আয়োজন করব। গোস্ত পোলাউর ছড়াছড়ি লাগিয়ে দিব।
সরকার কতৃক জমি জড়িপের আগেই শুভ আহম্মেদ নিজে নিজে ব্রিজের পিলার স্থাপনের জন্য এক খন্ড জমি বাছিয়া নিল। যে জমির উপড় পিলারটি স্থাপিত হইবে সে জমিটি আর কারো নয় আবুলÑবাবুলের ধান ক্ষেতের জমি। মানিক এই খবর জানতে পেরে ছুটে গেল জমির কাছে তার সঙ্গে আবুল বাবুলও ছিল। মানিক খুব উত্তেজিত হয়ে শুভকে বলল “ও আফনেই তাইলে নাটের গুরু। আমি আফনারে ভালা লোক মোনে করছিলাম। শহরের লোক এত যে খারাপ আগে জানতাম না।”
“মানিক সাহেব আপনি খুব উত্তেজিত হয়ে আছেন। আগে মাথা ঠান্ডা করুন।”
বাবুল বলে “বাই ইঞ্জিনিয়ার। আফনে ব্রিজ বানান আর যা খুশী বানান তাতে আমাগো কিছুই যায় আয় না। আমরা খাইট্টা খাওয়া মানু। এই জমিতে যদি ব্রিজের পিলার পরে তাইলে আমাগো এই জমিতে ধান তো দূরের কতা পানও হইবোনা।”
“দেখুন ভাই, এই জমিটা যদি আপনার হয়ে থাকে আর যদি আপনার জমিতেই ব্রিজের পিলারটি পরে তবে আপনি এই জমির দাম পাবেন। সরকারী তথ্যনুযায়ী আমার কাছে যে কাগজ পত্র আছে, তাতে লেখা আছে এই ধানসিঁড়ী নদীর আসে পাশের প্রায় অনেক জমিই সরকারের, মানে খাস জমি।”
“খাস জমি আইবো কোথাদিয়া। আমি এই গেরামের পোলা, আমি জনিনা। এগুলা আমার বাপদাদার জমি।” আবুল বলল ইঞ্জিনিয়ার শুভকে।
“আমি তো আগেই বললাম। কাল ভূমি রের্কড অফিসাররা আসবেন। আপনাদের দলিল নিয়ে তাদের কাছে গেলেই তারা বলে দিতে পারবে আপনার কোন দাগে কতটুকো জমি আছে। আপনারা তিন ভাই যখন একত্রে এসেছেন তবে বলি শুনুন “এ ব্রিজ তো আমি আমার জন্য করতে আসি নাই। গ্রামের সবার জন্য। যদি আপনাদের জমিতে পিলারটি পরে তবে গ্রামের মানুষের জন্য একটু স্বার্থত্যাগ করতে পারবেন না। আর একটা জ্ঞানের কথা শুনুন একটা পরিসংখ্যনে দেখা গেছে আমাদের বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮০ শতাংশের বেশি কৃষি জমি ব্রিজ, সেতু, কালবার্ড নির্মাণ সহ রাস্তাঘাট স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল তৈরীর জন্য নষ্ট হচ্ছে। এটা কেবল আপনাদের একক সমস্যা নয় সারা দেশের জন্য একটা বড় হুমকি। কৃষক না বাঁচলে সোনার বাংলাদেশ বাঁচবে কি করে ? বলতে গেলে আপনারাই কৃষি ভিত্তিক একটি দেশের হাল ধরে আছেন। মানিক সাহেব, ব্রিজের একটি পিলারের জন্য কতটুকোই বা জমির ক্ষতি হবে, তার চেয়ে তো প্রতি বছর বহু বহু গুনে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্বির কারণে।”
বাবুল খুব জেদ নিয়ে বলল “আমরা এত কতা হুনবার চাইনা। আমরা আমাগো জমিতে একটাও পিলার পরতে দিমুনা। পিলার গাথোনের আগে এই খানে লাশ পরবো।”
“ও আচ্ছা। আপনাদের এতক্ষণ বুঝিয়েও কোন লাভ হলনা। আমার কাজে যদি বাধা দেবার বিন্দু মাত্র চেষ্টা করেন, আমি কিন্তু পুলিশের আশ্রয় নিতে বাধ্য হব।”
পুলিশের কথা শুনে তাদের সবার মনে একটু ভয় এসে উপস্থিত হইল। শুভর সাথে তারা আর কোন কথা না বলিয়া বাড়ীর দিকে ফিরে এলেন।
আর মাত্র কয়েক দিন পরেই চৈত্র মাসের অবসান ঘটে বৈশাখ মাসের আগমন ঘটবে। গ্রামে বৈশাখ মাসের আগমন মানে কোন সাধারণ মাসের আগমন নয়। বৈশাখ মাস এলে তাদের নানা রকমের আয়োজন করিতে হয়। পহেলা বৈশাখ বিকাল থেকে গ্রামে মেলার উৎসব বসে। মেলার মধ্যে নানা রকমের চিত্ত বিনোদনের আয়োজন থাকে। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল যাত্রাপালা, জুয়াখেলা ও মেয়েদের নাচের আসর। চৈত্র মাসের বিশ পঁচিশ তারিখ থেকেই মাইকে মেলার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামের যুবক ছেলেরা বড় একটি বট গাছের নিচে ছোট ছোট দোকান করে ভাড়া দিবে।
সামনে মেলা উপলক্ষে পরী মানিককে বলে “কয়দিন বাদে ম্যালা হইলে আমারে তুমি লাল চুড়ি, লাল ফিতা, লাল আলতা কিইনা দিবা কিন্তু। আমি ম্যালার দিন মনের মত সাইজা তোমার লগে ঘুইরা বেড়ামু। আর পরের দিন আমরা দুই জন গঞ্জের বড় ম্যালায় যামু।
“ম্যালার পরের দিন না গেলে হইব না।”
“ক্যান চাষী। তুমি এমন কতা কইলা ক্যান।”
“আমাগো ম্যালায় যাত্রাপালার দল আইছে না,তারা আমারে একটা পাট গাইতে দিবো কইছে।”
“চাষী, আমি তোমার যাত্রাপালা দেখতে যামু না।”
“ক্যান। তুমি না যাত্রাপালার পাগোল। আমি তো তোমার খুশীর লাইগাই যাত্রাপালায় নাম দিছি। তুমি যাত্রা না দ্যখলে আমি কার লাইগা অভিনয় করমু।”
“না। তোমার লগে অন্য মাইয়া মানু নাচব কতা কইব তোমার গায় আহ দিব, তা আমি দ্যখতে পারমুনা। আমার কষ্ট অইবো।”
“ঠিক আছে আমি যাত্রা দিয়া আমার নাম কাটাইয়া দিমু। আমি দুনিয়ার সব সইতে পারলেও তোমার কষ্ট আমি সইতে পারমুনা।”
“চাষী, তুমি আমার লাইগা এত বড় একটা সুযোগ ত্যাগ করলা। আইজ বুঝলাম তুমি আমারে কতডা ভালবাস। একটা মাইয়া মানুর জীবনে আর কি দরকার, যদি হে এত ভালবাসা পায়।”
মানিকের বাম ঘাড়ে মাথা রাখিয়া পরী বসিয়া রইল। অনেকক্ষণ পর মানিক বলে “পরী বাড়ী যাইবানা। রাইত অইয়া যাইতাছে।”
“হ। যামু তো। আমারে একটু বাড়ী পর্যন্ত পোউছাইয়া দ্যাও।”
তোমারে এক মূহুর্তের জন্নি ও চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করেনা। আমি তোমার প্রেমে পাগল অইয়া গেছি চাষী।”
মানিক পরীর জোড়া ভাঙ্গিয়া দু জনে দুদিকে চলে গেল। কাল মানিকের অনেক কাজ। সারাদিনই তাকে ব্যাস্ত থাকতে হবে। আগামী কাল দুপুরে বাবুলের ছেলের মাথা কামানো অনুষ্ঠান। মানিক অনেক স্বপ্ন নিয়ে রাতে ঘুমিয়েছে।
পরের দিন সকালের কথা।
মানিক সকাল থেকেই বাড়ীতে অবস্থান করিতেছে। কোন কাজে বের হল না। মানিক ভাবিল আজ অনুষ্ঠান, আগে থাকতে যখন আমাকে দাওয়াত করেনি নিশ্চই আজ দাওয়াত করবে। বাড়ী থেকে কাজের জন্য বের হলে বাবুল দাওয়াত দিতে এসে যদি না পায় তবে এত বড় দাওয়াতটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। মানিক এত বেলা পর্যন্ত কোন দিন বাড়ীতে থাকেনা। আজ ঘড়ের বাহিরেও যাচ্ছেনা ব্যাপার কি ? এই জন্য সর্মেতবানু বলে “কিরে মানিক, আইজ কামে যাবিনা?”
“হ, যামু তয় এহন না।”
“কিছু অইছে নাকি তোর? আমারে ক বাপ।”
“না। কি অইব। কিছুই অয়নায়।”
মানিক ঘরের মধ্য থেকে বাহিরে বের হয়ে উঠানের চারিপাশে পাইচারি করছে। অনেকক্ষণ পাইচারি করার পর সে নিজ আগ্রহে বাবুলদের বাড়ীরে রওহনা দিল। অবশেষে মানিক ভেবে দেখল বাবুলদের বাড়ীতে যে কোন কাজের অযুহাতে গেলে ভাবিরা অন্তত তাকে দেখে দুপুরে খাবার জন্য নিমন্ত্রন করবে। যেহেতু বাড়ীতে আজ এত বড় একটা উৎসব। মানিক তার বড় ভাইদের বাড়ীতে গিয়ে দেখে দুই ভাইয়ের শ্বশুড় শ্বাশুড়ী সহ শালা শালি অনেক মেহমান। তাদের জন্য অনেক দামি দামি খাবার রান্না হচ্ছে। মানিক একটু ভাল খাবার লোভে সব লজ্জা শরমকে জলাঞ্জলী দিয়ে বাড়ীর মধ্যে ঢুকে বড় ভাবিকে বলল “ভাবি আবুল দাদায় কই গ্যাছে। তারে ব্যান ব্যালা হইতে খুইজ্জা মরি।”
“কই গ্যাছে আমি জানিনা। তোমার ভাই কি আমারে কিছু কইয়া যায়।”
“ও, আমি যাই। মেয়াবাই আইলে আমার কতা মোনে কইরা কইয়েন।”
“আচ্ছা কমুনে ছোড মিয়া।”
“আমি যাই ভাবি?”
পরের বার মানিকের কথায় আর সারা দিলনা তার ভাবি। মানিক মাথাটা নিচু করে আস্তে চলে এলো। তার ভাই ভাবিদের আচরণে সে অনেক কষ্ট পেয়ে মনের দুঃখ আর চেপে রাখতে পারলনা। মানুষের অন্তরালে গিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল। সারা বেলা বাগানে বাগানে থাকার পর দুপুর বেলা বাড়ীতে গিয়ে খেতে বসে দেখে তার মা দুটো লাল কড় কড়া পোড়া মরিচ দিয়ে তাকে ভাত খেতে দিয়েছে। মানিক তখন তার মাকে বলল “মা তুমি এই ঠাডা পড়া রৌদের মদ্যে দুইডা হুগনা মরিচদা ক্যামনে ভাত খাইতে দিলা। আমি এই ভাত ক্যামনে খামু। আমার গলা দিয়া এই ভাত নামব না।”
“তোর আইজ কি অইছে। আমার দারে তো কোন ট্যাকা পয়সা নাই, যে আমি তোরে মাছ গোছ কিইন্না খাওয়ামু। তুই আমারে মাফ কইরা দে বাপ। আমি তোরে জন্ম দিছি ঠিকই কিন্তু তোর মোনের কোন আশাই পূরণ করতে পারি নাই।”
মানিক দীর্ঘ একটা নিশ্বাঃস ছেড়ে বলে “না, মা তুমি আমার সব আশাই পূরণ করছো। আমার মনে কোন দুঃখ নাই।”
মানিক অতি দুঃখ তার মায়ের গলা জড়িয়ে কেদে কেদে এসব বলল।
সর্মেতবানু মরিবার আগে তার পুত্র বধুকে দেখিয়া যেতে চায়। কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত পাত্রী কোথায় ? সর্মেতবানু ভাবিয়া দেখিল তার ছেলের জমা জমি কম থাকায় ভাল কোন ঘড় থেকে সমন্ধ আসে না। তাই সর্মেতবানু দু হাত তুলে খোদার কাছে এই দোয়াই করেন, মানিক যেন তার নানার সব জমিগুলো ফিরে পায়। মানিকের নিজের নামে কিছু জমি থাকলে উচ্চ বংশের মেয়ে পাইতেও কোন সমস্যা হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০:৪০:১৮ ৫৮৮ বার পঠিত