মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০১৪

আমাকে নিয়ে যাও আব্বু

Home Page » প্রথমপাতা » আমাকে নিয়ে যাও আব্বু
মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০১৪



cambrian-college1-400x230.jpg

বঙ্গ-নিউজ:আব্বু, আমি আর ঢাকায় থাকব না। হোস্টেলে সমস্যা হচ্ছে। তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও …- এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম রায়হান। মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে বাবা সাকের উল্লাহ জানতে চান, কি হয়েছে? জবাবে রায়হান জানায়, হোস্টেল সুপার ওমর ফারুক এবং তার সহকারী আশরাফ আলী সমস্যা করছে। আর কোনো কথা বলতে পারেনি রায়হান। এরপর থেকেই তার মোবাইল ফোন বন্ধ। ছেলের কান্নার শব্দে বুক ভেঙে যায় কক্সবাজারের ফিশিং বোট ব্যবসায়ী সাকের উল্লাহর। সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। বিছানায় ছটফট করেছেন। রাতেই তিনি ঢাকায় ভাতিজা তারেক ইকবাল ও হেলাল উদ্দিনকে ফোন করে হোস্টেলে গিয়ে খোঁজ নিতে বলেন। পরদিন শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে হোস্টেল সুপার ওমর ফারুক টেলিফোনে সাকের উল্লাহকে বলেন, আপনার ছেলে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

রায়হানের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের সদর থানার ফেরাকুল গ্রামে। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে সে ছিল দ্বিতীয়। শনিবার দুপুরে কক্সবাজারের ডেলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জানাজা শেষে তার লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

২ মাসের ব্যবধানে ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের হোস্টেলে দুই শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় আতংক ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ দুটি মৃত্যুর ঘটনায় তারা কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছেন। ঘটনার পর ওই খিলবাড়িরটেক ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওই হোস্টেলটিতে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

শুক্রবারের ঘটনায় করা মামলার বাদী রায়হানের দূরসম্পর্কের চাচা আবদুল আওয়াল শিকদার যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে শুক্রবার সকালে কক্সবাজার থেকে বিমানে তিনি ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি ভাটারায় কলেজের হোস্টেলে যান। সেখানে যাওয়ার পর জাহিদুল ইসলাম রায়হানের রুমমেটদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, বৃহস্পতিবার রাতে হোস্টেলে ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে হোস্টেল সুপার ও সহকারী সুপার তাকে মারধর করেন। সহপাঠীদের কান ধরে ওঠবস করানো হয় বলেও কেউ কেউ জানান। এরপর সকালে পাশের ৬০৫ নম্বর কক্ষে জাহিদুল ইসলাম রায়হানের ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। ওই কক্ষের দুই আবাসিক ছাত্র আল ইমরান ও শাহজাদা সুমন ছুটিতে থাকায় কক্ষটি ফাঁকা ছিল।

শনিবার ৯৬৩ খিলবাড়িরটেকে পাতা নামের ৬ তলা ওই ভবনে অবস্থিত হোস্টেলে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সুনসান নীরবতা। ভবনের ভেতর প্রবেশ করতে চাইলে গেট আগলে দাঁড়ান নিরাপত্তাকর্মী আবদুস সাত্তার। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর নিরাপত্তাকর্মী হোস্টেলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপার কামরুল হাসানের কাছে নিয়ে যান। তিনি জানান, শুক্রবারের ঘটনার পর হোস্টেল ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে। পরে হোস্টেল খুললে অভিভাবকদের ফোন করে জানিয়ে দেয়া হবে।

তিনি বলেন, ঘটনার পর হোস্টেল সুপার ও সহকারী সুপারকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হলে কর্তৃপক্ষ তাকে এ হোস্টেলের দেখভাল করার দায়িত্ব দিয়েছে।

এ সময় জাহিদুল ইসলাম রায়হানের রুমমেট দ্বীপের অবস্থান এবং তার মোবাইল ফোন নম্বর চাইলে কামরুল হাসান তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। নতুন হোস্টেল সুপার কামরুল হাসান বলেন, ৭ তলা ভবনটি ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের হোস্টেল হিসেবে ব্যবহারের জন্য ভাড়া করা হয়েছে। রাজধানীতে তাদের প্রতিষ্ঠানের আরও ১৪টি হোস্টেল রয়েছে। খিলবাড়িরটেক হোস্টেলে মোট ৭২ জন আবাসিক ছাত্র বসবাস করে।

পরে জাহিদুল ইসলাম রায়হানের রুমমেট দ্বীপের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ তার সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, রাত ৯টার দিকে হোস্টেল সুপার ও সহকারী সুপার ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে জাহিদুল ইসলামকে মারধর করেন। তাকে কলেজ থেকে বের করে দেয়ার কথাও বলেন। প্রায় আধ ঘণ্টা ওই কক্ষে অবস্থানকালে জাহিদুল ইসলামকে কান ধরিয়ে ওঠবস করান। এ ঘটনার পর হোস্টেল সুপার ও সহকারী সুপার চলে গেলে জাহিদুল ইসলাম অনেক কান্নাকাটি করে।

দ্বীপ জানায়, সে নিজেও জাহিদুল ইসলামকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনোভাবেই সে শান্ত হচ্ছিল না। এরপর রাত ১১টার দিকে সে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙার পর পাশের কক্ষে গিয়ে জাহিদুল ইসলাম রায়হানের ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায়।

দ্বীপের কাছ থেকে পাওয়া ওই হোস্টেলের অপর দুই আবাসিক ছাত্রের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার জানায়, হোস্টেল সুপারসহ কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন করে থাকে। পান থেকে চুন খসলেই মারধর করা হয় তাদের। কলেজ থেকে বের করে দেয়াসহ রেড টিসির ভয় দেখায় কর্তৃপক্ষ। তবে এসবের প্রতিবাদ করার কোনো ক্ষমতা কারও নেই।

জাহিদুলের বাবা সাকের উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ছেলের ফোন পাওয়ার পর তিনি নিজেই রাত সাড়ে ১১টার দিকে হোস্টেল সুপার ওমর ফারুকের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এ সময় তিনি ওমর ফারুকের কাছে কী ঘটেছে তা জানতে চান। ওমর ফারুক তাকে জানান, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি তার ছেলেকে মারধর করেছেন। কিন্তু ওই সময় ওমর ফারুক কারণ উল্লেখ করেননি।

সাকের উল্লাহ জানান, ওই সময় ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তিনি মোবাইল ফোনটি দেননি। ভোরে ফোন করে কথা বলতে চাইলেও হোস্টেল সুপার ওমর ফারুক জানান, জাহিদুল ঘুমাচ্ছে। জাহিদুলের চাচাতো ভাই তারেক অভিযোগ করেন, তার ভাইকে পিটিয়ে হত্যার পর এখন আত্মহত্যা বলে চালোনোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

এদিকে শুক্রবার কলেজের হোস্টেল থেকে জাহিদুল ইসলাম রায়হানের লাশ উদ্ধারের পর হোস্টেল সুপারসহ দুই জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শনিবার তাদের আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

ভাটারা থানার ওসি সরওয়ার হোসেন বলেন, এ ব্যাপারে ভাটারা থানায় হত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় মামলা হয়েছে। এতে হোস্টেল সুপার ও সহকারী সুপারকে দায়ী করা হয়েছে।

লাশ উদ্ধারের সময় জাহিদুল ইসলামের হাঁটু মেঝে পর্যন্ত ঝুলে থাকা প্রসঙ্গে ভাটারা থানার অপারেশন অফিসার এসআই হালিম যুগান্তরকে জানান, মৃত্যুর পর দীর্ঘক্ষণ ফাঁসিতে ঝুলে থাকলে দেহের ভারের কারণে অনেক সময় লাশ নিচে নেমে আসতে পারে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে চীনে অবস্থানরত ক্যামব্রিয়ানের চেয়ারম্যান এমএ বাশার যুগান্তরকে বলেন, ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে বলে তিনি শুনেছি। এ ঘটনায় যদি কারও গাফিলতি থাকে তবে আইন-অনুযায়ী বিচার হবে।

উল্লেখ্য, এর আগে ১৫ আগস্ট ক্যামব্রিয়ানের গুলশানের ছাত্রীনিবাস থেকে নাঈমা বিনতে নাহিদ (১৪) নামের এক শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নাঈমা ক্যামব্রিয়ানের স্কুল শাখার দশম শ্রেণীতে পড়ত। ওই ঘটনাটিকেও আত্মহত্যা বলে দাবি করে ক্যামব্রিয়ান কর্তৃপক্ষ।
উৎসঃ যুগান্তর

বাংলাদেশ সময়: ০:৫১:৫৫   ৭২৮ বার পঠিত