মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০১৪

সুখ-কাটা–আল রিআন

Home Page » সাহিত্য » সুখ-কাটা–আল রিআন
মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০১৪



 untvvvvvigfgtledthumbnailjpg.png

আজ অষ্টম পর্ব…………..অবশেষে কোন গ্রাম জলমিয়ার সাথে সমন্ধ করিতে রাজি হল না। কারণ জলমিয়ার, বৌমারা ও যৌতুকের জন্য বৌকে তালাক দেওয়ার কার্যকলাপ কোন গ্রামে জানতে আর বাকি নাই। গ্রামের প্রত্যেকটি ঘর খুজেও জলমিয়ার জন্য একটি মেয়ে পাওয়া গেলনা বিয়ে করানোর জন্য। জলমিয়া খুবই নিরাশ হয়ে সে তার দোস্ত চান্দুকে বলল “আমার কি আর নিকা করা অইবো না ?
চান্দু তার দোস্তকে হতাশা কন্ঠে বলল “কি জানি বাপু! মুসলমানের তো একহালি নিকা করার অনুমতি আছে। কিন্তু তুইতো তা ম্যালা আগেই খতম দিছো। আমরা হুজুর হইয়া যে ফরজ কাম করতে পারি নাই তুই তা পারছোস। তোরে তো পুরুস্কার দেওয়া উচিৎ।”
“আমার পুরুস্কার লাগবোন দোস্তো। আমারে এই শ্যাষ বারের মত একটা নিকা করাইয়া দে। আমি আর বৌরে মারমুনা আল্লার কিরা কইতাছি। এই চক্ষু ছুইয়া কইতাছি। আমি তোর পায়ে দরি।”
“আরে পাও ছাড়। আমি তোর জন্নি বউ পামু কই ? সারা গেরাম কত্ত মাইয়া কিন্তু তোর লগে একটারেও নিকা দিবোনা। দেখলিনা মাইয়া দেখতে গিয়া কত অপমান অইলাম। তোর যদি এ্যতই নিকা করার শখ থাকে তায়লে আমার বৌ শেফালিরে নিকা কর। আমার কোন আপত্তি নাই। দোস্তের বউরে নিকা করা মোনে হয় জায়েজ আছে!”
“হাছা কইতাছো দোস্ত। আমি কিন্তু রাজি।”
“জলমেয়া আমার দারে একটা খবর আছে ?”
“কি খবর আছে ? কোন নয়া বউর ভাতার মরছে, আমি তারে নিকা করতে পারমু?”
“আরে না। হুনছি পাশের গেরামের হিন্দু পাড়ায় বলরামের বাড়ীতে নাকি লক্ষী দেবি আইছিল। আশে পাশের দশ গেরামের মানষে নাকি ঐ বাড়ির ব্যাড়া চাট্টি এমন কি লক্ষী দেবির পায়ের পারা যে জায়গায় পরছিলো সে জায়গা দিয়া নাকি মাটি আইন্না খাইতেছে, গলায় তাবিজ বানাইয়া ঝুলাইতেছে। তাতে নাকি মনের আশা পূন্ন হইছে। ম্যালা মানষের নাকি কোমরের ব্যাদনা মাজার ব্যাদনা সব ভালা অইছে। তুই ইচ্ছা করলে বলরামের বাড়ী দিয়া মাডি আইন্না খাইতে পারো। দ্যাখ মাডি খাইলে, তোর নিকা অইলেও অইতে পারে।”
“কতাডা মোন্দ কসনায়। আমি আইজ হিন্দু পাড়ায় গিয়া মাডি আইন্না তিন ব্যালা ভাতের লগে খামু।”
জলমিয়া চলে যেতে না যেতেই ইব্রাহিম এসে হাজির হল চান্দু হুজুরের কাছে। ইব্রারাহিম চান্দুকে বলল “কি চান্দু, তোমারে তো দুই দিন ধইরা গরু খোঁজা খুঁজতাছি। আমারে যে আইতে কইলা হের পর আর তো খোঁজ খবর রাখলা না মিয়া। যদি না পারো তায়লে আমারে আগে থাকতে কইয়া দ্যাও। মিত্যা আশায় ঘুরাইবানা।”
“কি যে কও মিয়া এবরা। তুমি আমারে ভুল বুঝতাছো। আমি কোন দিন মানষেরে মিছা কতা কই না। তুমি তো কইতুরির বাপের কাছে ট্যাকা পাও ম্যালা সোমায় ধইরা। কোন দিন কি হে তোমার ট্যাকা শোধ দিতে পারবো। আর আমি যতদূর জানি তোমার দারেও ট্যাকা পয়সা নাই। তয় নিকা করবা ক্যামনে ?”
“ক্যান ? কইতুরির বাপে আমার ট্যাকা দিবো না কিসের জন্নি। ট্যাকা কি গাঙ্গের জলে ভাইসা আইছে। এবার তার ধানের ফলন ভালা অইছে। আমার ট্যাকা রাখব কি কইয়া। আমি তার কোন কতা আর হুনমু না।”
“যতই ভালা হউক তোমার ট্যাকা কোন দিনই দিবনা। আর যদি কোন দিন দ্যয় তাইলে মনে করবা দুনিয়ায় সেই দিন সুরুয উঠেনায়।”
“তাইলে ট্যাকার অভাবে আমার নিকা অইবোনা ।”
“আরে মিয়া অতো ভাবনার কি আছে। আমি আছিনা। তোমার নিকা আমি দিমু। কিন্তু আমার সব কতা হুনতে অইবো।”
“হুনমু, কি কইবা কও।”
“তুমি কইতুরিরে নিকা কইরা ফালাও। এতে তোমার নিকার ঝামেলাও যাইবো আর ট্যাকার শোধও অইবো। এরেই কয় এক ডিলে দুই পক্ষী মারা।”
“কি কও চান্দু বাই ? এইডা কি আর অয় ? আরো কইতুরি বিয়াইত্বা মাইয়া। আমি তারে ক্যান নিকা করমু।”
“আরে পাগল, কিছুই তো বোঝনা। কইতুরির মতো এতো সুন্দার মাইয়া তুমি কই পাইবা। দলু আইজ বাদে কাইল মরলে সব কিছু তোমার অইবো। তোমার ট্যাকা তো শোধ অইবোই আর পাইবাও বেশি বেশি। একবার ভাইব্বা দ্যাহ কইতুরির নয়া যৌবনের বিশাল সমুদ্রে তুমি একলাই সাতার কাটবা। মাঝে মদ্দ্যে ডুবও দিতে পারবা। আরে মিয়া আমারে কেউ এমন প্রস্তাব দিলে আমি ডাইনে বায়ে না তাকাইয়া সোজা নিকা করতে রাজি অইতাম। কইতুরী বিয়াইত্বা তাতে কি অইছে, খাঁটি মধু সব জায়গায়ই খাঁটি। রসের লগে তার তুলনা অয়নি।”
“কইতুরি কি আমারে নিকা করতে রাজি অইবো ?”
“অইবো মানে। কইতুরিই আমার হাতে পায় ধইরা কইলো। সে তোমারে তার নিকার আগে থাইক্কা মনে মনে পছন করতো। তুমি মিয়া, এতিম একটা মাইয়ার উপর বেরহম কইরোনা। এতিম কোন মাইয়ারে নিকা করলে কত্ত সোয়াব তুমি জানো ?”
চান্দুর পরামর্শে ইব্রাহিম আগ-পাছ না ভাবিয়া রায় দিয়ে বলল “ঠিক আছে আমি রাজি। কইতুরির বাজানরে আমার বাড়ীতে প্রস্তাব নিয়া আইতে কও।”
“আলহামদুল্লিলাহ্! শ্যষ ম্যষ তোমার শুমতি অইলো। এবরা বাই তুমি বাড়ি যাও আমি দলু চাচারে নিয়া দুই চাইর পাঁচ দিনের মধ্যে তোমার বাড়ি প্রস্তাব নিয়া আমুনে।”
“ঠিক আছে, আমি বাড়িতে যাই চান্দু বাই।”
ইব্রাহিম ও কইতুরির বিবাহের মাধ্যমে চান্দুর এক বিশাল আশা বাস্তবায়িত করতে চায়।
এদিকে হিন্দু পাড়ায় লক্ষী পূজার পর থেকেই বলরামের বাড়ীতে দিনকে দিন মানুষের ভীড় বেড়েই চলেছে। ধন রতেœর রানী লক্ষী দেবী সয়ং বলরামের বাড়ীতে এসে তার পায়ের ধুলা দিয়েছে এটা কি চারটি খানি কথা। এ জন্য মানুষ বলরামের ঘরের বেড়ার খড় ও মেঝের মাটি সংগ্রহ করে নিজের সাথে রাখে। কেহ কেহ আবার মেঝের যে যে অংশে লক্ষী দেবীর পা পরেছে সে অংশ থেকে মাটি সংগ্রহ করে তাবিজে ভরে গলায় ঝুলিয়ে রাখে তাতে নাকি তাদের অনেক রোগ আরগ্য লাভ করেছে এবং অনেকে এ মাটি আটার মত গুরা করিয়া খাবারের সাথে মিশিয়ে খেয়েছে তাদের বহু পুরাতন ব্যধি সহ অনেক কঠিন মনের বাসনা পূরণ হয়েছে। অনেক হিন্দু বলরামের ঘরের বেড়া ভাঙ্গিয়া অল্পকিছু ছণ এনে নিজের ঘরের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে, এতে নাকি কোন আপদ বিপদ অমঙ্গল বাড়ীর চারি পাশে ভিরতে পারবেনা। মানুষের শোনা শুনি জলমিয়া আজ কয়েক দিন ধরে নয়া একটা বিবাহের নিয়তে ভাতের সাথে মাটি খাচ্ছে। নাক মুখ আঁকা বাঁকা করে অনেক কষ্টে ভাতের সাথে কাদা মাটি খাচ্ছে। সকল কষ্ট সহ্য করতে কোন আপত্তি নাই। যদি এবার জলমিয়া নতুন একটা বিবাহ করতে পারে।

দলুর দূর সর্ম্পকের জ্ঞাতী খুড়া মকবুল মোল্লা। সে থাকে মানিকদের ভিটার তিন চার ভিটা পর। তার পতœী বিয়োগ হয়েছে কম করে হলেও কুড়ি বছর। তার ছেলে মেয়েরা বিয়ে করে আলাদা আলাদা বাড়ীতে থাকে। পল্লীর একই পরিবারের লোকজন বিশেষ করে ভাই-ভাই বিবাহের পর আর একই পরিবারে টিকে থাকতে পারেনা। বিভিন্ন কলহের সৃষ্টি হয়। ঝগড়া যখন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয় তখন আলাদা হওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকেনা। বাধ্য হয়ে পিতৃ সম্পত্তি ভাগ করে নেয়। এই ভাগের কারণে কৃষি জমির উপর অনেক আঘাত হানে। মকবুল মোল্লার পরিবারের মত গ্রামের আশিটি পরিবার অভাব অনটনকে কেন্দ্র করিয়া ঝগড়া বিবাদের সৃষ্টি হয় ফলে বড় বড় পরিবারগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে কৃষি জমিতে বসতী স্থাপন করে। মকবুল মোল্লার বিশাল বাড়ী। বয়স কম হলেও সত্তর পেরিয়ে যাবে। বৃদ্ধ মানুষ, একা চলা ফেরা করতে অনেক কষ্ট হয় বলে প্রতিবেশীরা মিলে গত পৌস মাসে পনের বছরের তরুনী ফাতেমার সাথে নিকাহ দেন। এক বছর পূর্ণ হতে না হতে মকবুল মোল্লা ফাতেমাকে অনেক বার ই মেরেছেন। বউ মারার অভ্যাসটা তার অনেক দিনের। শত হলেও ফাতেমা তার নাতনীর বয়সী একটি মেয়ে। তার মধ্যেতো একটু চাঞ্চাল্য ছেলেমানুষি থাকতেই পারে। কিন্তু মকবুল মোল্লা তা মানতে নারাজ। বৃদ্ধ বয়সে তার রাগটা নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারেনা কিছুতেই। ফাতেমা স্বামী সংসার বুঝাতো অনেক দূরের কথা, সে এখনও পুতুল খেলার মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। মাঝে মাঝে এসব ছেলে মানুষি দেখে সহ্য করতে না পেরে ফাতেমাকে বেদম মার মারে যা তাকিয়ে দেখার মত না। স্বামী হৃদয়হীনের মত ফাতেমাকে মারতে থাকে আর ফাতেমা ওমাগো বাবাগো বলে স্বজোরে চিৎকার করতে থাকে। মারতে মারতে নাক মুখ থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত রক্ত বের না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আর থামেনা মকবুল মোল্লা। কয়েক দিন আগে এমন করে মারতে মারতে রাগের মাথায় ফাতেমাকে তিন তালাক দিয়েই দিল। মকবুল জানে ফাতেমাকে ছাড়া তার এক মূহুর্তও চলবেনা। মকবুলের তিন ছেলের বউ শ্বশুরের দিকে ফিরেও তাকাবেনা। মরলো কি বাঁচলো তাতে তার ছেলেদের কিছুই যায় আসে না। ফাতেমাকে তালাক দেবার পর আজ তিন চার দিন ধরে মকবুলের ঘরের চুলায় আগুন জ্বলে না। ফাতেমা এ ঘরে ওর ঘরে ঘুমায়। গ্রামে তালাক দেওয়া বউকে আবার ঘরে তুলতে হলে হিল্লে বিয়ে দিতে হয়। এ ছাড়া মকবুলের আর কোন পথ নাই। গাঁয়ের মানুষ হিল্লে বিয়ের জন্য জিলানি হুজুরকে খবর দিল। সে দিন সকালে মকবুল মোল্লার বাড়ীর উঠানে আরো অনেক মানুষ ভীড় জমিয়েছে হিল্লে নিকাহ্ দেখার জন্য। জিলানী হুজুর বলে “হিল্লে নিকার নিয়ম হল আগে ফাতেমাকে অন্য এক জনার সাথে নিকা পড়াইয়া দিতে হবে। তারপর ফাতেমার নয়া ভাতার তালাক দিলে মকবুল বাই কলেমা পইরা ফাতেমারে ঘরে নিতে পারবো।”
জিলানীর কথায় মকবুল রাজি না হয়ে বলল “আমি এত কিছু বুঝি না আমার কলেমা পড়া বউ আমি তালাক দিমু যা খুশি করমু তাতে কার কি, রাগের মাথায় তালাক দিছি। এহন আমার লগে ফাতের নিকা পড়াইয়া দেন।”
“নাউযুবিল্লাহ, কি কও এই কাম সম্পূর্ন না যায়েজ। ফাতেমারে অন্য এক পর পুরুষের লগে নিকা দিতেই অইবো। আমি শরিয়তের বাইরে তো যাইতে পারমুনা।”
“কার লগে নিকা দিমু ? সে যদি আমার ফাতুরে তালাক না দ্যায়।”
এই নিকাহ-তালাকের মজলিশে অনেকের মধ্যে জলমিয়াও উপস্থিত ছিল। মকবুল মোল্লা-জলমিয়ার দূর সর্ম্পকের নানা হয়। এই সর্ম্পকের রেশ ধরিয়া মকবুল মোল্লা হঠাৎ ভাবিয়া দেখিল আর কাউকে না হোক অন্তত জলমিয়াকে এই হিল্লা বিয়ের ব্যপারে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যেতে পারে। সে নাতি হয়ে নানার বউ নিয়া ভাগিয়া যাবেনা। হিল্লে বিয়েটা জলমিয়ার সাথে দিলে মন্দ হয়না। মকবুল মোল্লার সকল সম্পত্তি অর্থাৎ বিঘা পাঁচেক ধানের জমি সহ বসত বাড়ীটুকো ফাতেমার নামে রেজিষ্ট্রেরি করা। মকবুল মোল্লা যখন ফাতেমাকে নয়া বিবাহ করেছিল তখন এসব সম্পত্তি ফাতেমার নামে দিয়ে তাকে ঘরে তুলেছিল। মকবুল মোল্লার সেখানেই বেশি ভয়, কারো সাথে হিল্লে বিয়ে দিলে বউতো যাবেই তার সাথে যাবে তার সকল সম্পত্তি। তারচেয়ে বরং জলমিয়াকে আধা বিঘা জমি দেবার লোভ দেখিয়ে আমার কাজ হাসিল করিয়ে নাইবা দিলাম। কিছুক্ষণ পরে মজলিশের মধ্যে বসা জলমিয়াকে হাত ইশারা করে মকবুল মোল্লা ডেকে বলল “নাতি, তুই একটু আড়ালে আয়। তোর লগে আমার একটু কতা আছে।”
“কি কতা নানা ?”
“এদিক আয়।”
মকবুল মোল্লা মজলিশ হতে একটু আলাদা হয়ে জলমিয়াকে বলে
“নাতি আমার একটা উপকার কইরা দিবি।”
“কি কন নানা। কি উপোকার লাগবো একবার কইয়া দ্যাখেন।”
“আমি জানি জলমিয়া তুই পারবি। আমার কামডা ঠিক ঠাক করলে আমি তোরে দুই দিনের মধ্যে নয়া নিকা করাইয়া দিমু তো দিমুই। আরো ট্যাকা পয়সাও দিমু। মাইনে নিকার সব খরচ আমিই দিমু। তুইতো পরের জমিতে বদলা কাম করো, আমি তোরে আধা বিঘা জমি দিমু আর মানষের জমিতে তোর কাম করা লাগবোনা।”
জলমিয়া এত কিছু পাবে শুনিয়া নানার পায়ে হাত দিয়ে কদমবুচি করে দোয়া নিয়ে নানাকে বলে “নানা, তুমি খালি হুকুম করো। আমি থাকতে তোমার কোন চিন্তা লাগে।”
“নাতি তুই আমার ফাতুরে নিকা কইরা আবার লগে লগে তালাক দিবি। ফাতু কিন্তু তোর নানী অয়। তার দিক অমন কইরা তাকাইশ না, তাতে পাপ অয়।”
“তুমি নানা চিন্তা লইয়না। আমি নিকা করমু আর তালাক দিমু। তুমিতো জানো নানা আমার তালাক দেওনের অভ্যাস আছে। আগে চাইরটা তালাক দিছি। তয় একখান কতা আছিলো।”
“ক নাতি, তুই কি কবি জোলদি কইরা ক। মজলিশের মানষে রাগ করবো।”
“নানা, এসব কাম বাকী অয়না। নগদ নগদ করোন লাগে।”
“কি কবি খোলাসা কইরা ক।”
“তোমার কাম অইলে তুমি যদি আমারে জমি না দ্যও। আগে আমারে জমির দলিল দ্যও। পরে আমি হিল্লা নিকা করমু।”
“ঠিক আছে ঠিক আছে, তুই খাড়া আমি জমির দলিল আনতাছি।”
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মকবুল মোল্লা ঘর থেকে একটা দলিল এনে জলমিয়ার হাতে দিয়ে বলল “বিশ্বাস আর অইলোনা। এই নে তোর জমির দলিল। হুন জলমিয়া আমার কতা আমি রাকছি তোর কতাও তুই রাখিস,নাইলে তুই কিন্তু চ্যাল চ্যালাইয়া জাহারনামে যাবি কতাটা মোনে রাখিস।”
“নানা আফনে আর কিছু চিন্তা লইয়েন না। আফনে আমার যে উপকার করলেন আমি এ ঋণ কোন দিন শোধ দিতে পারমুনা। আর পারলেও দিমুনা।”
মকবুল মোল্লা মজলিশে এসে হুজুরকে বলে “আফনাগো সবাইরে সাক্ষী রাইখা জলমিয়া নিকা করতে রাজি অইছে, সবাই কও আলহামদুল্লিলাহ্।
জিলানী হুজুর আবার সবার সামনে জলমিয়াকে বলল “কি জলমিয়া তুমি ফাতুরে নিকা করতে রাজি আছো তো।”
“হ, আমি এই নিকায় রাজি আছি।”
উঠানে সবার সামনে জিলানী হুজুর জলমিয়াকে কলেমা পড়িয়ে ফাতেমার সাথে নয়া নিকা দিয়ে মোনাজাত ধরলেন। এরপর মকবুল হাত ইশারা দিয়ে তারাতারি করে তালাক দেবার জন্য তাগাদা দেয় জলমিয়াকে। যতক্ষণে জলমিয়া তালাক না দেয় ততক্ষণে মকবুলের চিন্তা বারিয়াই চলেছে। জলমিয়া যদি কোন কারণে ফাতেমাকে তালাক না দেয় তাহলে মকবুল মোল্লার আম ছালা দুটোই যাবে। মকবুল মোল্লা মজলিশের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলল “জলমিয়া এবার তুমি ফাতেরে বাইন তালাক দেও।”
জলমিয়া উঠানের মধ্যে ফাতেমার হাত ধরে বসে আড় চোখে কেবলি মকবুল মোল্লার দিকে তাকাচ্ছে। সে ও বুড়ো বয়সে বড় বড় চোখ করে জলমিয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুলছে। জিলানী হুজুর ব্যাপারটি লক্ষ্য করে জলমিয়াকে বলল “জলমিয়া, তুমি কি করবা জোলদি করো। তালাক দিতে চাইলে দাও। আবার নিকা পরাইতে অইবো।”
জলমিয়া ফাতেমার হাতটি ধরে দাঁড়িয়ে বলে “না হুজুর, আমি তালাক দিমু না। আফনে হুজুর হইয়া তালাক দিতে কন, জানেন না তালাক দেওন পাপ। ফাতু আমার কলেমা পড়া বউ, আমি তারে তালাক দিমু ক্যান।”
ফাতেমা জলমিয়া দিকে তাকাইয়া বলল “মকবুলের মত তুমি আমারে তিন ব্যালা খাওন পরোন দিতে পারবা। না পারলে ওক্ষণ তালাক দ্যাও। মকবুল আমারে মারলেও ঠিকমত খাওন পরোন দেয়। বাপের বাড়ীও তিন ব্যালা খাওন পরনে অনেক কষ্ট করছি, কষ্ট আর করমুনা দেইখা এই বুড়ার লগে নিকা বইছি। খিদার যে কি কষ্ট হেইডা আমি ভালা কইরা জানি।”
“বুড়া মকবুল আইজ বাদে কাইল মরবো। তহন এমনিতেই তোমার বিধবা অওন লাগবো। তারচেয়ে আমার লগে লও, আমি তোমার ভাতার। আমি বুঝমু তোমার কহন কি লাগে। সবাই আমাগো জন্নি দোয়া করবেন। মকবুল নানা আমার আর ফাতুর জন্নি দোয়া কইরেন। শত অইলেও আপনার নাত বউ।”
জলমিয়া উঠানের ভরা মজলিশের মধ্য হতে ফাতেমা নিয়ে চলে গেল। মকবুল মোল্লা অতি রাগে জলমিয়াকে বলল “হালা বেঈমান, মোনাফেক।”
চান্দু হুজুর জলমিয়ার নিকাহর কথা শুনিয়া আফসোসে মরিয়া যাচ্ছে। সে যদি এমন একটা সুযোগ পেত, তাহলে আর গরিব থাকত না। চান্দু আফসোস করে আর বলে “ইস্, পাঁচ বিঘা ধানা জমি আরো কত্ত বড় ভীটা বাড়ী। জলমিয়া নিকা কইরা এহন রাজার হালে থাকবো। আর আমি শিউলিকে ভাগাইয়া নিকা কইরা সয় সম্পত্তি তোকিছুই পাই নাই বরং মাইর খাইয়া দুই দিন হাজত বাস করছি। এরেই কয় কফাল। আফসোস আফসোস”

জোৎসনা রাত। আকাশ ভড়া তারারা আধটুকরো চাঁদটিকে ঘিরে রেখেছে। মৃদু বাতাশ বইছে। নয়া যৌবন যে সব ছেলে মেয়েদের কে ছোঁয়া দিয়ে গেছে এই বাতাশ তাদেরকে স্বাগত জানাতে দোল দিয়ে যায়। জোৎসনার আলোতে গ্রামের পথগুলো যেন জ্বল জ্বল করছে। কোথাও আড়াল খুঁজে পাচ্ছেনা, মানিক পরীর মত নয়া প্রেমিক প্রেমিকারা। বাঁশ বাগানের আড়ালে বসে পরী মানিককে বলে “তুমি ক্যামন গো চাষী। গেরামে নিকার ধুম পইরা গেছে সবাই জামাতে নিকা করতাছে। তুমি নিকা করবানা ? নাকি এখনোও তোমার নিকার বয়স হয়নায়।”
“বয়সতো ম্যালা আগে পারাইয়া গেছে। মায় দুই চাইর দিনের মধ্যে ঘটক চাচারে দিয়া তোমাগো বাড়ীতে পোস্তাব পাঠাইবো।”
“চাষী, তুমি শ্যাষ কালে আমারে ভুইল্লা যাইবা না তো। অনেক মানষে প্রেত্থম প্রেত্থম ভালবাইসা পরে ছ্যাকা দিয়া চইল্লা যায়। মারতে যদি হয় আমারে গলা টিপে একবারে মারো। তবুও ছ্যাকা দিয়া মাইরো না। মনের মানু হারনোর কি যে কষ্ট।”
“তুমি তো আমার যান। তোমারে মারলে আমি বাঁচমু ক্যামনে। এমন কইরা আমার বুকে সারা জীবন থাকতে পারবা।”
“হ পারমু। তয় তুমি কিচ্ছু বোঝনা, কিচ্ছু পারোনা।”
“কও, আমি কি পারিনা। আমি তোমার একটু হাসির জন্নি সাত সাগর পারি দিয়া মুক্তা আইনা দিতে পারি।”
“না, তুমি কাপুরুষ। তুমি আমার সুখের জন্য কিছু পারোনা।”
“তোমার সুখের জন্নি, আমি কিচ্ছু পারিনা ? একবার কও পরী আমি কি পারিনা ? সাত আসমান পার হয়ে তোমার সুখের জন্নি আমি নূরের আর্শ্চায় পাথর আইন্না দিতে পারি। আমি রাখাল থেকে বীর পুরুষ হতে পারি। মহা নায়ক হতে পারি কেবলি তোমার জন্য।”
“আমি কইতাছি তুমি কিচ্ছু পারোনা। তুমি বীর পুরুষ না …
“তুমি একবার কও। আমি কি পারিনা।”
“চাষী,তুমি কি পারোনা ঐ চান্দের মত নিলজ্জ হতে। তুমি কি পারোনা আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু বেহায়য়া হতে। বলো তুমি কি পারোনা আমাকে আপন ভাবতে। তুমি কি পারোনা ঐ বাতাশের মত আমার সারা শরীরে তোমর অনুভুতি লেপে দিতে।”
“পারি। কেবলি তোমর জন্য আমার ভালবাসার জন্নি আমি আরও কিছু পারি।”

কুদ্দুস ফকির এখন আর আগের মত ভিক্ষা করেনা। কোন মতে এক সের চালের ব্যবস্থা হলে বাড়ী চলে যায়। সে ইদানিং পিংড়ী গ্রাম ছাড়া ভিক্ষা করেনা। কিছুদিন আগে যে গ্রামে মারামারি করে এসেছে সে গ্রাম তার কাছে এখন অভিশপ্ত এক এলাকা। কুদ্দুস ফকির এখনও জানে তার হাতের ছাতার আঘাতে এক লোকের মৃত্যু হয়েছে। সেই ভয় নিয়ে গ্রামে মাঝে মাঝে ভিক্ষা করে। তবে ভিক্ষার সময় চারিদিকে চোখ কান খোলা রাখে সে, কোন সময় কোন দিক দিয়ে আবার পুলিশ দারোগা এসে পরে। সকাল গড়িয়ে প্রায় বিকাল হয়ে এসেছে। কুদ্দুস ফকির বাড়ী ফিরবে এমন সময় এক ডাকহরকরা ঐ পথেই আসছে। তার গায়েও পরিধান করা ছিল দারোগাদের মত খাকি পোষাক। কুদ্দুস ফকির ডাকহরকরাকে দেখে ভাবল “তাইলে বউ আমার হাছাই কইছে, তারা আমার নামে মামলা করছে ঠিকই। ওনিই মনে অয় দারোগা অইবো, আমারে ছাগল খোজা খুঁজতাছে।”
এরপর কুদ্দুস ফকির তার হাটার গতি কমিয়ে, পরনের র্কোতা লুঙ্গিটাকে ডান হাতে তুলে দিল এক দৌড়। সারাদিনের কামাই খুতি ভরা চাল রাস্তার মধ্যে ফেলে দিয়ে নিজের জীবন নিয়ে পালালো সে। ডানে বামে কোন দিক না তাকিয়ে ক্ষেতের পর ক্ষেত পেরিয়ে আশ্রয় নিল এক বেত বাগানের মধ্যে। ওখানে অনেকক্ষণ অবস্থান করার পর যখন সে বের হবে তখন আর উপায় পেল না। চারিদিকে কেবলি বেতের কাটা। মনের আতঙ্কে সে কোন কিছু বিবেচনা না করেই সোজা বেত বাগানে ঢুকে ছিল, কিন্তু তার মনের মধ্যে থেকে যখন চিন্তার কিছু অবসান ঘটেছে তখন সে আর বেত বাগানের বেতকাটার জন্য বাহিরে আসতে পারছে না। আর বেত বাগান এমনি এক জায়গায় যেখানে মানুষের আনা গোনা খুবই কম। সে নিজের সাথে নিজে রাগ করে বলল “দূর হালার কোন কিছছার মধ্যে যে পরলাম। রাইত অইয়া যাইতেছে। ক্যমনে বাইর হমু, বাড়ীতে বউ আমার চিন্তা করবো, সারাডা দিন আমিও না খাওয়া। খিদায় আমার প্যাটটা জলতাছে।”
কুদ্দুস ফকির অনেকক্ষণ চিৎকার চেচামিচি করে লোক ডাকবার চেষ্টা করেছিল বটে। কিন্তু কোন লাভ হয় নাই। এদিকে দিনের আলো নিভে সন্ধ্যা হতে আরম্ভ করল। আজ সন্ধ্যায় ইব্রাহিম কইতুরির মধ্যে কিছু গোপনে আলাপ হবে। বিবাহের আগে তারা নিজেদের মধ্যে কিছু ভাব বিনিময় করতে চায়, জন সাধারণের আড়ালে। এই জন্য ইব্রাহিম কইতুরিকে লোক মারফত খবর দিয়ে জানিয়েছে আজ সন্ধ্যার পর কইতুরি যেন তাদের বাড়ীর দক্ষিন পাশের বাগানে আসে, সেখানে সে অপেক্ষা করবে। কতদিন সে কইতুরীদের বাড়ীতে গেছে তাদাগার জন্য কিন্তু আজ সে কইতুরির সামনে যেতে বেশ লজ্ঝা অনুভব করছে। সকাল থেকেই ভাল জামা কাপড় পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু মাথা আশ্রাছে আর তার চেহারায় ক্রিম মালিশ করছে। ছেলেরা প্রেমে পড়লে যা হয় আর কি, আয়নার সামনে দাড়িয়ে ঘন ঘন মাথা আশ্রানো। কইতুরি নারী, তার মধ্যেও আছে অগাধ প্রেম ভালবাসা। সেও তার যৌবন তরীতে একজন পাকা মাঝি চায়। তাই রাতের বেলা বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ইব্রাহিমের সাথে দেখা করার জন্য বাগানে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘন অন্ধকার, কেহ কোথাও নাই। কইতুরীর পাশের ঝোপটাতে বন্ধি ছিল কুদ্দুস ফকির। সে ঝোপের মধ্যে বন্ধি হয়ে ক্ষুদার যন্ত্রনায় কোকরাতে লাগল। সেই কোকরানোর শব্দ শুনে কইতুরি একা একা ভয় অনূভব করছে। ইতিমধ্যে ইব্রাহিমও এসে উপস্থিত হলো। কইতুরি-ইব্রাহিমকে দেখা মাত্র লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেল। প্রথমে দু জনেই চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। প্রথম প্রেম করতে গেলে যা হয় আর কি ? কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা ওরা দু জন। ইব্রাহিম কিছু বলবে বলবে ভাব নিলেও বলতে পারছেনা। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাদের মধ্যে লুকানো আবেগ আর সবুর করতে পারলোনা। দু জন দুজনাকে অতি কাছে টেনে নিল। তাদের মনের মধ্যে যত ব্যথা, কষ্ট ছিল সব উজার করে দিল একে অপরকে।
“তুমি আমার মত একটা বিয়াইত্বা মাইয়ারে নিকা করতে রাজি অইলা ক্যান। কয়দিন বাদে আবার ভুইল্লা যাইবানা তো।”
“না। কোন দিনও না। আমার এই দেহোর মদ্যে যতক্ষণ পরান থাকবো ততক্ষণ আমি তোমারে ভুইল্লা যামু না। আমি তো তোমার অর্থ সম্পদ দ্যাইখা তোমারে নিকায় মত দিনাই। ভালবাইসা তোমারে নিকায় মত দিছি।”
“আমিও তোমারে ভালবাসি।”
কুদ্দুস ফকির ওদের সব কথা শুনছে। তবে কারো সাথে কারো কোন চেনা জানা নাই, কি নামে ডাকবে, তখন বাঁচার জন্য কুদ্দুস ফকির ভাষা হীন শব্দ করে সাহায্য চাইল নব প্রেমিক প্রেমিকার কাছে। ইব্রাহিমের বুকে মাথা রেখে কইতুরি দু চারটা মনের কথা বলবে তা আর পারলোনা। কুদ্দুস ফকিরের শব্দে তার ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল। কইতুরী ধীরে ধীরে বলল “জোঙ্গলে ভূত আছে।”
ইব্রাহিম নিজেকে সাহসী পুরুষ হিসাবে জাহির করার জন্য বলে “কিসের ভূত। আমি ভূত, শয়তান এসব কিছু ঢড়াই না। আমরা মোনেহয় ভুল হুনছি। বাত দেও তো আও কাছে আও তোমারে একটু চান্দের আলোতে মন ভইরা দেহি।”
” আমার না ঢড় লাগতাছে। ভুত নাও হইবার পারে, তয় আমার কেমন কেমন লাগতাছে এবরা বাই।”
কুদ্দুস ফকির আবার বলে উঠল “বাইগো আমি ভূত টুত কিছু না, আমি একজন খয়রাতি। আমারে বাঁচান বাই। আমি ব্যাত কাডার মদ্যি আটকা পরছি।”
ইব্রাহিম এবার চোখ গুলো বড় করে পাকিয়ে কইতুরীর হাত ধরে বলল “তুমি হাছাই কইছো, এই জোঙ্গলে ভূত আছে। আমি নিজের কানে হুনছি। আমাগো নজর বন্ধি করছে, দ্যাহোনা আমার হাত পাও কিচ্ছু চলেনা।
অতিরিক্ত ভয়ে ইব্রাহিম কাতর হয়ে গেছে তাই তার মনে হচ্ছে ভুতে তার পা টানিয়া ধরেছে। হাত দুটোকে কয়েক বার ঝেড়ে বলল
“কইতুরী কি হইলো, দ্যহো আমার হাত পাও ক্যামন জিম দিয়া গ্যাছে।”
এরপর ইব্রাহিম ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে কইতুরীর কোলে ঢলে পড়লো। ইব্রাহিমের মত একটা তাগড়া জোয়ানকে কইতুরী অনেক বার ধাক্কা ধাক্কি করে সুস্থ করে বলল “তরাতরি পলাও।”
ভুতের ভয়ে বিয়ের আগে মধুর প্রেম আলাপটি আর জমে উঠতে পারলোনা।

ভোর হওয়া না পর্যন্ত জঙ্গলেই থাকতে হল কুদ্দুস ফকিরকে। রাত য়ে কত বড় তা হারে হারে টের পেয়েছে সে। রাতে কত প্রাণী যে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলা ফেরা করে আর তাদের ভয়ংকর আওয়াজ শুনতে হয়েছে তা সেই ভাল জানে। বহু অপেক্ষার পর র্পূবাকাশে সূর্য উঠেছে কুদ্দুস ফকিরের জন্য। মানুষের আনাগোনা হতেই কুদ্দুস ফকির বেত বাগান থেকে মুক্তি পাবার জন্য নানা রকম কাকুতি মিনতি করল। অবশেষে মানুষ জন দাঁ দিয়ে বেতের ঝোপ কেটে তাকে উদ্ধার করল। মানুষের কাছে তার পরিচয় একেবারেই অচেনা নয়। গ্রামের সবাই জানে সে একজন নাছর বান্দা বেহায়য়া দিন ভিক্ষারি। কি কারণে সে এই বেত বাগানে রাত উদযাপন করলো তা নিয়ে কারোই কোন মাথা ব্যথা নেই। প্রত্যেকেই অতি ব্যস্ত। ঘরে বাইরে অনেক কাজের চাপ। এখন অনেক রাত পর্যন্ত শোনা যায় ঢেঁকিতে ধান ভাংগার শব্দ। বাড়ীর বউয়েরা রাতের ঘুম হারাম করে মণকে মণ ঢেঁকিতে ধান ভানে। এসব ধান ভানার কাজে বাড়ীর পুরুষরা মোটেও সময় দিবেনা তাদের স্ত্রীদের। তবে এর মধ্যে মানিকের কথা আলাদা, মানিকের ভাগে পাওয়া ধানগুলো, মানিককেই ভানতে হয় তার ভাবিদের সাথে থেকে। কারণ মানিকের বাড়ীতে একটি ঢেঁকিও নেই ধান ভানার জন্য। আর থাকলে বা কি হতো, মানিকের মা বৃদ্ধা মানুষ সে কোন অবস্থাই ধান ভানতে পারতোনা। মানিক যখন নিজের ধান ভানে তখন তার ভাবিরা সে সুযোগে তাদের ধানগুলো ভানিয়ে নেয়। ঢেঁকিতে ধান ভানতে ভানতে যখন মানিকের সারা শরীর থেকে ঘাম দর দর করে বেয়ে পরে তখনও মানিক নিঃশব্দে ঢেঁকিতে পাড় দিতে থাকে। মানিকের এই সরলতাকে তার ভাবিরা বুদ্ধির অভাব বলে মনে করে আর তারা জায়ে জায়ে হাসাহাসি করে। ঢেঁকির ছিহা শুকনো ধানের উপড় পরতে পরতে ধানগুলো খসে নতুন চাল বের হয়ে আসে। গ্রামের মানুষ এই চাল দিয়ে প্রথমে বিভিন্ন রকম মিষ্টি খাবার রান্না করে খায়। এবং সকাল বেলা নতুন চালের গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা ও আচারের তেল থাকবেই। গ্রামের এ সব ঐতিহ্যের মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য হল পৌস মাসের রসের সিন্নি। আর সপ্তা খানিক পরেই আসছে, শীতের মাস পৌস। সে সময় প্রত্যেক বাড়ীতে রসের সিন্নি রসের চা তৈরী করে। এই রস দিয়ে অনেকে আবার গুর তৈরী করে। রসকে অনেক বার তাপ দিয়ে ঘন করে মাটির হাড়িতে জমা করে রাখে। এই জমানো রসের মধ্যে কিছুদিন পরে চিনির মত দানা তৈরী হয়। এই দানাকে গ্রামের মানুষ তাদের ভাষায় রওয়া বলে। কবে রসের সিন্নি খাবে, সেই আশায় গ্রামবাসীরা এখনও অপেক্ষা করছে। পৌস মাস আসার আগেই হাতে গোনা অল্প কয়েক জন কৃষক খেজুর গাছে রসের জন্য হাড়ি পেতেছে। এখনও গাছে পুরো পুরি রস আসেনি। পৌস মাসের দশ বার তারিখের পর থেকেই গাছে পুরো দমে রস আসবে। এখন সারা রাতে আধা হাড়ির মত রস হয়। হামিদ শিকদারের বিশাল পরিবার বলে সে তার সব গাছেই হাড়ি পেতেছে। আধ হাড়ি করে হলেও তার প্রতিদিন দশ হাড়ির মত রস আসে। হামিদ শিকদার তার বিশাল সন্তান বাহিনী নিয়ে লাইন দিয়ে খেজুর গাছ ঝুড়ছে। কদম আলী কোথা থেকে যেন হন্ত দন্ত হয়ে আসছে। তখন হামিদ শিকদার তাকে ডেকে বলে “কিরে কদম, এবার কি খেজুর গাছের রস খাবিনা। না সব গাছ র্বগা দিছোস।”
“র্বগা দিমু কারে, এই গেরামের সবাই তো মাইড্ডা জমিদার অইয়া গেছে। নিজের কাম নিজেরই করোন লাগে।”
“গেছিলা কই ?”
“গেছিলাম একজন বদলা খুজতে। বাড়ীর সামনের পুকুরডা কাদা প্যাকে ভইরা গেছে, নাইতে নামা যায় না। খাওন লওন তো ঐ পুকুরের পানি দিয়াই করা লাগে। ডিপ টিউবয়েল তো ম্যালা দিন দইরা নষ্ট অইয়া রইছে। এ্যত ট্যাকা দিয়া কে সারাইবো। কার এ্যতো ঠ্যাকা।”
“তা হিকদার তোমার কাম কাইজের কত দূর। ক্ষ্যাতে ধানের বীজ বুনবানা।”
“হ, বুনমু। কাইল হাডে যাইয়া ধানের আডি কিনমু।”
“ও ভালা কতা, আমাগো গেরামে নাকি ইঞ্জিয়ার আইবো।”
“ইঞ্জিয়ার ? এইডা আবার কি ?”
“আমিও ভালামত জানিনা। তয় মানষে কানাকানি করতাছে, আমাগো ধান সিঁড়ি নদীর উফরে নাকি পোল বানাইতে শহোর থাইক্কা আইবো তারা। তাগো নামই ইঞ্জিয়ার।”
“কি কও হিকদার। কার ধান ক্ষ্যাতের মদ্যি আবার পিলার গাথবো।”
“জানিনা। পরের ডা পরে দ্যাহা যাইবো।”
এরপর দু জনে রাস্তার মধ্যে দিয়ে হাটতে হাটতে একই পথে চলে গেল। তারা একই বয়সের বলে তাদের আলাপটা বেশ জমে উঠে।

আগামীকাল হাট বার দিন। কৃষকেরা কাল গরুর গাড়ীতে বস্তায় বস্তায় ধান নিয়ে হাটে উঠাবে। ধান বিক্রির টাকা দিয়ে তারা সাপ্তাহিক বাজার সহ অনান্য বাজার তো কিনবেই তার সাথে বউ ছেলে মেয়েদের জন্য নয়া কাপড় চোপড় কিনবে অনেক কৃষক। অনেক দিন পরে তাদের পকেট ভরে উঠবে টাকায়। দলু পরের বাড়ীতে কাজ করে যে ধান পেয়েছে তা সব বিক্রি করে একটা রাঙা তাতের কাপড় কিনবে বলে নিয়ত করে রেখেছে। ক’ দিন বাদেই তার মেয়ে কইতুরির নতুন নিকা হইবে। অনেক খরচের ব্যাপার আছে। সারা বছরের খোরাকি এক দিনে বিক্রি করেদিলে দলু হাওলাদারের ভিক্ষা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা। তারপরও তার আদরের কন্যা কইতুরির একটা গতি হবে। মা মরা মেয়েটার মুখে কতদিন একটু হাসি দেখে নাই তার বাবা। নিজেকে নিয়ে ভাবেনা দলু হাওলাদার, কন্যাকে পরের বাড়ী বিদায় দিতে পারলে নিজের একটি মাত্র পেট কোন এক ভাবে ঠিকই চলে যাবে। আলতাব মাষ্টারের সাথে কৃষি করলেও বুড়ো বয়সটা দারুন ভাবে চলে যাবে। আলতাব মাষ্টারের পাঠশালায় কোন ছাত্র ছাত্রী আর অবশিষ্ট নাই। পাঠশালার আধ বুড়ো ছাত্র ছাত্রীরা এখন তাদের পিতা মাতার সঙ্গে ক্ষেত খামারের কাজে অনেক মনোযোগী হয়ে উঠেছে। আলতাব মাষ্টারের পাঠশালার বেঞ্চে এখন গরু ছাগল ঘুমায়। তাই মনের কষ্টে আলতাব মাষ্টার ইদানিং কৃষি কাজে উৎসাহী হয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০:৩২:৫১   ১১৭৮ বার পঠিত