রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০১৪

ঠাকুর নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি মহোৎসব শুরু

Home Page » প্রথমপাতা » ঠাকুর নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি মহোৎসব শুরু
রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০১৪



image_9652_0.jpgশরিফুল ইসলামগোদাগাড়ী (রাজশাহী):
আজ ১২ অক্টোবর থেকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ঐতিহ্যবাহি গৌরাঙ্গবাড়ি মন্দিরে শুরু হতে যাচ্ছে তিন দিনব্যাপি ঠাকুর নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি মহোৎসব। প্রেমভক্তি মহারাজ, অহিংসার প্রতিক ঠাকুর নরোত্তম দাসের স্মরণে ১২ অক্টোবর রোববার সন্ধ্যায় শুভ অধিবাসের মধ্যে দিয়ে তিন দিন ব্যাপি অনুষ্ঠানমালা শুরু হবে। ১৩ অক্টোবর সোমবার অরুণোদয় হতে অষ্ট প্রহরব্যাপি তারক ব্রম্ভনাম সংকীর্ত্তন এবং পরদিন মঙ্গলবার প্রথম প্রহরে দধিমঙ্গল, দ্বি-প্রহরে ভোগ আরতি ও মহান্ত বিদায়ের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানমালার সমাপ্তি হবে।
মহোৎসব উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে গৌরাঙ্গদেব ট্রাষ্ট বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, এবারের উৎসবকে ঘিরে প্রায় পাঁচ কি.মি. এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। মহোৎসব ও উৎসবকে ঘিরে মেলাÑএসব নির্বিঘœ করতে মাঠে থাকবেন ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ট্রাষ্ট বোর্ডের কয়েক’শ নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী।
গোদাগাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এসএম আবু ফরহাদ জানান, খেতুরীধাম ও মেলাকে ঘিরে ওই এলাকায় যে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সেখানে জেলা পুলিশের ১৯০ জন সদস্য সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়া প্রেমতলী বাজারে বসানো হবে পুলিশ কন্ট্রোল রুম। পাশাপাশি মাঠে থাকবে র‌্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা।
গৌরাঙ্গদেব ট্রাষ্ট বোর্ডের সম্পাদক শ্যামাপদ সান্যাল জানান, সারা পৃথিবীতে হিন্দু ধর্মাবলাম্বীদের মোট ছয়টি ধাম রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটিই ভারতবর্ষে। একটি মাত্র বাংলাদেশে। আর তা খেতুরীধাম। এ কারণে প্রতিবছর উৎসবকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন জেলাসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ত্রিপুরা ও আসাম এবং নেপাল ও মায়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক লাখ ভক্তের সমাগম ঘটে খেতুরীধামে। গেল বছর বৈরী আবহাওয়া ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে ভক্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম হয়েছিল। কিন্তু এ বছর এখনো পর্যন্ত সব কিছু ঠিক থাকায় এবার ভক্তের সংখ্যা সাত লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করেন তিনি।
গৌরাঙ্গবাড়ি মন্দিরের ব্যবস্থাপক গোবিন্দ চন্দ্র পাল জানিয়েছেন, সুন্দর পরিবেশে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে এবার ব্যপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। লাখ লাখ নারী-পুরুষ ভক্তের জন্য প্রয়োজনীয় প্রসাদ, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া যাতায়াত নির্বিঘœ করতে প্রেমতলী বাজার থেকে খেতুরীধাম পর্যন্ত প্রায় তিন কি.মি. সংযোগ সড়কটিতে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে, রবিন সাহা সম্পাদিত ‘শ্রী নরোত্তম ঠাকুর মহাশয় এর সংক্ষিপ্ত জীবনী’ বইটি পড়ে জানা গেছে, ১৫৩১ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুর নরোত্তম দাস তৎকালীন গড়েরহাট পরগণার অন্তর্গত ও বর্তমান গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মাতীরস্থ গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জমিদার কৃষ্ণনন্দ দাস, মা নারায়নী রাণী। গোপলপুরে শৈশব অতিবাহিত করে ঠাকুর নরোত্তম দাস বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে শ্রীমন্মহাপ্রভুর কৃপাপাত্র, অভিন্ন চৈতন্য নিগূঢ় নিতাই, নিখিল বৈষ্ণবকুল চূড়ামণি, প্রেমভক্তি চন্দ্রিকার মরমি কবি, গরানহাটি ঘরাণার প্রবর্তক, ব্রজলীলার চম্পক মঞ্জরী, প্রভূপাদ মহাপ্রভু লোকনাথ গোস্বামীর নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দীক্ষা লাভ করেন নরোত্তম দাস। ইতহাস বলে, নরোত্তম দাস লোকনাথ গোস্বামীর একমাত্র শিষ্য। শ্রীজীব গোস্বামী তাঁর গুণে ও জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে তাকে “ঠাকুর মহাশয়” উপাধীতে ভূষিত করেন। একবার ঠাকুর নরোত্তম দাস শ্রীনিবাস আচার্যের সঙ্গে হিন্দুধর্ম প্রচারে গৌড়দেশে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো চুরি হয়ে গেলে শ্রীনিবাসের আদেশ অনুযায়ী সন্ন্যাস বেশে তিনি বর্তমান গোদাগাড়ীর খেতুরী গ্রামে আসেন। সেখানে আসার পর নানা অকল্পনীয় কাজের আশ্চর্য সমাধানের কারণে নরোত্তমের প্রতি মানুষের ভক্তি ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঠাকুর নরোত্তম দাস তখন নবনির্মিত খেতুর মন্দিরে স্থাপনা গড়ে তোলেন এবং সেখানে উৎসব আয়োজনের ব্যবস্থা করেন। শ্রীনিবাস আচার্যের ইচ্ছে অনুযায়ী তিনি চতুর্দিকে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠানো শুরু করেন। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা এসে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করেন।
১৬১১ খ্রীষ্টাব্দের কার্তিকী কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে ঠাকুর নরোত্তম দাস নিত্তলীলায় প্রবেশের মানসে গঙ্গাস্নানের বাসনা প্রকাশ করেন। শিষ্যগণ তাকে গঙ্গাজলে নিয়ে গেলে নিজের দেহকে অর্ধনিমজ্জিত করে প্রিয় শিষ্য গঙ্গানারায়ণ ও রামকৃষ্ণকে আদেশ করেন দেহ মার্জন করতে। গুরু আজ্ঞায় নরোত্তমের ওই দুই শিষ্য দেহ মার্জন করতে থাকলে পুরো দেহ সাদা দুধের মতো তরল পদার্থে পরিণত হয়ে গঙ্গাজলে মিলিত হয়ে যায়। সে অনুযায়ী ঠাকুর নরোত্তম দাস পৃথিবীতে ৮০ বছর স্থায়ী ছিলেন। এর পর থেকেই যুগ পরস্পরায় দূর্গাপূজার পর বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা অহিংসার এই মহান সাধক ঠাকুর নরোত্তম দাসের কৃপা লাভের আশায় খেতুরী ধামে বার্ষিক মিলিত হয়ে থাকেন। আর মহোৎসবকে ঘিরে মেলার আয়োজন করায় উৎসব হয়ে ওঠে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের।

বাংলাদেশ সময়: ০:১১:৪৪   ২১৩১ বার পঠিত