মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪

মাসুদ রানার নায়িকা- এন শামসুন সুমি

Home Page » সাহিত্য » মাসুদ রানার নায়িকা- এন শামসুন সুমি
মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪



10660186_10202463288737108_4421820795388643204_n.jpgযে শহরে আমার সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে থাকার কথা, সে পথ তখন বেলা গড়িয়ে আরও ৬০ মাইল বাকি। গাড়ির জি পি এস’এ শো করছিলো সামনে হাইওয়েতে একটি বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে। এক ঘণ্টার পথ ৩ ঘণ্টাও লাগতে পারে। অগত্যা নেটে কাছাকাছি কোন হোটেল পাওয়া যায় কিনা, তা সার্চ দিলাম। যা একটি পাওয়া গেলো সেটাও ২২ মাইল দূরে।
কাছে বলতে যা পাওয়া গেলো- সামনে এক্সিট নিলেই বড় রাস্তার পাশে ছোট একটি মোটেল।উপায় না দেখে, সেদিকেই চললাম।এদিকটা কিছুটা গ্রামের মতো। সন্ধ্যা হতেই মানুষগুলো ঘুমিয়ে পড়ে। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। হালকা ঠাণ্ডা পড়েছে। বৃষ্টি আসবে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু হু হু শব্দ করে বাতাস হচ্ছে। বাতাসে এলোমেলো করে দিলো আমার চুল, মুখ ঢেকে যাওয়া চুলের এক ফাঁক দিয়ে গাড়ির জানালা্র গ্লাসে নিজের চেহেরা দেখে ভয়ে আঁতকে উঠি। নিঃশব্দ ,নির্জন পরিবেশেও যে কত ভুতুরে হয় হঠাৎ কোলাহল থেকে গেলে, তা বোঝা যায়।

অনেকক্ষণ যাবত বেল বাজাচ্ছি, রিসিপশন ডেস্কে কেউ নেই। ভেতর থেকে টুং টাং আওয়াজ আসছে, কিন্তু বেল বাজানোর শব্দ ভেতর পর্যন্ত যাচ্ছেনা।
ঘরের চারদিকে একটু চোখ বুলালাম, দেয়ালের রঙ খশে পড়ছে, কয়েকটি পুরনো চেয়ার, মাঝখানে রংচটা একটি টেবিল। ছাইদানিতে বেঁচে যাওয়া সিগারেটের পোড়া অংশ, ফুলদানীতে শুকিয়ে যাওয়া কিছু মরা গোলাপ কঙ্কাল হয়ে আছে।
হঠাৎ পায়ের শব্দ ছাড়াই গলার আওয়াজ ভেসে এলো- ” কি সাহায্য করতে পারি ? ”

বললাম- একটি রুম লাগবে, শুধু রাতটা কাটানো।
আইডি এগিয়ে দিলাম, রুম নিলাম, নাম্বার ৩১৬।
রাত আটটার মতো বাজে তখন, কিন্তু মনে হচ্ছিলো মধ্য রাত।
লোকটা বুঝিয়ে দিলো, এখান থেকে বের হয়েই হাতের ডান দিকে, সোজা গিয়ে বামে, তারপর আবার ডানে।
তারপরও জিজ্ঞেস করলো- বুঝেছ ?
বুঝবো না কেন ? স্কুলে কত ডান বাম ডান শিখেছি ! ( মেজাজ খারাপ থাকলে- আমি ইংরেজির জবাব বাংলায় দেই , গালিও )
লোকটা খরখর করে উঠে বলল– কি বললে ?
বললাম,না কিছুনা, থ্যাংকস ! গুড নাইট।

রুমের দিকে যাচ্ছি। নিজের পায়ের শব্দ না পেলেও,মনে হল পেছন পেছন কেউ আমাকে ফলো করছে, পায়ের শব্দ পেলাম। আমার হাঁটার গতি আরও দ্রুত হল। ডান বাম ডান, মুখোমুখি ৩১৬। চাবি ঘুরছে না, হাত কাঁপছে। কে যেন বলল- বামের দিকে ঘুরিয়ে খোল। আমার আত্মা সমুদ্রের মতো, মুহূর্তেই টের পেলাম, তা শুকিয়ে মরা খাল বিল হয়ে গেছে। পেছন ঘুরে দেখি সেই লকটিই দাঁড়িয়ে।
আমার দিকে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স এগিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, শান্ত ভাবে বলল- ফেলে এসেছিলে। আমার ডিউটি সকাল পাঁচটা পর্যন্ত, অন্য কারো কাছে দায়িত্ব দিতে চাচ্ছিলাম না। কি হল, নাও ?
লোকটিকে এবার বেশ ভালমত চেয়ে দেখলাম। তামাটে গায়ের রঙ, চুল উস্ক খুস্ক। দাঁড়ি গোঁফ মিলে মিশে পুরো জঙ্গল হয়ে আছে।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনি পেছন থেকে ডাক দিলেই তো পারতেন, ফলো করছিলেন কেন ?
বলল- এখানে জানলা গুলো ঠিক বাঁধাই না, বাহিরের শব্দ রুমের ভেতর পর্যন্ত যায়। অনেকেই ঘুমিয়ে পরেছে। এতো জোরে ডাকলে অনেকের ডিস্টার্ব হত।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াহুড়া করে রুমে ঢুকে পড়ি।

রুমটা যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি খারাপ , নিজেকে মাসুদ রানা থ্রিলের নায়িকা মনে হচ্ছিলো। ঘরের মধ্যে কেমন যেন একটি পুরনো সিগারেটের ধোয়ার গন্ধ। বমি আসছিলো। ব্যাগ থেকে দ্রুত পারফিউম বের করে সাড়া ঘরে স্প্রে করলাম।
ফ্রেশ হতে ইচ্ছে করলনা।
বিছানার মাঝখানে উঠে হাঁটু গুঁজে বসে রইলাম। আলো জ্বালিয়ে রাখলাম। মনে হচ্ছিলো, পাশের রুমে হয়তো কোন খুনি লুকিয়ে আছে।
কিছুক্ষন পর কান্ট্রি রোড ভেঙে একটি ট্রাক এসে আমার রুমের সামনে পার্ক করলো। ট্রাকের হেড লাইটটা তখনো জালানো। জানালার পর্দা ফাঁক করতেই আলো আমার চোখের মনি ছিদ্র করে দিলো, কিছুক্ষন কিছুই দেখতে পারলামনা, তবুও দেখার চেষ্টা করলাম,সামনের সিটে কে বসে আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
আমি মনে মনে প্রস্তুত হলাম।
না , সাহস রাখতে হবে। কেউ যদি দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তাকে সঠিক ভাবে দেখে উল্টা আক্রমন করতে লাইট নিভিয়ে পর্দা সরিয়ে বাহিরের আলো ঘরে রাখতে হবে। প্রথম লাথিটা কোথায় মারবো তাও ঠিক করে ফেললাম। যেভাবেই হোক, ওদের কাছে নিশ্চয়ই অস্ত্র থাকবে, সেটা যেভাবেই হোক, নিজের হাতে আনতে হবে।
সারাজীবন বাবার রিভল্বার নাড়াচাড়া করেছি। কমবেশি যে জানি চালাতে,লোডও যে ফটাফট করতে জানি, সেটা আমার বাবাও কখনো জানতে পারেনি। আজ ঘটনার পর বাবা জানতে পারলে কি জবাব দেবো তাও ঠিক করে ফেললাম।
বাবা জানতে পারলে হয়তো অবাক হবেননা।১৪ বছর বয়সে, একবার কুমিল্লায় ডাকাতে পড়া বাসের পেছেনের জানালা দিয়ে আমার পালানোর ঘটনা তো তিনি জানেনই।

ট্রাকের হেড লাইট নিভে গেছে ততক্ষনে। ফোন হাতে নিলাম। নেটওয়ার্ক নেই, হাতের পেশী গুলো শক্ত করে ফেললাম। দুটো লোক ট্রাক থেকে নেমে কথা বলছে, চুরুট ধরাল। আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। হামাগুড়ি দিয়ে বিছানায় এসে বসলাম। লোকগুলো তখনো কথা বলছে, ঠিক কি বলছে বুঝতে পারলামনা।
আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে।
যখন চোখ খুললাম, ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা বাজতে ১০ মিনিট বাকি। চারদিক সেই আগের মতই স্তব্ধ।
আর এক মুহূর্তও না, ড্রপ বক্সে চাবি ফেলে, কান্ট্রি গার্লের মতো পায়ে বুট পড়েই গাড়ির দিকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দ্রুত গতিতে হাঁটতে থাকলাম। মনে হল পেছন পেছন তখনো কেউ যেন আসছে।
হ্যাঁ, আসছেই তো। সেই রাতের লোকটা।
আমি এবার আর তাঁকে কথা বলার সুযোগ দিলাম না।

হাইওয়েতে উঠেই মনে হল- আহা লোকটা নিশ্চয়ই এবার আর আমাকে ফলো করছিলো না। ৫ টায় তার ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরছিল সম্ভবত।
যাক, যা গেছে যাক। কঠিন এক স্বপ্নের রাত কেটে গেছে।

প্রতিদিন ভোর ৬ টায় আমার ফোনে অ্যালার্ম ঠিক করা থাকে। আজও ঘড়ি ধরে সে ঠিক সেই সময়ই বেজে উঠলো।

দ্বিতীয় বারের মতো আমার চোখ খুলল।
২২ মাইল দূরে যে পাঁচতাঁরা হোটেলটা আমি প্রথমেই সার্চ দিয়ে পেয়েছিলাম, তার ৩১৬ নাম্বার রুমের বিছানার ঠিক মাঝখানে আমি শুয়ে আছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫:৩৭:৩৬   ৪৫৮ বার পঠিত