শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪

তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চাইলেন প্রধানমন্ত্রী

Home Page » জাতীয় » তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চাইলেন প্রধানমন্ত্রী
শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪



un.jpgবঙ্গ-নিউজ ডট কম:যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত অবাধ প্রবেশাধিকার চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় দুপুরে ম্যানহাটনের গ্রান্ড হায়াত হোটেলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিয়ে তিনি এ দাবির কথা বলেন।আমেরিকান চেম্বার ও আমেরিকান বিজনেস কাউন্সিল আয়োজিত এই মধ্যাহ্নভোজে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি করা পোশাক থেকে শুল্ক বাবদ আমেরিকা বছরে ৮৩২ মিলিয়ন ডলার আয় করছে।
তিনি বলেন, শুল্ক ছাড়া এসব পণ্যের ছাড় দেয়া হলে মার্কিন খুচরা বিক্রেতারা লাখ লাখ ডলার বাড়তি আয় করতে পারবেন। আর বাংলাদেশের উৎপাদকেরাও বেশি দাম দিতে পারবেন। এ থেকে পোশাককর্মীদের বেশি মজুরি দেওয়া সম্ভব হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, শুধু টাকার অংক নয়, নজর দিতে হবে শ্রমিকের মানবিক মূল্যের দিকে। কেন না এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৪০ লাখ মানুষের জীবিকা, যার ৯০ ভাগই নারী।

এ সময় তৈরি পোশাক খাতে কাজের পরিবেশ মানসম্মত করতে তার সরকারের আন্তরিকতার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।বাংলাদেশের বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশের কথা জানিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের আরো বেশি বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার যে স্বপ্ন তা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী নেতাদের সামনে তুলে ধরেন।

তিনি ২০২১ সালের মধ্যে শিল্পনির্ভর মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার পথে সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে আহ্বান জানান।
একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের বিনিয়োগ সহায়ক নীতির সুবিধা নিতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় তিনি ক্ষমতা নেওয়ার সময় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ ছিল। ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার সময় তা দাঁড়িয়েছিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে।
এর কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এইএস’র মতো প্রতিষ্ঠানকে আমরা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দিয়েছি। হরিপুর ও মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করে এই কোম্পানি ধীরে ধীরে তাদের বিনিয়োগ বহুগুণে বাড়িয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবে দুঃখজনক হলেও সত্য ২০০৯ সালে তার সরকার যখন ফের ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ৪০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

আবারো বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে সরকার গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়ানোর সকল সম্ভাব্য দিকগুলো নিয়ে কাজ করে বলে জানান তিনি।শেখ হাসিনা বলেন, ২০১১ সালের মধ্যে বিনিয়োগ ১১৭.১৪ ডলারে উন্নীত করা হয়। আর ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র মোট বিনিয়োগ করে ৩৩১.৩৫ মিলিয়ন ডলার।তিনি আরো বলেন, ২০১৪ সালের সর্বশেষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। তবে গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিনিয়োগ তার তুলনায় বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ অনেক কম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে এই বিনিয়োগের হিসাব বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে এটাই আমরা প্রত্যাশা।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ৩৩১ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও সক্ষমতার তুলনায় তা অনেক কম। বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত ছাড়াও আরো বেশকিছু খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। আপনারা এসব খাতে আরো বেশি বিনিয়োগ করুন।’
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহজ কর অবকাশ সুবিধা, কম শুল্কে যন্ত্রপাতি আমদানি, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য শতভাগ সমান সুবিধা, বাধাহীন এক্সিট পলিসি, মুনাফা নিজ দেশে নেওয়াসহ নানা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সাতটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জমি নিয়ে শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবেন।’
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৮ কোটি তরুণ জনশক্তি এবং ১৬ কোটি ক্রেতার বিশাল বাজার বিনিয়োগকারীদের সহায়ক হবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি জানান, ‘সরকার জাহাজ নির্মাণ শিল্প, সার, অটোমোবাইল ও লাইট, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, ওষুধ, সিরামিক, প্লাস্টিক, পাটপণ্য, তথ্য-প্রযুক্তি, সমুদ্র সম্পদ আহরণ, পর্যটন, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং টেলিযোগাযোগ খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী।’
এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তির (টিকফা) ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতার ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা বিরোধ মীমাংসার পর বাংলাদেশ সমুদ্রে যে অগাধ জলরাশির অধিকার পেয়েছে, সেখানে সমুদ্র তলদেশে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই সম্পদ আহরণে বিনিয়োগ প্রয়োজন। আর এ কাজেও অন্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রেরও দুটি কোম্পানি কাজ পেয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের প্রধান গন্তব্য। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরগুলোতে বাংলাদেশ ৮ থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিচ্ছে।
তিনি জানান, গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৫.২ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছ থেকে ৮৩২ মিলিয়ন ডলারের শুল্ক পেয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ থেকে পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে বন্দরগুলো শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পেলে এখানকার খুচরা বিক্রেতাদের অনেক অর্থ বেঁচে যেতো। আর তাতে আমাদের দেশে যে শ্রমিকরা এই পোশাক তৈরি করছে তাদের মজুরি ও সুবিধা বাড়ানো সম্ভব হতো।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে আরো বিনিয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এতে ৪০ লাখ শ্রমিকের এই শিল্প খাতটি, যার ৯০ শতাংশই নারী কর্মশক্তি আরো এগিয়ে যেতে পারবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে।
দেশে গত এক বছরে শ্রমখাতের সংস্কারগুলো তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গত চার বছর ধরে আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত থেকে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়েছি। একজন শিক্ষানবিশের মজুরি ২০০৯ সালে ছিল ১৬০০ টাকা, ২০১৩ সালে তা ৫৩০০ টাকা করা হয়েছে। আইএলও’র নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি নেওয়া হয়েছে বলেন জানান প্রধানমন্ত্রী।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, কারখানাগুলোর কর্ম-পরিবেশ নিশ্চিত করতে নিয়মিত পরিদর্শনের জন্য তার সরকার এক হাজার পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েছে। আইএলও-আইএফসির সহায়তায় উন্নত কর্মপরিবেশ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়নে সংখ্যা ১০০টি থেকে ২৩০টিতে উন্নীত করা হয়েছে।

২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত টিকফা চুক্তির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এর মাধ্যমে দুই দেশ প্রথমবারের মতো কৌশলগত সহায়তার চুক্তিতে আবদ্ধ।

তিনি বলেন, গত ছয় বছরে বাংলাদেশ সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি এনেছে তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের প্রমাণ এই চুক্তি।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ ৬.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করছে, গত এক দশকে দারিদ্রের হার ৫৭ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, মাথাপিছু আয় ৬৫ শতাংশ বেড়েছে, ডাবল ডিজিট থেকে মুদ্রাস্ফিতি আবার ৭.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়ে প্রায় এক কোটি।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অংশ নেন- অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবদুস সোবহান সিকদার, সিনিয়র সচিব আবুল কালাম আজাদ, এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদসহ স্থানীয় অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে অবস্থান করা শেখ হাসিনা এদিন ভয়েস অফ আমেরিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন।

ব্যবসায়ীদের অনুষ্ঠানের পর কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালার সঙ্গে তার বৈঠক করার কথা।

এছাড়া কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের আলোচনা সভায় যোগ দেওয়া ছাড়াও নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ হাউজে নৈশভোজে অংশ নেবেন তিনি।

শনিবার সাধারণ পরিষদে বক্তব্য দিবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এর ফাঁকে তিনি আরো কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করবেন।

আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক ছেড়ে লন্ডনে যাত্রাবিরতি দিয়ে ২ অক্টোবর শেখ হাসিনার ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১:২২:০১   ৩৯২ বার পঠিত