রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪
প্রশাসনে বেড়েছে ক্ষোভ আর হতাশা
Home Page » জাতীয় » প্রশাসনে বেড়েছে ক্ষোভ আর হতাশাবঙ্গ-নিউজ- ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রশাসনে বেড়েছে ক্ষোভ আর হতাশা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় বসার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে বেশ আশার সঞ্চার হয়েছিল। এর মধ্যে এক. সরকারি কর্মচারী আইন প্রণয়ন হবে, দুই. বঞ্চিতদের পদোন্নতির দ্বার উন্মোচন হবে ও তিন. দীর্ঘ দিন ওএসডিতে থাকা কর্মকর্তাদের একটি বিহিত হবে। কর্মকর্তারা এ ধরনের আশা নিয়েই এগোচ্ছিলেন। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসা মহাজোট সরকারের আট মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও এসব ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা কোনো আশার আলো দেখতে না পেয়ে অনেকটাই মুষড়ে পড়েছেন। বিশেষ করে যারা দীর্ঘ দিন ধরে ওএসডিতে রয়েছেন। সরকার সমর্থক নয় এমন অভিযোগে অনেকেই দীর্ঘ দিন ধরে ওএসডির শিকার। বর্তমান সরকারের গত ৯ মাসে ১৩৮ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকও এ তথ্য সংসদে জানিয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওএসডিতে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে সচিব একজন, ১৪ জন অতিরিক্ত সচিব, ৪১ জন যুগ্মসচিব, ২২ জন উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব ৫০ জন ও সহকারী সচিব ১০ জন। এ ছাড়া অনেকেই বছরের পর বছর কম গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত আছেন। এ দিকে প্রশাসনে জেঁকে বসেছে বাধ্যতামূলক অবসর আতঙ্ক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার সমর্থক নয় এমন সব কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরের আওতায় আনা হতে পারে বলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘ দিন ওএসডিতে থাকা কর্মকর্তাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ওএসডিতে থেকেই কর্মকর্তারা মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে চাকরি জীবন থেকে বিদায় নিচ্ছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যে অবসরে গেছেন। ওএসডির পাশাপাশি সংযুক্তির বিষয়টিকে আরেক ধরনের শাস্তি হিসেবে দেখছেন কর্মকর্তারা। বেতনের বাইরে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। অন্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা অধিদফতরে সংযুক্তির মাধ্যমে কাজ করলেও তাদের বেতন তুলতে হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এক সময় বিশেষ ধরনের কাজ সম্পাদনের জন্য মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তাদের ওএসডি করার রেওয়াজ ছিল। সরকারের বিশেষ কোনো কাজ সম্পাদন করা এর লক্ষ্য ছিল। সাম্প্রতিককালে এটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ওএসডি এবং সংযুক্ত করা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান কাঠামো অনুযায়ী, প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব ১০৭ জন, যুগ্মসচিব ৪৩০ ও উপসচিবের নিয়মিত পদ ৮৩০টি। বাস্তবে কর্মরত রয়েছেন ২৭৩ অতিরিক্ত সচিব, ৯১৯ যুগ্মসচিব এবং এক হাজার ২৯৪ জন উপসচিব। অতিরিক্ত কর্মকর্তাদের ভারে ভারাক্রান্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতর। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রচলিত আইনে মঞ্জুরিকৃত পদের বিপরীতে পদোন্নতি প্রদানের স্পষ্ট বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এতে করে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। পিরামিডের স্থলে প্রশাসন পেট মোটা রূপ নিয়েছে। পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সাথে তার বেতনভাতাদিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা জড়িত। এর জন্য জাতীয় বাজেটে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের যানবাহন ব্যয় রয়েছে ১৫ ভাগ। সাম্প্রতিক কালে বেশ কয়েক দফায় বড় ধরনের পদোন্নতির ফলে ব্যয় বেড়ে গেছে। পদের বিপরীতে অতিরিক্ত পদোন্নতি দেয়ার ফলে অনেকেই এখন ওএসডি। রাজনৈতিক কারণ বা বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ওএসডি থাকা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পদোন্নতি পাওয়া বেশ কিছু কর্মকর্তা রয়েছেন এ তালিকায়। কাজ না করে বসে বসেই বেতন নিচ্ছেন মাসের পর মাস। এ প্রসঙ্গে কর্মকর্তারা বলেছেন, পদ সৃষ্টি না করেই পদোন্নতি দেয়ার বিধান রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রচলিত আইনে পদ সৃষ্টি করে তবেই পদোন্নœতির বিধান স্পষ্ট করা রয়েছে। পদ না থাকলেও বেতন ঠিকই পাবেন। এটাকে আর্থিক শৃঙ্খলাপরিপন্থী বলে তারা বলেছেন। তারা জানান, বিভিন্ন সময় একাধিক নীতিমালা প্রণীত হলেও নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, পদোন্নতির েেত্র এসব নীতিমালা মানা হচ্ছে না। সব কিছুই হয় ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের ইচ্ছামাফিক। পাশাপাশি পদোন্নতির যে বিধিমালাটি (২০০২ সালে সংশোধিত) বর্তমানে রয়েছে, সেটাও সঠিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। সব যোগ্যতা থাকার পরও অনেকেই পদোন্নতি থেকে এখনো বঞ্চিত।
২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে প্রশাসনে তিন স্তরের বড় ধরনের পদোন্নতি দেয়া হয়। উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে ৫০৩ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। অভিযোগ ওঠে যোগ্যতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও সহস্রাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। বঞ্চিতরা ােভে পদোন্নতির দাবি জানিয়ে পরবর্তী ৯ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সচিব ইকবাল মাহমুদ ছাড়াও সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) চেয়ারম্যান ও সভাপতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো: আবদুল আজিজ এনডিসির সাথে দেখা করেন। সাাৎকালে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে কিছু বিুব্ধ কর্র্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরি কে বসেন। উত্তেজিত কোনো কোনো কর্মকর্তা মিডিয়াকর্মীর সাথে কথা বলেন। তাদের বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। এর ফলে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ জন্য এখন অনেকের ভেতর ক্ষোভ থাকলেও তারা কথা বলতে পারছেন না। ুব্ধ একাধিক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, আমাদের কষ্ট শোনার কেউ নেই। বলতেও ভয় পাই।
কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর পরেই সচিব। এর পরের স্তরে অনুবিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্মসচিব। এর নিচের স্তর অধিশাখার প্রধান উপসচিব। তারা জানান, যুগ্মসচিব অতিরিক্ত সচিবের অধীনে নন; কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন। সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগে যুগ্মসচিবেরা নথি পেশ করছেন অতিরিক্ত সচিবের মাধ্যমে। এটা রুলস অব বিজনেসের সরাসরি ব্যত্যয় বলে তারা জানান। অন্য দিকে ৮২ রেগুলার ও বিশেষ ব্যাচের অতিরিক্ত সচিবদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ পদে জুনিয়র কর্মকর্তা থাকায় সিনিয়র কর্মকর্তাদের তাদের অধীনেই চাকরি করতে হচ্ছে। এসব নিয়ে জনপ্রশাসনে এখন অব্যবস্থাপনা চরমে।
এ দিকে অধরাই থেকে গেল প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী আইনটি। সচিব কমিটির সিদ্ধান্তের পর খসড়াটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। জনপ্রশাসন সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, সচিব কমিটিতে অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একাধিক বৈঠক করেও এখন পর্যন্ত সচিব কমিটি এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। কয়েকটি দেশের একই ধরনের আইন আরো পরীক্ষা করে দেখতে চায় এ কমিটি। এ আইনটির ব্যাপারে কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে যে উৎসাহ ছিল এখন সেটা আর নেই বলে জানান অনেকেই। তারা জানান, সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কাজে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কাজের শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণের জন্য সংসদে আইন করার বিধান রয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে এই বিধান সংযোজন করা হলেও এ পর্যন্ত এই আইন করা হয়নি। তারা জানান, একেক সময় একেক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে। তারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী প্রশাসন চালিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের আস্থাভাজন লোককে বসিয়েছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও দলীয়করণ করা হয়েছে বলে সবসময়ই অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে এক দিকে মেধাবী কর্মকর্তারা যথাসময়ে পদোন্নতিসহ সরকারের উচ্চপদে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অপর দিকে রাজনৈতিক প্রভাবে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী কর্মকর্তারা উচ্চপদে আসীন হয়ে জনগণের প্রত্যাশিত সেবা নিশ্চিত করতে পারছেন না। বিদায়ী এবং বর্তমান সরকারের প্রায় প্রতিটি পদোন্নতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ৯:২২:১৬ ৩০৬ বার পঠিত