শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪

বিশ্বকবির সাথে বিদ্রোহী কবির প্রথম সাক্ষাৎ-ধারাবহিক

Home Page » এক্সক্লুসিভ » বিশ্বকবির সাথে বিদ্রোহী কবির প্রথম সাক্ষাৎ-ধারাবহিক
শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪



বিশ্বকবির সাথে বিদ্রোহী কবির প্রথম সাক্ষাৎ

1401001921.jpg

বঙ্গ-নিউজ:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। দু’জনই মৌলিক ও যুগপ্রবর্তক কবি। তাঁরা আমাদের ঐশ্বর্য। বাঙালি তথা বিশ্বের মানুষের কাছে এই দুই কবি সমানভাবে শ্রদ্ধেয়। রবীন্দ্রনাথের লেখায় আমরা যে রেনেসাঁ প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে নতুন ও সুন্দরের গড়ার ভার ছিল তাঁর ওপরই। ঘুনে ধরা পুরানোকে ভাঙার দায়িত্ব পড়ল নজরুলের ওপর। বিশ্বজনীন প্রেমানুভূতি ও প্রজ্ঞা রবীন্দ্রনাথকে কঠোর ও নির্মম হতে দেয়নি। শিক্ষা-বিজ্ঞানীর মতো তাঁর চেষ্টা ছিল পরোক্ষ। নজরুল প্রত্যক্ষ ফল লাভে উৎসুক ছিলেন। দু’জনের লক্ষ্য ছিল এক এবং অভিন্ন প্রেম পাওয়া ও দেওয়া। সমাজ-ধর্ম-রাষ্ট্র থেকে অসুন্দর অপসারিত করে কল্যাণ ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। অপ্রেম অসুন্দরই নজরুলকে করেছে সংগ্রামী। বোধিপুষ্ট রবীন্দ্রনাথের ছিল সইবার ও অপেক্ষা করবার ধৈর্য। জীর্ণ আবর্জনা সরিয়ে না ফেললে নতুন ইমারত গড়ে তোলা যে দুঃসাধ্য এ বাস্তব বোধ রবীন্দ্রনাথের ছিল। তা তিনি পারছিলেন না বলে অস্বস্তিবোধ করছিলেন। তা-ই করার ব্রত নিয়ে একজনের সদম্ভ আবির্ভাব দেখে রবীন্দ্রনাথ নিজে উল্লসিত হয়ে নজরুলকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে বিশেষভাবে স্নেহ করতেন ও ভালবাসতেন তার প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় আর নজরুলের কর্মে বাঙালির রেনেসাঁ পূর্ণতা লাভ করেছে। উভয়ে একে অন্যের পরিপূরক।
শৈশব থেকেই নজরুল রবীন্দ্রনাথকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। শৈশবে দরিরামপুর স্কুলে একটি বিচিত্রানুষ্ঠান হয়, সে অনুষ্ঠানে নজরুল রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’, ও ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা দুটো আবৃত্তি করে উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে দেন। নজরুল তাঁর ‘বড়র পিরীতি’ ‘বালির বাঁধ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ছেলেবেলা থেকে তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বন্দনা করেছি।’ এ উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় নজরুল রবীন্দ্রনাথকে কতোটা শ্রদ্ধা করতেন। পরবর্তীকালে করাচিতে সৈনিক জীবনেও রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি নজরুলের কাছে থাকত। সৈনিক জীবন শেষে কলকাতায় এসেও প্রথমে নজরুল গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগে ও পরে নজরুল কয়েকটি কবিতা ও গান রচনা করেছেন। সেগুলো অত্যন্ত সুন্দর।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের পরে নজরুলের সাংবাদিক সাহিত্যিক জীবনের শুরুতে কলকাতার সাহিত্যিকদের দু’টি বিখ্যাত আড্ডা ছিল। একটি ‘ভারতী’র কার্যালয়ে তথা সুকিয়া স্ট্রীটে (বর্তমান কৈলাস বসু স্ট্রীট) ছিল ‘‘ভারতী’-র আড্ডা”, অন্যটি ‘গজেন্দ্র চন্দ্র ঘোষের ৩৮ নং কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের বাড়ির ‘সাহিত্যের আসর’, যাকে বলা হত ‘‘গজেন-দা’র আড্ডা” সেখানে অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই যেতেন। সেখানেই একদিন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তে-র সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, (কবি নজরুল পৃষ্ঠা-১২৬) নজরুল সেই আড্ডায় এসে রবীন্দ্র-সংগীত শোনাতেন। নজরুল ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরিচিত হওয়ার কাহিনী পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘চলমান জীবন’ দ্বিতীয় পর্ব গ্রন্থে। সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘‘তুমি ভাই, নতুন ঢেউ এনেছ। আমরা তো নগন্য, গুরুদেবকে পর্যন্ত বিস্মিত করেছ তুমি।’ গুরুদেব আমার কোনো লেখা পড়েছেন নাকি?’ বিহবল হয়ে প্রশ্ন করে কাজী। ‘সত্যি বলতে কি’, বললেন সত্যেন দা, ‘গুরুদেবই আমাকে একদিন নিজ থেকে প্রশ্ন করলেন, কাজী নজরুল ইসলামের কোনো কবিতা পড়েছি কি না।’ তাঁর মতে, ‘ভাবের সংস্কৃতি সমন্বয়ের সাধনার এই এক নতুন অবদান আনছ তুমি।’ ‘গুরুদেব বলেছেন!’ আনন্দের আতিশয্যে মুখের কথা শেষ করতে পারে না নজরুল।”
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বর্ণিত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কথিত রবীন্দ্রনাথের উক্তিতে বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন, নজরুলের লেখা-ভাবের সংস্কৃতি সমন্বয়ের সাধনায় এ এক নতুন অবদান। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঠিক কত তারিখে নজরুলের দেখা হয়, তা জানা যায় নি। তবে প্রভাতকুমারের ‘রবীন্দ্রজীবনী’ পৃষ্ঠা-৮৬ থেকে জানা যায়, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মে থেকে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস পর্যন্ত প্রায় চৌদ্দ মাস রবীন্দ্রনাথ ইউরোপে ছিলেন। ইউরোপ থেকে ফিরে পুনরায় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই পর্যন্ত ইউরোপ-আমেরিকা সফর করেন। ১৬ জুলাই বোম্বাই থেকে বর্ধমান হয়ে বোলপুর আসেন। ২০ জুলাই ১৯২১ কলকাতা আসেন আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। মাঝখানে একবার শান্তিনিকেতনে ফিরে গেলেও সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ পর্যন্ত তিনি কলকাতায় ছিলেন। ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম দেখা হওয়া সম্ভবপর।
আবদুল আজিজ আল্-আমানের লেখা বইয়ে (নজরুল-পরিক্রমা’, ২২-২৪ পৃষ্ঠা) পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে গিয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাতের কথা জানা যায়। নজরুল করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পর ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হলেও রবীন্দ্র-দর্শন তখন পর্যন্ত হয়নি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করবার জন্য নজরুল তখন আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। অবশেষে সুযোগ মিলেছিল। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমেই দুই কবির মধ্যে প্রথম পরিচয় হয়। একদিন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় গেলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। প্রয়োজনীয় কথার পর রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে ‘মোসলেম ভারত’ দেখে পত্রিকাটি সম্পর্কে কথা তুললেন পবিত্র বাবু। সে সময় ‘‘মোসলেম ভারত’ মানেই নজরুল। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে নজরুলের কথা জিজ্ঞেস করলেন এবং বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে তাঁকে নিয়ে আসার আহবান জানালেন। শেষে নির্দিষ্ট দিনে পবিত্র বাবু নজরুলকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সামনে হাজির হলেন। সেদিন তাঁদের মাঝে বিশেষ কোনো কথা হয়নি।
তাছাড়া, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমাদের নজরুল’ প্রবন্ধের বর্ণনা থেকে মনে হয় কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ হয়।………চলবে

বাংলাদেশ সময়: ১১:০৯:১৫   ৬৩৯ বার পঠিত